পরী দৌড়াচ্ছে, তার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে শান্তা। পরীকে কিছুতেই ধরতে পারছে না।
Published : 07 Apr 2024, 12:32 PM
পরী দৌড়াচ্ছে, তার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে শান্তা। পরীকে কিছুতেই ধরতে পারছে না। কিছুদূর গিয়েই একদম পরীকে জাপটে ধরলো শান্তা। পরীর রাগ হয়ে গেল। ‘এই ভাবে ধইরো না আপা, আমার নতুন জামার আয়নাগুলা খুইলা যাইবো।’
‘আইচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু পরী তুই এই জামা কই থিকা পাইলি?’
‘ক্যান, আমি তো জানি না। তুমিও তো নতুন জামা পরছ, তুমি কই থিকা পাইলা?’
‘আইজ ঈদ, এইজন্য নতুন জামা পরছি। কই থিকা পাইলাম জানি না। চল চল দোলনাটা ফাঁকা হইছে, ওইখানে উঠমু...’
দোলনায় উঠতে গিয়ে ঘুম ভেঙে গেল পরীর। সে শান্তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল। এখন দেখল শান্তা ওর কাছ থেকে একটু দূরে ঘুমিয়েছে। পিঠে একটা সিমেন্টের ঢ্যালা লাগছে। চোখ কচলে সে বোনের গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো। ‘আপা উঠ, রইদ উইঠা গ্যাছে।’
ওরা ঘুমায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর, যে জায়গাটায় ইট-সিমেন্ট দিয়ে ঘরমতো বানানো হচ্ছে তার মেঝেতে। পরীর ডাকে উঠে পড়লো শান্তা। চোখ কচলে বললো, ‘এহন উইঠা কই যাবি?’
‘আমার খিদা লাগছে।’
‘আল্লাহ, কয় কি আমরা তো রোজা থাকুম!’
‘আমার খিদা লাগছে।’
‘কিন্তু খিদা লাগলেও রোজা থাকতে হয়।’
শান্তা ছোটবোনকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কারণ খাওয়ার মতো পয়সা নেই তার কাছে। মনসুর মামা ঈদ করতে বাড়িতে গেছে। তাই ফুল বিক্রিও নেই। শান্তার বয়স ৯, পরীর ৫। ছোটবোন পরীকে নিয়ে সে টিএসসি এলাকায় ফুল বিক্রি করে। ওদের বাবা-মা নেই। তাই শান্তাই ছোটবোনকে আগলে রাখে। পরীও এক মুহূর্ত বোনকে ছাড়া থাকতে পারে না।
‘না আমি আইজকা রোজা থাকুম না।’ পরী জেদ ধরে। শান্তা এখন কী করবে? ইফতারের আগে ছাড়া তো খাওয়ার পাওয়া যাবে না। ভার্সিটি বন্ধ। ক্যাম্পাসে লোকজন নেই। খাবারের দোকানগুলোও বন্ধ। শান্তা ভাবে, কী করা যায়? ভার্সিটিতে মিলি আপা ছিল, সেও বাড়িতে গেছে ঈদ করতে। মিলি আপা থাকলে খাওয়ার চিন্তা করতে হতো না তাদের। আবার যে মনসুর মামা শান্তাকে ফুল দিতো, সে-ও নাই। মনসুর মামা বাকিতে ফুল দেয়। সে ফুল বিক্রি করে তারা দাম দিয়ে দেয় সন্ধ্যাবেলা।
‘চল দেখি, ভার্সিটির দিক যাই। যদি কাউরে পাই। কিন্তু তোর তো খালি গা, এই অবস্থায় যাবি?’
