অনূদিত গল্প
বিংশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত কবি টেড হিউস (১৯৩০-১৯৯৮)।
Published : 29 Jan 2025, 01:26 AM
বিংশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত কবি টেড হিউস (১৯৩০-১৯৯৮)। তার জন্ম ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে। ১৯৫১ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার জন্য ভর্তি হন হিউস। সেখানেই তার পরিচয় হয় আমেরিকান কবি সিলভিয়া প্লাথের (১৯৩২-১৯৬৩) সঙ্গে। ১৯৫৬ সালে তারা বিয়ে করেন।
হিউসের প্রথম কবিতাবই ‘দ্য হক ইন দ্য রেইন’ পরের বছর প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে নানা অস্থিরতার মধ্যেও হিউস একটানা লিখে গেছেন। তার উল্লেখযোগ্য সংকলনগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘লুপারক্যাল’ (১৯৬০), ‘ক্রো’ (১৯৭০), ‘গাউডেট’ (১৯৭৭), ‘রিমেইনস অফ এলমেট’ (১৯৭৯), ‘রিভার’ (১৯৮৩), ‘ক্যাপ্রিচিও’ (১৯৯০) এবং ‘বার্থডে লেটারস’ (১৯৯৮)।
হিউস কবিতার বাইরেও নাটক, ছোটগল্প, সাহিত্য সমালোচনা, অনুবাদ ও শিশুদের জন্য রচনায় দক্ষ ছিলেন। তার শিশুতোষ রচনার মধ্যে অন্যতম ‘দ্য আয়রন ম্যান’ (১৯৬৮)। সৃজনশীল লেখালেখির সহায়ক তার ‘পোয়েট্রি ইন দ্য মেকিং’ (১৯৬৭) বইটি আজও শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বই।
১৯৮৪ সালে টেড হিউস ইংল্যান্ডের পোয়েট লরিয়েট নিযুক্ত হন। ১৯৯৮ সালে ৬৮ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।
কোন এক মহান শিল্পীর একটি ছোট বাগান ছিল। এ বাগানে তিনি গাজর, পেঁয়াজ, মটরশুঁটি এবং যা কিছু তার খাওয়ার জন্য প্রয়োজন, তা চাষ করতেন। বাগানটি ছোট, কিন্তু সুন্দর। পরিপাটি সারি সারি গাছপালা, বুনো পশুরা যেন ঢুকে না পড়ে লন্ডভন্ড করে দেয়, তাই চারপাশে বেড়া দেওয়া। মহান শিল্পী তার বাগান নিয়ে সত্যি খুশি।
একদিন তিনি গাজরের ক্ষেত পরিচর্যা করতে গিয়ে সারির মাঝে একটি অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেলেন। লম্বায় এক ইঞ্চিরও কম, কালো রঙের চকচকে মটরশুঁটির মতো। একপ্রান্তে ছোট শিকড় মাটিতে গেঁথে আছে। বাহ, অদ্ভুত তো! মহান শিল্পী বললেন, এমন সবজি তো আগে কখনো দেখিনি। জানি না, এটা কী হবে! আগাছা ভেবে উপড়ে না ফেলে মহান শিল্পী এটিকে আগের মতোই মাটি দিয়ে ঢেকে দিলেন।
পরের দিন, যখন মহান শিল্পী বাগানে কাজ করছিলেন, সেই ছোট চকচকে কালো রঙের সবজির কথা মনে পড়ল তার। তিনি দেখতে গেলেন, এটি কেমন বড় হয়েছে। মহান শিল্পী অবাক হলেন। এক রাতে তার আকার দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। এখন লম্বায় দুই ইঞ্চি লম্বা, যেন চকচকে কালো রঙের ডিম। এভাবে প্রতিদিন মহান শিল্পী সেটি দেখতে যেতে লাগলেন, এবং প্রতিদিন এটি বড় হয়। প্রতিদিন সকালে এটি গতকালের চেয়ে ঠিক দ্বিগুণ লম্বা হয়ে ওঠে। এভাবে যখন এটি ছয় ফুট লম্বা হলো, মহান শিল্পী বললেন, এটা খুব বড় হয়ে গেছে। এখন এটি তুলে রান্না করে খাওয়া যায়।
