ভ্রমণপ্রিয় কয়েকজন দুরন্ত কিশোর সুন্দরবনে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে। পথ খুঁজতে খুঁজতে গহনবনে নিজেরাও একসময় হারিয়ে যায়।
Published : 26 Apr 2025, 02:47 PM
চার বন্ধু যখন এই অবস্থায় আটকে আছে, তখন তাদের বাড়িতে ও শরণখোলা থানায় অপেক্ষারত আত্মীয় পরিজন সন্তানের জন্য বুক ভরা হাহাকার নিয়ে কাতরাচ্ছে। কারও মা বুক চাপড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছে তো কারও মা মাথায় হাত দিয়ে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে নীরবে অশ্রু ফেলছেন। দাদি-চাচি বা দাদা-চাচাদের অবস্থাও প্রায় একই রকম। এরই মধ্যে আদনান ও মিঠুর মা দু-একবার জ্ঞান হারিয়েছিলেন। পাড়া-প্রতিবেশিরা সান্ত্বনা দিতে এসে তারাও ছেলেদের উদ্ধারের চিন্তায় এবং মা, চাচি ও দাদিদের অবস্থা দেখে, অশ্রু ধরে রাখতে পারছেন না।
ঈদের দিনের আনন্দ খুশি হঠাৎ কেমন নিরানন্দ ও বিষাদে ছেয়ে গেছে। উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ নিয়ে যে যার মতো করে চার কিশোরের খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের উদ্ধার অভিযানের অগ্রগতি কতদূর তা জানতে চাচ্ছেন। তাদের সাথে যোগাযোগের স্থাপন করার জন্য বারবার তাদের নিয়ে যাওয়া মোবাইলে কল করে যাচ্ছেন।
অনেকক্ষণ ধরে জিসান গাছে চড়ে ডাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত-পা ব্যথা করছে। কিন্তু কোনো ফোন আসছে না। সে-ও আর ওই অচেনা নম্বরে বা চেনা নম্বরের কারও সাথেই কোনো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে না। বারবারের এমন চেষ্টায় মোবাইলের চার্জও কমে এসেছে। ব্যাটারির পাশে ছোট্ট করে লেখা ভেসে আছে ‘৫০%’। নিচে থাকা বন্ধুদের সেসব কথা জানাতেই ইমরান বলে- ‘আচ্ছা তুই নেমে আয়’।
ইমরানের কথা মতো জিসান নামতে শুরু করে। তখন হঠাৎ আদনানের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। একদম অপ্রত্যাশিত শব্দে কয়েক মুহূর্তের জন্য চারজন যার যার জায়গায় স্থির হয়ে যায়। কারও কারও বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। আচমকা চমকে আদনান, পকেট থেকে ফোন বের করে কলটা রিসিভ করার কথাও যেন ভুলে যায়। সে সময় আরও চমক নিয়ে মিঠুই প্রথম কথা বলে ওঠে- ‘আরে আদনান তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ কর, কেটে যাবে তো!’
মিঠুর কথায় আদনান সচল হয়ে ওঠে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে অপরিচিত নম্বরটা এক পলক দেখেই তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করে। তারপর লাউড স্পিকার অন করতেই সবাই ওপাশের কণ্ঠ শুনতে পায়-
- হ্যালো আদনান, আমি শরণখোলা থানার ওসি বলছি। তোমরা সবাই ঠিক আছো?
- জি আংকেল, আমরা সবাই ভালো আছি।
- তোমরা এখন কোথায় আছো তা কি বলতে পারবে?
- জি-না আংকেল। আমরা অনেক হেঁটেও পথ খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি।
- ওকে। আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো, ভয়ের কিছু নেই। তোমরা চারজন একসাথেই থাকবে এবং একই জায়গায় থাকবে। আর হাঁটাহাঁটি না করে কোনো একটা বড়ো গাছে চড়ে বসে থাকো। আমরা তোমাদের নিতে আসতেছি। ওইদিকে বা... আ...
