সুলতান বুঝেছিলেন শুধু মানুষ নয়, বাংলাদেশের সম্পদে ভরা নিসর্গও চিত্রপট এবং মানবজীবনে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
Published : 17 Aug 2023, 02:47 PM
শিল্পী সুলতানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ (১৯৭৫) শিরোনামে ছবিটির মাধ্যমে, যেখানে ছবির একদম সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছেন বাদামি শরীরের এক প্রচণ্ড শক্তিশালী পেশীবহুল পুরুষ, যার দুই পায়ের ফাঁকে একটি চারাগাছকে নিজে বর্মের মতো দুই হাত দিয়ে আগলে রেখেছেন। ছবির পশ্চাদপটে ইউরোপীয় স্টাইলের দুইজন নগ্ননারী, যাদের একজনের পিঠে ডানা দেখে তাকে রেনেসাঁ চিত্রকলার কিউপিড বলেই মনে হয়। আর পুরুষ মানুষটি তখন হয়ে যায় আদম, যার দেহের রং ও মাটির রং মিলেমিশে একাকার। যিনি প্রথম বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সৃষ্টি করছেন এক নতুন শিশুস্বর্গ।
পুরো নাম শেখ মুহাম্মদ সুলতান, যিনি এস এম সুলতান নামে পরিচিত। বৃহত্তর যশোরের নড়াইল থানার মাসুমদিয়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে ১৯২৩ সালের ১০ অগাস্ট জন্ম নেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই শিল্পের প্রতি টান শিল্পীকে ঘরছাড়া করে। কলকাতায় সরকারি আর্ট স্কুলে শিক্ষা শেষে বেরিয়ে পড়েন দেশ দেশান্তরে নিজের শিল্পচর্চা সমৃদ্ধ করতে। তার ভ্রমণপর্বে ভারত, পাকিস্তান হয়ে ইউরোপের নানা দেশভ্রমণ প্রদর্শনীর ইতিহাস সবার জানা। তারপর দেশে ফেরেন এবং পাকাপাকিভাবে দেশেই থেকে যান।
শিল্পী সুলতানের শিল্পজীবনের বেশিরভাগ রচনার প্রধান উপজীব্য হলো মানুষ এবং বাংলাদেশের প্রকৃতি। গ্রামবাংলার নিজস্ব সৌন্দর্যের সাথে মিশিয়েছেন গ্রামীণ পরিবারের প্রতিদিনের টুকরো টুকরো অতিসাধারণ ঘটনাগুলো, যা আমরা সাধারণত এড়িয়ে যাই তুচ্ছ বিষয় হিসেবে। আর শিল্পী তার মধ্যে খোঁজেন জীবনের সংগ্রামকে।
এই সংগ্রামী মনোভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি তার ছবিতে আনলেন এক ধরনের অ্যানাটমি ডিসটরশন। এই বিষয়ে শিল্পীর বক্তব্য পরিষ্কার, “আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলছি। আমার সকল চিন্তা, সবটুকু মেধা, সবটুকু শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করি তা কেবল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য। আমার ছবির মানুষেরা, এরা তো মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে স্ট্রাগল করেই এরা বেঁচে থাকে। এদের শরীর যদি শুকনো থাকে, মনটা রোগা হয়, তাহলে এই যে কোটি কোটি টন মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুসকল আসে কোত্থেকে? ওদের হাতেই তো এসবের জন্ম। শুকনো, শক্তিহীন শরীর হলে মাটির নিচে লাঙলটাই দাব্বে না এক ইঞ্চি। আসলে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে এনার্জি, সেটাই তো দরকার। ঐ যে কৃষক, ওদের শরীরের অ্যানাটমি আর আমাদের ফিগারের অ্যানাটমি, দুটো দুই রকম। ওদের মাসল যদি অতো শক্তিশালী না হয় তাহলে দেশটা দাঁড়িয়ে আছে কার উপর? ওই পেশীর ওপরেই তো আজকের টোটাল সভ্যতা।”