কিন্তু তিনি আরও একদিন অপেক্ষা করলেন। পরদিন এটি বারো ফুট লম্বা হয়ে গেলো এবং মহান শিল্পীর এমন কোনো ঝুড়ি ছিল না যাতে এটি আর ঢুকে! মহান শিল্পী মাথা চুলকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। ইতিমধ্যে এটি তার আশপাশের বেশিরভাগ গাজর চাপা দিয়ে ফেলেছে। যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তবে খুব শীঘ্রই এটি তার ঘরও চাপা দিয়ে ফেলবে।
মহান শিল্পী যখন হা হয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন, হঠাৎ এটি এক চোখ খুলে তাকাল। মহান শিল্পী অবাক হলেন। চোখটি বেশ ছোট ও গোল। সবচেয়ে মোটা প্রান্তের কাছাকাছি এবং শিকড় থেকে অনেক দূরে। মহান শিল্পী অন্যপাশে গিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, সেখানেও তার আরেকটি চোখ। এটিও তাকে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে। ওহ! মহান শিল্পী বললেন, তুমি কেমন আছো? গোল চোখটি মুচকি হেসে উঠল, তার নিচের মসৃণ চকচকে ত্বক সামান্য কুঁচকে উঠল, যেন কিছু একটা হাসছে। কিন্তু এর কোন মুখ নেই। মহান শিল্পী নিশ্চিত হতে পারলেন না, এটা আসলে কী?
পরের সকালে মহান শিল্পী তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলেন আর তার প্রিয় বাগানে গেলেন। সত্যি, রাতের মধ্যে তার নতুন কালো চোখওয়ালা গাছটি আবার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এটি তার বেড়ার একটি অংশ ভেঙে ফেলেছে, মাথাটি রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। একটি চোখ রাস্তার ওপর তাকিয়ে আছে আর অন্যটি নিচে। তার পাশটি রান্নাঘরের দেয়ালে চাপা পড়ে আছে। মহান শিল্পী গাছটির সামনের দিকে গিয়ে তার চোখের দিকে তাকালেন। তুমি খুব বড় হয়ে গেছ, তিনি কঠোরভাবে বললেন। দয়া করে বড় হওয়া বন্ধ করো, নইলে তুমি আমার বাড়ি ভেঙে ফেলবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এবার গাছটি একটি মুখ খুলল। লম্বা চেরা মুখ, চোখ দুটির নিচে দুপাশে চলে গেছে।
আমি পারবো না, মুখটি বলল। এমন উত্তর শুনে মহান শিল্পী কিছুই বলতে পারলেন না। অবশেষে বললেন, ঠিক আছে, তাহলে বলো তো তুমি কী ধরনের জিনিস? তুমি কি তা জানো? আমি! জিনিসটি বলল, আমি হলাম তিমিগাছ। তুমি তো ডিমগাছ, ঢেমশিগাছ আর তারাফুলগাছ সম্পর্কে শুনেছ। তো, আমি হলাম তিমিগাছ। এমন উত্তর শুনে মহান শিল্পী আর কিছুই বলতে পারলেন না। পরের সকালে দেখা গেল, তিমিগাছ পুরো রাস্তাটা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তার পাশটি রান্নাঘরের দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। এখন তার আকার একটি বাসের চেয়েও লম্বা ও মোটা।