- হ্যালো আংকেল... হ্যালো ...
কথা শেষ হওয়ার আগেই লাইন কেটে যায়। পরিচিত জগতের সাথে আবারও চার বন্ধু সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আদনান নম্বরটা ডায়াল করে আবারও সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করে। কিন্তু আর কল যায় না। মোবাইল আবারও আউট অব নেটওয়ার্ক হয়ে যায়। তবে চার বন্ধু আশ্বস্ত হয়, ভরসা পায়। পুলিশ তাদের উদ্ধার করতে আসছে। আদনান আর ওসি সাহেবের কথোপকথনের মাঝেই জিসান গাছ থেকে নেমে এসেছিল। ‘জরুরি পরিষেবার ৯৯৯ নম্বরে কল দেওয়াটা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে’ -বলে জিসান খুশিতে আদনানের পিঠ চাপড়ে দেয়। জিসানের সাথে ইমরান এবং মিঠুও যোগ দেয়। তারপর পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে থাকে। খুশিতে ডগমগ হয়ে থাকে। কিন্তু আদনান বেশিক্ষণ সে খুশি ধরে রাখতে পারে না। কল কাটার পর থেকেই ওসি সাহেবের কথাগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, কয়েকবার করে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। একটা লুপ হয়ে বেজে যাচ্ছে। হঠাৎ আদনান ভয়ে শিউরে ওঠে, তার গায়ে কাঁটা দেয়।
এতক্ষণে ওসি সাহেবের সবগুলো কথা তার কাছে অর্থবোধক হয়ে ওঠে। এমনকি শেষের না শুনতে পাওয়া কথাগুলোও পূর্ণাঙ্গ হয়ে ধরা দিতে থাকে। আদনান মুহূর্তে চঞ্চল ও অস্থির হয়ে পড়ে। সাথে সাথে সে তার তিন বন্ধুকে থামিয়ে দিয়ে বলে- ‘তোরা এত খুশি হওয়া থামা। আমরা অনেক বিপদজ্জনক জায়গায় আছি। তাড়াতাড়ি বড়ো ও উঁচু দেখে একটা গাছে উঠে পড় সবাই। আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না’। কথা শেষ করেই আদনান আশপাশে বড় গাছ খুঁজতে শুরু করে। পেয়েও যায় একটা। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়েই সে দৌড়ে গাছে উঠতে শুরু করে। বাকিরা প্রশ্নবোধক চেহারা নিয়ে পরস্পরের দিয়ে একবার তাকিয়েই আদনানের পিছু নেয়।
চারজন একই গাছে চড়ে বসে। তারপর আদনান নিজে যা যা বুঝতে পেরেছে সেটা বাকিদের বুঝিয়ে বলে- ‘দেখ ওসি সাহেব আমাদের চারজনকে একটা বড় গাছে চড়ে বসতে বলেছেন। আর এই কথা বলার কারণ হলো, আমরা এখন যেখানে আছি এইদিকে বাঘ আছে। শেষের বাক্যে উনি এটাই বলতে চেয়েছিলেন বলে আমার মনে হচ্ছে’।
আদনানের ব্যাখ্যা বাকিরা নাকচ করতে পারে না। তাদেরও তাই মনে হয়। চিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্দি বাঘ দেখে যারা আনন্দে নেচে উঠেছিল, সত্যি সত্যি বনে বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে শুনে তারা খুশি হতে পারে না। একটা বাঘ রাজকীয় ভঙ্গিতে তাদের চোখের সামনে হেঁটে বেড়াচ্ছে, কল্পনা করতেই ভয়ে তাদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার মতো অবস্থা হয়। তার সাথে যুক্ত হয় আকাশে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমক ও মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে এবং মিঠু আবারও কান্না জুড়ে দেয়।
