ভ্রমণ কাহিনি
চারদিকে ধূসর মাইলের পর মাইল চারণভূমি। কোথাও গরু আবার কোথাও ভেড়ার পাল। মাঝে মাঝে অনেক ঘোড়া দেখা যায় মাঠে একাগ্রচিত্তে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে।
Published : 18 Sep 2024, 03:30 PM
গবেষণার তাগিদে আমি ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র দ্বীপরাজ্য তাসমানিয়ার রাজধানী হোবার্টে আসি। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল বাতাস ও দূষণমুক্ত আবহাওয়া গোটা তাসমানিয়া রাজ্যকে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে করেছে আরও আকর্ষণীয়। গবেষণা ও দৈনন্দিন কাজ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার গণ্ডিতেই।
এর কারণ, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা শিক্ষার্থীদের ছুটি বছরে মাত্র চার সপ্তাহ, যা মাতৃভূমি বাংলাদেশে কাটানোর জন্য সযত্নে রাখা হয়। তা বাদে সরকারি ছুটি বছরে কমবেশি ১০-১৫ দিনের মত, যা আবার অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যগুলোর স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। হোবার্টে ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার পাশেই একটি ছোট্ট স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে আমি আর আমার সহধর্মিণী বসবাস করি। মাসখানেক আগে বাসাবাড়ি বদলে তার ধকল সামলে গত সপ্তাহে ঘুরে আসলাম তাসমানিয়ার ছোট্ট একটি ব্রুনি দ্বীপে।
হোবার্ট শহর থেকে ব্রুনি দ্বীপের দূরত্ব মোটামুটি ৮৫ কিলোমিটারের মত। আর পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে হলে পাড়ি দিতে হবে আরো প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ। দূরত্ব বেশি না হওয়ায় দিনে গিয়ে দিনেই ফিরব বলে আমরা পরিকল্পনা করলাম। তাসমানিয়া দক্ষিণ গোলার্ধের দ্বীপ, এখন ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে গ্রীষ্মের প্রায় শেষভাগ। তাসমানিয়াকে অনেকে ‘অনিশ্চিত আবহাওয়ার’ দ্বীপ বলেন। ব্রুনি দ্বীপে খুব কম বসতি, প্রায় ১.৬ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। লোকালয় অনেক কম হাওয়াতে দোকানপাট ও রেস্তোরাঁ বেশি নেই। যথেষ্ট গাড়ির জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস আমরা আগেই নিয়ে নিলাম।
হোবার্ট থেকে সাউদার্ন আউটলেট মহাসড়ক হয়ে গাড়ি ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে শুরু করল। এখানকার রাস্তাগুলো অনেক প্রশস্ত হলেও গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা তুলনামূলক কম। যার মূল কারণ হল, পাহাড়ি রাস্তা আর তীক্ষ্ণ বাঁক। কোথাও পাথরের পাহাড় কেটে বা কোথাও ছোট ছোট সেতু বানিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। দেখলেই বোঝা যায়, অস্ট্রেলিয়ানরা পরিবেশের যত কম ক্ষতি করে অবকাঠামো তৈরি করা যায় তার দিকেই তাদের বেশি লক্ষ্য।
আমরা কিংবরা সিটি কাউন্সিলের কিংসটন শহর হয়ে চ্যানেল হাইওয়েতে উঠলাম। দুই লেনের আঁকাবাঁকা রাস্তা যার দুই পাশে সাদা দাগ জানিয়ে দিয়েছে নিজের গতিপথ। চারদিকে ধূসর মাইলের পর মাইল চারণভূমি। কোথাও গরু, আবার কোথাও ভেড়ার পাল। মাঝে মাঝে অনেক ঘোড়া দেখা যায় মাঠে একাগ্রচিত্তে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। গাড়ির গতি এখন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটারের মত। রাস্তার পাশে কিছু দূর পরপর রাখা হাতেলেখা কিছু সাইনবোর্ড চোখে পড়লো, আলগা করে মাটিতে রাখা বা অস্থায়ী কিছুর সঙ্গে আলতো করে বাঁধা।
সাইনবোর্ডের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী এক কিলোমিটার পরই তাজা ফলের দোকান। তাসমানিয়াতে রাস্তার পাশে এরকম ফলের দোকান অনেক। স্থানীয় কৃষকরা নিজেদের চাষ করা এই সতেজ ফলগুলো নিজেরাই বিক্রি করেন। এরকমই একটি ফলের দোকানে আমরা আমাদের স্বল্প যাত্রা বিরতি করলাম। দোকানে বিভিন্ন প্রজাতির আপেল, কমলা, পাম ফল, আঙুর, চেরি ও এপ্রিকটসহ প্রায় সবই পাওয়া গেল।