মহান শিল্পী এটি দেখে সব পশু-পাখিকে ডাকলেন। বললেন, এটা তো অদ্ভুত একটা জিনিস। একবার দেখো তো, আমরা এটা দিয়ে কী করব? প্রাণীরা তিমিগাছটির চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকাল। তার চামড়া এতটাই চকচকে যে প্রাণীরা তাতে নিজেদের মুখ দেখতে পেল। এটাকে ছেড়ে দাও, উটপাখি পরামর্শ দিল। আর অপেক্ষা কর, কখন মরে যায়। কিন্তু এটা তো বাড়তেই থাকবে, মহান শিল্পী বললেন। যতক্ষণ না এটি পুরো পৃথিবী ঢেকে দেয়। তখন আমাদের এর পিঠে বসবাস করতে হবে। একবার ভেবে দেখো।
আমার প্রস্তাব হলো…। কিছু একটা বলার জন্য ইঁদুর এগিয়ে এলো, আমরা বরং এটাকে সাগরে ফেলে দিই! মহান শিল্পী চিন্তায় পড়ে গেলেন। না, নীরবতা ভেঙে তিনি শেষমেশ বললেন। এটা খুব নির্দয় কাজ হবে। চল, কিছুদিনের জন্য এটাকে ছেড়ে দিই। তিনদিন পর মহান শিল্পীর বাড়ি পুরোপুরি ভেঙে পড়ল, আর তিমিগাছ একটি রাস্তার মতো লম্বা হয়ে গেল। এখন! ইঁদুর বলল, দেরি হয়ে গেল, এটাকে সাগরেই ফেলা উচিত ছিল। তিমিগাছ এত বড় যে ওটাকে সরানো এখন অসম্ভব।
কিন্তু মহান শিল্পী তার চারপাশে লম্বা পুরু দড়ি জড়ালেন এবং সব প্রাণীকে ডেকে দড়ির প্রান্তগুলো টানতে বললেন। আরেএএএ! চিৎকার করে উঠল তিমিগাছ, আমাকে ছেড়ে দাও। তোমাকে সাগরে ফেলছি, বলল ইঁদুর। এটাই তোমার প্রাপ্য। এত জায়গা দখল করে আছ! কিন্তু আমি এখানেই ভালো আছি! আবার চিৎকার করল তিমিগাছ। আমি এখানে শুয়ে থাকতে আর ঘুমাতে ভালোবাসি। আমাকে ছেড়ে দাও। সাগরে!, চিৎকার করল ইঁদুর। না! চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল তিমিগাছ। সাগরে! সব প্রাণী একসঙ্গে চিৎকার করল। আর দড়ি টানতে শুরু করল।
এক বিশাল গর্জনে তিমিগাছের শিকড় মাটি থেকে বেরিয়ে এলো। মারাত্মকভাবে মোচড়াতে আর ঘুরতে লাগল, শিকড় দিয়ে বাড়িঘর আর গাছপালা ভেঙে ফেলল। আর প্রাণীরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তারা তাকে একটি উঁচু খাদের চূড়োয় নিয়ে এলো। এক বিশাল চিৎকার দিয়ে তারা তাকে খাদ থেকে গড়িয়ে সাগরে ফেলে দিল। বাঁচাও! বাঁচাও! চিৎকার করল তিমিগাছ। আমি ডুবে যাব! দয়া করে আমাকে আবার মাটিতে আসতে দাও, যেখানে আমি ঘুমাতে পারি! মহান শিল্পী চেঁচিয়ে জবাব দিল, তোমার আকার ছোট না হওয়া পর্যন্ত নয়! তখন তুমি ফিরে আসতে পারবে।
