প্রতি রাতে স্টাইনবেক অনেক সময় নিয়ে ক্যাবিনেটের তালা লাগাতেন এবং চেয়ারে দাঁড়িয়ে, তার লম্বা দেহ নিয়ে চাবিটি উপরদিকে রাখতেন।
Published : 29 Nov 2024, 01:25 PM
সাহিত্যে নোবেল ও পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া আমেরিকান ঔপন্যাসিক জন স্টাইনবেক (১৯০২-১৯৬৮)। তিনি ‘অফ মাইস অ্যান্ড মেন’, ‘দ্য গ্রেপস অফ র্যাথ’ ও ‘ইস্ট অফ ইডেন’ এর মতো বিখ্যাত বইয়ের লেখক। স্টাইনবেক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পত্রিকায় যুদ্ধ-সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন এবং ১৯৬২ সালে পান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
ব্যক্তিজীবনে জন স্টাইনবেক দুই ছেলে-সন্তানের পিতা ছিলেন- টমাস স্টাইনবেক ও দ্বিতীয় জন স্টাইনবেক। এর মধ্যে টমাস স্টাইনবেক লেখক ও দ্বিতীয় জন স্টাইনবেক সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। একজন ঔপন্যাসিকের সন্তান হিসেবে কেমন ছিল তাদের ছোটবেলা? সেই গল্পই করছিলেন টমাস স্টাইনবেক, জানালেন পাঠাভ্যাস গড়তে তাদের লেখক পিতার কৌশলের কথা।
জন স্টাইনবেক একবার একটি নিচু ক্যাবিনেট কিনে সেখানে বই রেখে তালাবন্ধ করে রাখেন। কেউ যাতে বইগুলো পড়তে না পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়। তিনি তার সন্তানদের ডাকেন, সেই বইগুলো পড়লে ‘বিপদ হবে’ বলে ভয় দেখান। এভাবে তিনি প্রতিদিন রাতে ক্যাবিনেটে তালা লাগিয়ে তার চাবিটি আড়ালে রাখতেন।
ক্যাবিনেটটির সামনে একটি দরজা ছিল, তাতে লাগানো ছিল একটি পিতলের তালা। তালা লাগানো ও খোলার সময় বিকট শব্দ হতো। ক্যাবিনেটের দুই পাশে ছিল দুটি চেয়ার আর এটি দেখতে কোনো প্রাচীন মঠের দরজার মতো লাগত, প্রায় কারাগারের মতো। সেখানে মার্ক টোয়েন, টেলর কোলরিজ এবং এমন অনেক বিখ্যাত লেখকদের বই ছিল, যেগুলো তিনি মনে করতেন প্রত্যেকের বিশেষত তরুণদের পড়া উচিত।
প্রতি রাতে স্টাইনবেক অনেক সময় নিয়ে তালা লাগাতেন এবং চেয়ারে দাঁড়িয়ে, তার লম্বা দেহ নিয়ে চাবিটি উপরদিকে রাখতেন। টমাস স্টাইনবেক ও দ্বিতীয় জন স্টাইনবেক- দুই ভাইয়ের বয়স তখন আট অথবা নয় বছর। তারা প্রতি রাতে টর্চলাইট নিয়ে চুপিচুপি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসত। এক ভাই আরেক ভাইকে কাঁধে তুলত, চাবি নামাতো। সঙ্গে নিতো বালিশ, যেটা তালার উপর চেপে ধরে শব্দ আটকানোর চেষ্টা চলত। তারপর তালা খুলে দুই ভাই বই পড়তো প্রতি রাতে।
বাবা জন স্টাইনবেক তাদের বারবার ওই ক্যাবিনেটের বইগুলো পড়তে নিষেধ করতেন এবং বলতেন, এগুলো তাদের জানা উচিত নয়। কিন্তু তারা প্রতিদিন বই পড়ত এবং পড়ার পর ঠিক জায়গায় বইগুলো গুছিয়ে রাখত। দুই কৌতূহলী বালক এভাবে দুই বছরে সেই ক্যাবিনেটের সবগুলো বই পড়ে ফেলে।
একদিন কিন্তু দুই ভাই ধরা পড়ে যায় বাবার কাছে। তবে বই পড়ার সময় নয়। কিছু বছর পর, জন স্টাইনবেক একটি ডিনার পার্টি দেন। কথা প্রসঙ্গে আলোচনা ঘুরে যায় কিছু অদ্ভুত লেখকের দিকে। সেই লেখকরা সাধারণত মানুষের মাঝে পরিচিত ছিলেন না এবং স্কুলেও তাদের পড়ানো হতো না। আলোচনায় এলো জর্জ ফারকুয়ার নামে এক আইরিশ নাট্যকারের কথা, যিনি ছিলেন একজন রম্যলেখক।
টমাস স্টাইনবেক ফারকুয়ারের বিষয়ে কিছু মন্তব্য করল। বাবা জন স্টাইনবেক শুনে বললেন, “তুমি ফারকুয়ার সম্পর্কে কীভাবে জানো? স্কুলে তো ফারকুয়ার পড়ানো হয় না!” টমাস বলল, “ওহ, এখানে কোথাও একটা বই ছিল, মনে হয়।”
বাবা জানতেন ঠিক কোথায় সেই বই। তিনি সেটি তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন, তাই না? ঔপন্যাসিক বাবা তার সন্তানকে একদৃষ্টিতে দেখলেন, এবং সন্তান হঠাৎ বুঝতে পারল সে ধরা পড়ে গেছে। কারণ তার মনে পড়ল যে ফারকুয়ারের বই সে কোথা থেকে পেয়েছিল। সেটা ছিল ওই ক্যাবিনেটের ভেতর!
টেবিলে থাকা বাকি আটজনের দিকে না তাকিয়ে বাবা এবার রসিকতা করে বললেন, “শোনো ছেলে, যদি তুমি ওই তালাটায় একটু তেল দিতে, তাহলে আমরা অনেক বেশি ঘুমাতে পারতাম।” খাওয়ার টেবিলে উপস্থিত দুই ছেলের মুখে সেইসব লেখকদের কথা শুনে তার বাবা বুঝতে পারেন তার সন্তানরা সেই ক্যাবিনেটের সবগুলো বই বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়েছে।
জন স্টাইনবেকের একটি উক্তি, “কিছু মানুষ আছেন, যারা বড় হয়ে বই পড়ার মতো কাজটিকে ভুলে যান। এটি সম্ভবত মানুষের সবচেয়ে বড় একক প্রচেষ্টা, যা তাকে শৈশবেই করতে হয়।”