কিশোরদলের অবস্থান অনুমান করে পুলিশের দুটি দল পরিকল্পনা মতো দুদিক থেকে এগিয়ে চলে। রাতেরবেলা সুন্দরবনে প্রবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি তারা নিয়ে নিয়েছে। প্রতি দলের সাথে আছে মাথায় লাগিয়ে হাঁটার মতো হেড লাইট, সার্চলাইট, প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামসহ ফাস্ট এইড বক্স, লাঠি, ছুরি, রেইনকোট, একটা হ্যান্ড মাইক ও অন্যান্য কিছু দরকারি জিনিসপত্র। পায়ে গামবুট ও পুলিশদের প্রত্যেকের হাতে ফুল-লোডেড গান। কিন্তু এটাও কথা হয়ে আছে যে, জীবন একান্তই সঙ্কটাপন্ন না হলে তারা কেউ বন্দুক ব্যবহার করবে না। রাত বেড়ে চলে, কিশোরদের উদ্ধার অভিযানে দুটি দল এগিয়ে চলে। শরণখোলা থানার ওসি সাহেবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে নদী পথে এগিয়ে চলে নৌপুলিশের দলটিও।
দল দুটি তখনও বনের ভেতরে প্রবেশ করেনি। কিশোরদের অবস্থান কোথায়-কোনদিকে-কতদূর তার একটা হিসাব-নিকাশ না করে, অন্ধকারে ঘন গহনবনে প্রবেশ করা ঠিক হবে না। কিশোরদের গ্রামের বাড়ি অনুযায়ী আগেই ধারণা করা হয়েছে, তারা ধানসাগর এলাকা দিয়েই বনে প্রবেশ করেছে। আর তাদের মোবাইল ফোন যেহেতু প্রথমবার চাঁদপাই রেঞ্জের নেটওয়ার্ক টাওয়ারে যুক্ত ছিল, সে হিসেবে ধরে নেওয়া যায় তারা বনের ভাটির দিকে বা নিচের দিকে গিয়ে থাকতে পারে। এই অনুমান অনুসারে ওসি সাহেবের নেতৃত্বে থাকা দলটি শরণখোলা থানা থেকে ধানসাগরের পাশ দিয়ে গুশখালি ফরেস্ট অফিস হয়ে ভাটির দিকে বা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলে। আর ডিউটি অফিসারের নেতৃত্বে থাকা দলটি শরণখোলা ফরেস্ট অফিসের পাশ দিয়ে ভোলা ফরেস্ট অফিস কাটিয়ে সোনাতলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
কিশোরদের পক্ষে ঘুটার খাল ও মতের খাল পার হয়ে চাঁদপাই রেঞ্জ ফরেস্ট অফিসের দিকে যাওয়া সম্ভব নয় বলে ধরে নেওয়া হয়। তারপর দক্ষিণ দিকে বা নিচের দিকে নেমে গেলে সেলা নদী ও বেতমোর গাঙ। সেগুলো পার হয়ে বনের পশ্চিম দিকে হারবাড়িয়া বা চরপুটিয়ার দিকেও যেতে পারবে না। এভাবেই সুন্দরবনের একাংশের ভৌগোলিক সীমারেখা অনুযায়ী কিশোরদলের সম্ভাব্য অবস্থানের একটি অংশ নির্ধারিত হয়।
কিন্তু নির্ধারিত অংশটিও এক বিশাল এলাকা। এত বড়ো ঘন গহন বিপদ সংকুল বন এলাকায় চার কিশোরকে খোঁজা, ঠিক খড়ের গাধায় সুই খোঁজার মতোই ব্যাপার। তবু শরণখোলা থানার পুলিশরা কিশোরদের উদ্ধারে মরণপণ অভিযানে এগিয়ে যেতে থাকে। আর চেষ্টা করতে থাকে মোবাইল ফোনে তাদের সাথে পুনরায় ইথারীয় যোগাযোগ স্থাপন করার। কিন্তু সম্ভব হয় না।
চলবে...