মারগেট নামে একটি ছোট্ট শহরে এসে পৌঁছলাম। হোবার্ট শহর যে ডারওয়েন্ট নদীর তীরে অবস্থিত, তারই আরেকটি চ্যানেলে মারগেট শহর। ব্রিটিশরা মারগেটের ডারওয়েন্ট নদীর তীর কয়লা আমদানির কাজে ব্যবহার করত আঠারশ শতকের দিকে। এখন অনেকটা ছিমছাম ছোট্ট শহর। চ্যানেল হাইওয়ের একপাশে তাসমানিয়ার ছোট ছোট জনপথ ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর অন্যপাশে ডারওয়েন্ট নদীর চ্যানেল। ফ্রেঞ্চ ভাইস অ্যাডমিরাল ব্রুনি ডি’এন্ট্রেকাস্ট ১৭৯২ সালে এ চ্যানেলটি আবিষ্কার করেন। তার নাম অনুসারেই এই চ্যানেলের নামকরণ হয়েছে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে রাস্তার দুই পাশে মোটামুটি ৪ ফুট উচ্চতার তারের বেড়া দেওয়া আছে, মূল রাস্তা থেকে প্রায় ১৫ ফুট দূরে, যেন বন্যপ্রাণী হঠাৎ না চলে আসে। যদিও রাতে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ওয়ালাবি ও ক্যাঙ্গারুসহ অনেক প্রাণীই রাস্তাই চলে আসে এবং গাড়ির ধাক্কায় আহত বা নিহত হয়। গড়ে প্রতি এক কিলোমিটারের মধ্যে ৪-৬টি এরকম বন্যপ্রাণীর দেহাবশেষ চোখে পড়লো। যদিও এই সংখ্যা কোন কোন রাস্তায় আরও বেশি। আমরা পৌঁছে গেলাম কেটেরিং নামক আরেকটি ছোট বন্দর শহরে। এখান থেকেই আমরা আমাদের গাড়িসহ একটি ফেরিতে উঠবো।
একটি মাত্র জেটি থেকে ৩০ মিনিট পর পর ফেরিগুলো ব্রুনি দ্বীপের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আমি জীবনে এই প্রথম গাড়ি চালিয়ে এত উচ্চতার ফেরিতে উঠলাম। একটু পরই ফেরি চলতে শুরু করল তাসমান সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত ডি’এন্ট্রেকাস্ট চ্যানেল দিয়ে প্রায় ২৫ নট গতিতে। ব্রুনি দ্বীপে নেমেই আমরা যাত্রা শুরু করলাম ‘দ্য নেক’ এর উদ্দেশ্যে। ব্রুনি দ্বীপবাসীর প্রধান আয় হল পর্যটন খাত। কিছু কিছু জায়গায় একতলা হোটেল আছে। যারা অনেক সময় নিয়ে দূর থেকে বেড়াতে আসেন তারা মূলত এই হোটেলগুলো বেছে নেন।
সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুক ও লবস্টারসহ নানা ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এখানকার প্রায় সব রেস্তোরাঁতেই। পথে অনেক মোটরহোম, ক্যাম্পারভ্যান ও ক্যারাভান দেখা গেল। কয়েক সপ্তাহ থেকে শুরু করে মাসের জন্য যারা বেড়াতে আসেন তারা পরিবারসহ থাকার জন্য এরকম বাহন ভাড়া নেন। এগুলোর মধ্যে রান্না, খাওয়া, গোসল ও ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। কিছু কিছু নির্দিষ্ট স্থানে ক্যাম্পিং এরিয়াতে পার্কিং করে রাখা যায়। সেখানে ক্যাম্পারদের জন্য টয়লেট, পানি ও গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করার ব্যবস্থাও আছে।
আমরা ‘দ্য নেক’-এ পৌঁছে গেলাম। ‘দ্য নেক’ হল ডি’এন্ট্রেকাস্ট চ্যানেল আর তাসমান সাগরের মধ্যে অবস্থিত সবচেয়ে সরু ভূখণ্ড। একপাশে ডি’এন্ট্রেকাস্ট চ্যানেলের তুলনামূলক শিথিল জলরাশি আর অন্যপাশে তাসমান সাগরের গর্জন তোলা বিশাল বিশাল ঢেউ যার সীমানা পৃথিবীর সর্বদক্ষিণে অ্যান্টার্কটিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘দ্য নেক’-এ আমরা গাড়ি পার্ক করে প্রায় ২৫০টি সিঁড়ি বেয়ে একটি ছোট পাহাড়ে উঠলাম। এখান থেকে ডি’এন্ট্রেকাস্ট চ্যানেল আর তাসমান সাগরের ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য দেখা যায়। দেখলে মনে হয়, দুই পাশের জলরাশি দিয়ে এই ৪০ মিটারের মতো ভূখণ্ডকে গলা চেপে ধরে রেখেছে।