পরী খেয়াল করে সে খালি গায়েই ঘুমিয়েছিল। একটা জামা আছে, সেটা কাল ধুয়ে দিয়েছে শান্তা।
‘দাঁড়াও, আমার জামাটা মনে হয় শুকায় গেছে।’
পরী দৌড়ায়, একটা গাছের কাছে যায়। জামাটা গাছের ডালে শুকাতে দিয়েছিল। নেড়ে চেড়ে দেখল শুকিয়েছে। সেটা নামিয়ে শরীরে চড়িয়ে দিলো। তারপর শান্তার সঙ্গে পরী গেলো রমনা কালী মন্দিরের পুকুরঘাটে। দুজনে পুকুরের পানি দিয়ে মুখ হাত ধুলো। হাত দিয়েই কয়েকবার মুখ মোছার চেষ্টা করলো দুজনে। তারপর ঝুঁকে জামাটা দিয়ে মুখ মুছলো। শান্তাকে অনুসরণ করে পরীও একইভাবে মুখ মুছলো।
টিএসসির দিকে এসে কালাচান আর সুমনকে পেলো তারা। ‘এই কালাচান তগো কাছে দশটা টেকা থাকলে দে তো। সইন্দায় দিয়া দিমু।’
‘না আমগো কাছে টেকা নাই।’
বলেই ওদের পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। রোদের অনেক তেজ। এই রোদে শান্তার ঘুরতে ভালো লাগে না। ক্যাম্পাসেও ছাত্র-ছাত্রীরা নেই। টিএসসি একদম ফাঁকা। খাঁ খাঁ করছে। আর দুইদিন পরে ঈদ। এজন্যই এমন অবস্থা। তারপরও পরীকে নিয়ে শাহবাগে এলো শান্তা। খাবারের দোকানগুলো বন্ধ। সেখানে কতক্ষণ বসে থাকলো। পরী খাবারের জন্য তাগাদা দেয়। শান্তা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, আরেকটু বেলা হলেই খাবারের দোকান খুলবে। দুপুর হতে হতেই রোড আইল্যান্ডে ঘুমিয়ে পড়লো পরী। শান্তাও ঘুমিয়ে পড়লো।
শান্তার মনে পড়ে, একবার তার মা তাকে নতুন জামা কিনে দিয়েছিল। আর পরীকে দুই বছর বয়সে রেখেই চলে গেছে। ওর সঙ্গে যারা ফুল বিক্রি করে, তারা বলে হারুন মিয়ার সঙ্গে চলে গেছে।
তারা জেগে উঠলো বিকেলের দিকে। ততক্ষণে অনেকগুলো ইফতারের দোকান বসে গেছে। শান্তা জানে, ওদের কাছে খাবার চাইলে এখন দেবে না। পরীকে উঠিয়ে ওরা টিএসসিতে না গিয়ে কাজী নজরুলের মাজার পেরিয়ে মসজিদের পাশ দিয়ে সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির দিকে এলো।
‘ক তো পরী আমরা এইদিকে ক্যান আইলাম?’
‘ক্যান?’
‘এইদিকে ভালো ভালো খাওয়ার পামু। এইদিকের আপা ভাইয়ারা দামি খাওয়া খায়। ওই দ্যাখোস না, ওই দোকানটায় মুরগির রোস্ট, হালিম, পোলাও ধরনের কত খাওয়া পাওয়া যায়?’
শান্তা পরীকে সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির চত্বরের ফাস্টফুড কর্নারটা দেখিয়ে দেয়। আর তখনই পরীর আবার খাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়।
পরী বলে, ‘আমরা কি আইজকা মুরগির গোসতো খামু?’
‘হ, দেখি। সবায় ঈদে বাড়ি গ্যাছে তো। এহন কোন আপা ম্যাডামরা এইদিকে ইফতারি করতে আহে, সেইটা দেখি।’
‘আপা আমরা তো ঈদে নতুন জামা কিনছি, নাহ?’
‘নতুন জামা কই পাইলি?’
পরী বলতে পারে না। কারণ সে তো স্বপ্নে দেখেছিল নতুন জামা পরে ঘুরছে। ইফতার করতে অল্প কিছু লোক এসেছে। তাদের ভাগ্য ভালো, গাড়ি নিয়ে এক দম্পতি এসে বসেছে। ওদের কাছে চাইতেই, তারা কিছু খাবার দিয়ে দিলো। তারমধ্যে মুরগির মাংসের কয়েকটা টুকরাও আছে। আরও কয়েকজনের কাছে গেল। কেউ জিলাপি, কেউ পিঁয়াজু, কেউ বেগুনি দিলো। সব পলিথিনে ভরে তারা সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির বারান্দায় এলো। শান্তা আর পরী পেট ভরে খেল।
‘কিরে পরী ক্যামন লাগল খাওয়া?’
‘হ, আপা ভালো। আরাম পাইছি। তয় আরেকটা মুরগির গোস্ত পাইলে ভালো হইতো। আইচ্ছা যাওক। আমারে ঈদের জামা কিন্না দিবা না? ঈদে কি পরুম?’