কিন্তু আমি কীভাবে ছোট হবো? কাঁদতে কাঁদতে বলল তিমিগাছ। সাগরের জলে দুলে দুলে বলল, দয়া করে আমাকে দেখাও কীভাবে ছোট হবো, যাতে আমি মাটিতে বাস করতে পারি! মহান শিল্পী এবার উঁচু খাদের উপর থেকে নেমে এলেন এবং তিমিগাছের মাথার ওপর তার আঙুল দিয়ে একটি ঠোক্কর দিলেন। আহ্! চিৎকার করল তিমিগাছ। এটার মানে কী? তুমি আমার মাথায় একটা ছিদ্র করে দিয়েছ। এর মধ্য দিয়ে তো পানি ঢুকবে! না, তা হবে না, বললেন মহান শিল্পী। কিন্তু তোমার কিছু অংশ এর মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসবে। এখন তুমি এই ছিদ্র দিয়ে তোমার কিছু অংশ বের করতে শুরু করো। তিমিগাছ তার শ্বাস ছাড়ল, আর সেই ছিদ্র দিয়ে পানির ফোয়ারার মতো একটি উঁচু ফিনকি বেরিয়ে এলো। এখন ফুঁ দাও, চালিয়ে যাও, বললেন মহান শিল্পী।
তিমিগাছ ফুঁ দিতে লাগল। ফুঁ দিতে দিতে ধীরে ধীরে ছোট হতে লাগল। যেমনই সে ছোট হতে লাগল, তার মসৃণ ও চকচকে ত্বক ভাঁজে ভাঁজে আবৃত হয়ে গেল। অবশেষে মহান শিল্পী তাকে বললেন, যখন তুমি একটি শসার মতো ছোট হবে, আমাকে জানাবে। তখন তুমি আবার আমার বাগানে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু তার আগে তোমাকে সাগরেই থাকতে হবে।
মহান শিল্পী তার সব পশু-প্রাণীদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন, আর তিমিগাছ সাগরের মধ্যে গড়িয়ে পড়ে ফুঁ দিতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিমিগাছ একটি বাসের আকারে ছোট হয়ে গেল। কিন্তু ফুঁ দেওয়া ছিল খুব কষ্টকর, আর এবার তার ঘুমের ইচ্ছা হলো। সে একটি গভীর শ্বাস নিয়ে সাগরের তলদেশে ঘুমাতে গেল। কারণ তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ হলো ঘুমানো। যখন সে জাগল, একটি হতাশার গর্জন দিল। ঘুমানোর সময় সে আবার একটি রাস্তার মতো লম্বা এবং একটি বড় জাহাজের মতো মোটা হয়ে গিয়েছে। সে যত দ্রুত সম্ভব সাগরের উপরে উঠে এলো এবং ফুঁ দিতে শুরু করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে একটি ট্রাকের মতো ছোট হয়ে গেল। কিন্তু আবার, খুব দ্রুত তার ঘুমানোর ইচ্ছা হলো। সে একটি গভীর শ্বাস নিয়ে সাগরের তলদেশে ডুবে ঘুমাতে গেল। জেগে উঠলে দেখা গেল, সে আবার একটি রাস্তার মতো লম্বা হয়ে গেছে। এভাবে অনেক বছর ধরে চলতে থাকল। আজও তা চলছেই। তিমিগাছ যত দ্রুত ফুঁ দিয়ে ছোট হয়, তত দ্রুত ঘুমিয়ে বড় হয়। কখনো কখনো, যখন সে খুব শক্তিশালী অনুভব করে, তখন সে নিজেকে একটি গাড়ির আকারে ছোট করতে পারে। কিন্তু সবসময়, শসার আকারে ছোট হওয়ার আগেই, তার মনে পড়ে যায় ঘুমানোর আনন্দ। আর ঘুম থেকে উঠে সে আবার বড় হয়ে যায়।
তিমিগাছ খুব চায়, মাটিতে ফিরে এসে সূর্যের আলোতে শুয়ে থাকবে, আর তার শিকড় মাটির ভেতরে পুঁতে রাখবে। কিন্তু তার বদলে কিনা তাকে সাগরের মধ্যে গড়াতে ও ফুঁ দিতে হয়। আর যতদিন সে মাটিতে ফিরে আসার অনুমতি পাবে না, বাকি সব প্রাণীরা তাকে শুধু ‘তিমি’ বলেই ডাকবে।