এই ৪০ মিটার ভূখণ্ডের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে অ্যাডভেঞ্চার বে ও কেপ ব্রুনি লাইটহাউজের দিকে, সে রাস্তায় গাড়িগুলোকে দেখলে মনে হয়- ব্রুনি দ্বীপ তার গলা দিয়ে এই গাড়িগুলো গিলছে আর গিলছে। আমরা ‘দ্য নেক’-এর সৈকতে অনেক সময় কাটালাম। ভিনদেশে আরও কত ভিনদেশি মানুষ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যে এখানে জড় হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ফেইসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করছেন, আবার কেউ ভিডিও শুট করছেন। এখানে বাতাসের বেগ হোবার্টের থেকে দ্বিগুণ। ড্রোন উড়ানো বেশ কঠিন।
দেখতে দেখতে আমরা নেক রিজার্ভ ক্যাম্পিং এরিয়াতে আসলাম। মূল রাস্তা থেকে কয়েকশ মিটার ভেতরে একটু ঘন বনের মধ্যে। প্রায় ১০-১২টির মতো মোটরহোম, ক্যাম্পারভ্যান ও ক্যারাভান দেখা গেল। আমরা এখানে দুপুরের খাবার খাব। কিন্তু ক্যাম্পিং এরিয়ার প্রায় সব জায়গায় তাদের দখলে। কেউ রান্না করছেন, কেউ কাপড় ধুচ্ছেন, অনেকে তাদের ভ্যান রেখে বনের মধ্যে ট্রেকিং-এ গেছেন। আমরা একটি স্পট পছন্দ করলাম। পাশের ক্যাম্পে ফরাসি পরিবার আড্ডা দিচ্ছিলেন। আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।
কেপ ব্রুনি লাইটহাউজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এখান থেকে আরও ৩৫ কিলোমিটার দূরে। একটু পরই রাস্তা আরও সরু হয়ে আসলো। এখানে বেশি মানুষের যাতায়াত নেই। ঘন বনের মধ্যে দিয়ে আধা পাকা আঁকাবাঁকা রাস্তা। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা আরও সরু হয়ে গেছে। ঘন বনের ভেতরে দিব্বি গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে যেতে হচ্ছিল। অনেকে রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে বনের মধ্যে ট্রেকিং করছেন। কেউ কেউ ২-৩ ঘণ্টার জন্য ট্রেকিং-এ গেছেন, কেউবা আবার সারাদিনের জন্যে। আমাদের সময় সাহস কোনটাই নেই। আমরা ট্রেকিং-এ গেলাম না।
এখন প্রায় বেলা গড়িয়ে ৪টা। কেপ ব্রুনি লাইটহাউজে পার্কিং অনেক কম। বছরের এই সময়টায় এখানকার তাপমাত্রা বেশ ভাল থাকে, তাই অনেক দর্শনার্থী আসেন। শীতে তাপমাত্রা অনেক কমে যায়, আর প্রচণ্ড বাতাস, ঠান্ডার অনুভূতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। কেপ ব্রুনি লাইটহাউজ হলো অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় পুরাতন লাইটহাউজ। ১৮৩৮ সালে মূলত আবহাওয়া ও যোগাযোগের জন্য তৎকালীন গভর্নর জর্জ আরথার এটি নির্মাণ করেন। ডেলরাইট পাথর দিয়ে ওই সময়ের দণ্ডিত কয়েদিদের দিয়ে এই লাইটহাউজটি নির্মাণ করা হয়েছিল। লাইটের প্রধান জ্বালানি হিসেবে স্পার্ম হোয়েল নামে এক প্রজাতির তিমি মাছের তেল ব্যবহৃত হত। পরে ডিজেল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হত।
লাইটহাউজের টাওয়ারের পাশেই গার্ডদের অফিস। এখন সেটি জাদুঘর। জাদুঘরে দেখা গেল তাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র ও অফিসের নথিপত্র। কাচের বাক্সে বন্দি আছে তাদের প্রতিদিনের কাজের বিবরণী। বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর বাতাসের গতি, দিক, তাপমাত্রা ও বিশেষ সিগন্যালের বিবরণী লক্ষ্য করলাম। সুশৃঙ্খল দৈনন্দিন কাজের বর্ণনা প্রায় ২৫০ বছর আগে থেকে লেখা হয়েছে। সত্যি অবাক হাওয়ার মত বিষয়। গার্ডদের ব্যবহার করা কেরোসিন পাম্প মেশিন ও জেনারেটর, তার পাশেই আগের দিনের গ্রাহাম মডেল টেলিফোন বসান আছে। এখন এগুলো অনেক পুরাতন। নতুন প্রযুক্তি তাদের স্থান দখল করে নিয়ে তাদের জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
টাওয়ারের ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, বিশাল তাসমান সাগরের জলরাশি দূরে মিলে গেছে আকাশের সঙ্গে। এই প্রান্তে তাসমানিয়া আর অন্য প্রান্তে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ। সময় সন্ধ্যা ৭টা হলেও এখনও অনেক বেলা। গ্রীষ্মে তাসমানিয়াতে সূর্য ডুবে প্রায় ৯টায়। আমরা বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, কারণ দিনের শেষ ফেরিটি ধরতে হবে।
মো. রুহুল আমিন রাসেল: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়া।