শান্তা ভাবে, গত ঈদেও পরী জামা টামার কথা বলে নাই। কারণ ঈদ কী, সে বোঝে না। এইবার মনে হয় বুঝতে শিখছে। শান্তার মনে পড়ে, একবার তার মা তাকে নতুন জামা কিনে দিয়েছিল। আর পরীকে দুই বছর বয়সে রেখেই চলে গেছে। ওর সঙ্গে যারা ফুল বিক্রি করে, তারা বলে হারুন মিয়ার সঙ্গে চলে গেছে।
পরীকে নিয়ে শান্তা লাইব্রেরির সামনে এসে টিপ-কলে পানি খেলো। প্রথমে পরীকে খাওয়ালো, তারপর নিজে খেলো। বুলবুলির সঙ্গে দেখা, ওদের সাথেই ফুল বিক্রি করে। কিন্তু বুলবুলি থাকে শহীদ মিনারের দিকে। বুলবুলির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাকিম চত্বরের দিকে গেল। হঠাৎ করেই খেয়াল করলো শান্তা, পরী নেই।
বুলবুলি বললো, ‘আরে আশপাশেই আছে, আইবোনে..।’
বুলবুলির কথায় কান না দিয়ে শান্তা ফের টিপ-কলের কাছে এলো। নেই পরী। কলাভবনের দিকে গেল। নাহ, নেই। মধুর ক্যান্টিনের ওদিকটাতেও নেই। কিছুক্ষণ বসে থাকলো। পরীকে সে একদমই কাছ ছাড়া করে না। তারপরও মেয়েটা মাঝে মধ্যে এমন করে জ্বালায়। শান্তা বিরক্ত হলো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাবে কিনা ভাবলো।
শান্তা ওদিকে না গিয়ে লাইব্রেরির সামনে এসে পরীকে দেখলো।
‘কিরে কই গেছিলি?’
রাগ হয়ে বললো শান্তা। পরী অনেকটা ভয় পাওয়ার মতো করে বললো, ‘ওই খানে।’
হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
‘ওইখানে ক্যান গেছিলি, তোরে কইছি না আমার পিছ ছাড়বি না একদম?’
‘মুরগির গোস্ত...’
তারপরই বললো, ‘আপা টাকা...’
‘টাকা? টাকা কই পাইলি?
পরী জামার নিচ থেকে একটা মানিব্যাগ বের করলো। পরীর হাত থেকে নিয়েই সে জামার তলে লুকিয়ে ফেললো।
‘কাউরে কবি না....’
রাতে সিমেন্টের মেঝেতে শুয়ে শান্তার ঘুম আসছিল না। সে ভাবছিল মানিব্যাগটা কার? যে ভাইয়া আপা মুরগির মাংস দিছিল তার কিনা! মানিব্যাগটা জামার নিচে পাজামায় গুঁজে রেখেছে। ব্যাগে কিছু টাকা আছে। পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট। একশো টাকার নোটও আছে। মানিব্যাগটা বের করার আগে শান্তা দেখলো কেউ জেগে আছে কিনা। আশপাশে আরো অনেকেই ঘুমায়। শায়লা, সাথী, রুবেল। সব ওদের বয়সী।
সবাই ঘুমে নিমগ্ন। দূর থেকে আসা আলোতে মানিব্যাগটা খুললো শান্তা। অনেকগুলো কাগজ। ব্যাংকের কার্ড। শান্তা এসব চেনে। ভার্সিটির ভাইয়াদের কাছে দেখেছে। মিলি আপার কাছে কার্ড আছে। টিএসসির কোনা থেকে কার্ড দিয়ে টাকা বের করতে দেখেছে মিলি আপাকে। মানিব্যাগ খোলার সাথে ছোট ছবিওয়ালা কাগজ। ভার্সিটির আইডি কার্ড হতে পারে। কার্ডটা বের করে ফের পাজামায় গুঁজে ফেললো মানিব্যাগটা।
নামটা পড়ার চেষ্টা করলো শান্তা। সে পড়তে জানে কিছুটা। এই উদ্যানে ভাইয়ারা স্কুল খুলেছে। সেখানে গিয়ে কিছুটা পড়া শিখেছে। নিজের আর পরীর নাম লিখতে পারে। কার্ডের পেছনে একটা নম্বর। শান্তা জানে এটা মোবাইল নম্বর হতে পারে। সামনের নামটা বানান করে পড়লো। মাসুম আহমেদ। অবশ্য শান্তা উচ্চারণ করলো, ‘মা সু মো আ হো মেদ’।
ঈদের দিন ঘুম থেকে উঠেই কালী মন্দিরের পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলো তারা। কাল রাতে মাসুদ হোটেল থেকে ৩৫ টাকার খাবার কিনেছিল। খাবারটা একটু টক লাগছে।
পরদিন দুপুর পর্যন্ত তারা উদ্যানেই থাকলো। পরীর আজ ক্ষুধা নেই। সে ঘুম থেকে উঠেই বলেছে রোজা থাকবে। কিন্তু শর্ত একটাই, তাকে ঈদের জামা কিনে দিতে হবে। বিকেলে পরীকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে শাহবাগে এলো শান্তা। ইফতারির দোকান সারি দিয়ে বসেছে। এদের কয়েকজনকে চেনে। শান্তা একজনের কাছে গিয়ে বললো, ‘হাসান মামা, আমারে এক মিনিট মোবাইলে কথা কইতে দিবা?’
ইয়ার্কি করে তাড়িয়ে দিলো হাসান নামের লোকটা। জাদুঘরের সামনে ভদ্র মতোন একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসে আছে। দুজনে মোবাইলে কী যেন দেখছে। ওদের কাছে গেল শান্তা। মোবাইলে এক মিনিট কথা বলার জন্য জন্য চাইলো। মেয়েটা সাথে সাথে বললো, ‘না দিও না, মোবাইল নিয়ে দৌড় দেবে।’
‘আল্লাহর কসম, আমি দৌড়ামু না।’
ছেলেটা বললো, ‘কাকে ফোন দিবি?’
‘গেরামে... মায় আছে...।’
ছেলেটা কি একটু ভেবে বললো, ‘নম্বর বল।’
শান্তা কার্ডটাকে আড়াল করে ফোন নম্বরটা বললো। ছেলেটা কল দিয়ে শান্তার হাতে ফোনটা দিলো। শান্তা কানে লাগিয়ে একটু সরে এলো। ফিসফিস করে বললো, ‘আপনার মানিব্যাগটা আমি পাইছি। আমার নাম শান্তা। আমি টিএসসির পার্কে ঢোকার গেটে কাছে খাড়াইয়া থাকমু। আপনি আইসা নিয়া যান...।’ বলেই লাইনটা কেটে দিলো শান্তা। মোবাইলটা ফেরত দিয়ে পরীকে নিয়ে ঝটপট চলে এলো টিএসসির সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের গেটের কাছে।
লোকজন কম। প্রায় দুই ঘণ্টা পর একটা সাদা রঙের গাড়ি আসলো। গাড়ি থেকে কোনো ভাইয়া বা আপা নামলো না। ড্রাইভারটাই নেমে একদম সোজাসুজি তার কাছে চলে এলো। লোকটা প্রায় ধমকেই বললো, ‘এই শান্তা কার নাম?’
‘আমার নাম।’
‘দে মানিব্যাগটা, দে।’
শান্তা দিয়ে দিল। লোকটা চলেই গিয়েছিল। পরে ফিরে এসে ২০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললো, ‘তোরা থাকিস কই?’
সে দেখিয়ে দিল, উদ্যানের ভেতর।
‘সোজা হয়ে দাঁড়া। এইটা কে? তোর বোন? আচ্ছা দুবোন দাঁড়া।’
লোকটা একটা ছবি তুলে চলে গেল। এরকম অবশ্য অনেকেই ছবি তোলে তাদের। পরী অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন কথা বললো, ‘আপা, এই টাকা দিয়ে আমারে জামা কিন্না দাও।’
আজ তারা ইফতারও ভালো মতো করেনি। পরী কয়েকবার ক্ষুধার কথা বলেছে। গেটের দুই একটা দোকান মাখানো মুড়ি দিয়েছিল, সেসব খেয়েছে। এখন ২০ টাকা দিয়ে খাওয়ার জন্য তারা অমর একুশে হলের সামনে মাসুদ হোটেলে গেল। হোটেলের ছেলেগুলো অল্প পয়সায় তাদের ভাত, তরকারি দেয়। এগুলো অবশ্য এঁটো। তাতে কি! খাবার ভালো। শান্তা নিজ মনেই বলে।
ঈদের দিন ঘুম থেকে উঠেই কালী মন্দিরের পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলো তারা। কাল রাতে মাসুদ হোটেল থেকে ৩৫ টাকার খাবার কিনেছিল। খাবারটা একটু টক লাগছে। তরকারি মেশানো তো! আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত বুলবুলি, কালাচান, সাথীদের সাথে খেলেছে। শহীদ মিনারে মোটরসাইকেলে করে বেড়াতে আসা ভাইয়া আপাদের কাছে হাত পেতেছিল। গুণে দেখেছে মোট ৩৫ টাকা। ফুল বিক্রি থাকলে অবশ্য হাত পাততে হতো না। খাওয়ার সময় দেখলো একটা লোক তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। শান্তা চিনতে পারলো। মানিব্যাগ যাকে দিয়েছিল সেই লোকটা। লোকটা কাছে এসে প্রায় ধমকেই বললো, ‘এই তুই শান্তা না?’
‘হুম’
বলতেই পরী মুখে ভাত নিয়েই বললো, ‘আমি পরী।’
‘আচ্ছা, শোন, উঠে আয় দুজনেই।’
‘ক্যান?’
‘ক্যান, পরে শুনবি।’
লোকটার ধমকে দুজনই ভয় পেয়ে গেল। ভাতের পলিথিনটা রেখে ওরা ওভাবেই লোকটার পেছন পেছন উদ্যান থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়িটা দাঁড়ানো ছিল। একটা দরজা খুলেই বললো, ‘দুজনই উঠে পড়।’
পরী আনন্দেই আগে গিয়ে উঠে পড়লো। শান্তাও বাধ্য হয়ে উঠলো। গাড়ির ভেতর ঠান্ডা ঠান্ডা। এমন গাড়িতে কোনোদিনই তারা ওঠেনি। কিন্তু শান্তার ভয় ভয় লাগতে শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামলো। ড্রাইভার লোকটা ওদের নামিয়ে পেছন পেছন আসতে বললো। শান্তা পরীর হাত ধরে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, আজ ঈদের দিন কেউ মারবে না। কিন্তু যদি ওদের আটকে রাখে, পাচার করে দেয়? ওদের বান্ধবী জিনিয়াকে এইভাবে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আটকে রেখেছিল। ড্রাইভার লোকটার পেছন পেছন গিয়ে ওরা একটা লিফটে উঠলো। কয়েক মিনিট পর একটা গেটের সামনে লিফট থেমে গেল।
দরজায় বেল দিতেই খুলে গেল। হাসিমুখে শাড়িপরা একজন সুন্দর মতো মহিলা দরজা খুললো। পেছনে এলো পাঞ্জাবীপরা আরেকটা লোক। দুইজনকে চেনা চেনা মনে হচ্ছিল শান্তার। কিন্তু মনে করতে পারলো না। শান্তা-পরীর বয়সীই আরো দুইটা মেয়ে পেছনে চলে এলো। একদম ওদের বয়সী, কিন্তু ওরা অনেক ঝকঝকে, আর কী সুন্দর। লোকটা বললো, ‘নীহারিকা, বাচ্চা দুটোকে আগে খাবার দাও।’
ঘরের ভেতর ঢুকতেই ওদের সামনে সেমাই ফিরনি নানারকম সুস্বাদু খাবার চলে এলো। পরী বেশ আনন্দ নিয়ে খেতে শুরু করলো। কিন্তু শান্তা একটু চিন্তিত। খেতে খেতেই ওরা জানলো, শান্তার মতো বয়সী মেয়েটার নাম বিনতি, সে ক্লাস ফোরে পড়ে। আর ছোট ইনতি, এখনো স্কুলে যায় না।
খাওয়া শেষ হতেই শান্তা-পরীকে বাথরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কাজের মেয়েটা ডলে ডলে গোসল করালো। ওরা অবাক হলো, এভাবে ঝর্ণার মতো পানিতে কখনো গোসল করেনি। গোসল শেষ পরীর জন্য অপেক্ষা করছিল বিস্ময়। বিনতি-ইনতির মা নিয়ে এলেন জামার প্যাকেট। একটা পরীর জন্য, আরেকটা শান্তার জন্য। দ্রুত জামা পরে ফেলতে বললো।
পরীর খুশি আর ধরে না। সে জামা পরে বারবার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে যায়। আর শান্তা বিনতি-ইনতির মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। সে চিনতে পেরেছে, সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সামনে ইফতার আর মুরগির মাংস দিয়েছিল।