তাই সুলতানের কৃষকরা হলেন পেশীবহুল আর নারীরা হলেন ভারি স্তন ও নিতম্বের অধিকারিণী, না হলে এসব শক্তিশালী পুরুষকে গর্ভে ধারণ করবেন কীভাবে! এই ধরণের নারী-পুরুষের দেহাবয়বের সাথে শিল্পতাত্ত্বিকরা শিল্পী মাইকেল অ্যাঞ্জোলোর সৃষ্ট চরিত্রের মিল খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আমরা যারা শিল্পীকে শ্রদ্ধা করি, তারা সুলতানের ছবিতে ঠিক কী খুঁজি? ধরা যাক ১৯৭৮ সালের তেলরঙে সৃষ্ট ‘শাপলা তোলা’ ছবিটির কথা। ছবির একদম সম্মুখভাবে নদীমাত্রিক গ্রামে তালপাতার ডোঙা চড়ে দুই রমণী শাপলা তুলতে ব্যস্ত। এই শাপলা একদিকে যেমন বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের প্রতীক, তেমনি অপরদিকে গ্রামবাংলায় মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করে। একটু দূরে অপর একজন পুরুষও একই কাজে ব্যস্ত।
চিত্রপটটি মোঘল মিনিয়েচারের মতো পরপর ঘটনাপ্রবাহ নির্মাণ করেছে। যেটি আরো পরিষ্কার হয় ১৯৮৬ সালে নির্মিত ‘চর দখল-২’ ছবিটিতে। শিল্পী সুলতানের ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো চিত্রপটের প্রতিটি চরিত্রকে গুরুত্ব দেওয়া। সেই কারণে তিনি মোঘলশৈলীর রচনাকৌশলকে নিজের ইউরোপীয় শিল্পশিক্ষার সাথে চমৎকারভাবে মিশিয়ে নতুন এক চিত্রভাষা তৈরি করেছিলেন।
এখানে তিনি চরিত্রগুলো সাজালেন অনেকটা গোলাকারভাবে যাতে করে মাঠান জমির উপর পেশীবহুল কৃষক-যোদ্ধাদের প্রত্যেকেই পূর্ণাঙ্গভাবে দৃশ্যত হন, আর প্রতিটি চরিত্র কোনো না কোনোভাবে প্রত্যেককে স্পর্শ করে আছে, যেন মনে হচ্ছে হিউম্যান শিল্ড। প্রত্যেকের ভরসা ও বিশ্বাস একজোট হয়ে চর দখলের সংকল্প স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘ক্ষেতদখল’ (১৯৮৫) অথবা ‘যাত্রা’ (১৯৮৬) ছবিগুলোর কম্পোজিশনও আমার উক্তিকে সমর্থন করবে।
আবার ১৯৮৬ সালে তেলরঙে আঁকা ‘ধান-মাড়াই-১’ অথবা ‘ধান ঝাড়াই’ শিরোনামের ছবিগুলোতে সুলতান ফুটিয়ে তুলেছিলেন গ্রামবাংলার সৌন্দর্য। এখানে পেশীবহুল কৃষক, গ্রামীণ নারীর দেহসৌষ্ঠব, গাভী-বলদের গা থেকে চুঁইয়ে পড়া আলোর সাথে দোচালা খড়ের বাড়ি, গোলাঘর অথবা মাঠ-ঘাট-নদী-গাছপালার সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সুলতান বুঝেছিলেন শুধু মানুষ নয়, বাংলাদেশের সম্পদে ভরা নিসর্গও চিত্রপট এবং মানবজীবনে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
স্বগতোক্তির সুরে জীবনের সায়াহ্নে একবার সুলতান বলেছিলেন, “যৌবনে কল্পনার নানান আকর্ষণে আবেগে আপ্লুত হয়ে ঘুরে বেড়ালাম সারা ভারতবর্ষ। মন শান্ত হলো না, তাই পাড়ি জমালাম সাত সমুদ্র আর তেরো নদীর পাড়ে। ঘুরে বেড়ালাম আপন খেয়ালে। তারপর একদিন অনেকটা আচমকা মনের পর্দায় ভেসে উঠল চিত্রাসুন্দরীর রূপপ্রকৃতি।... আমার মন উতলা হলো, আমি ফিরে এলাম ওর কাছে, না, ঘরবাঁধা হলো না আমাদের। সময় সবকিছু উল্টো করে দিয়েছে। চিত্রা হলো চিরবহমান আর আমাকে করল বোহেমিয়ান। সংসারই হলো না যাদের তাদের আবার সন্তান! তাই তো জীবনসায়াহ্নে চিত্রার পাড়ে গড়ছি ‘শিশুস্বর্গ’। আমার জীবদ্দশায় না হোক চিত্রা প্রাণপ্রদীপ নিভে যাবার আগে এই ‘শিশুস্বর্গ’ যাতে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারে সেই চেষ্টাই যেন করে সকলে মিলে...।”
শিল্পী এস এম সুলতান, যিনি লাল মিয়া নামে ততোধিক খ্যাত, একটি ছোটো প্রবন্ধে তার জীবনদর্শন অথবা শিল্প নিয়ে আলোচনা প্রায় অসম্ভব বিষয়। বাদ পড়ে গেছে মরমী শিল্পীর বাঁশির সুর, নৃত্য, অভিনয় অথবা সঙ্গীতপিপাসা অথবা পোষ্যদের প্রতি তার ভালোবাসা। বাংলাদেশে শিল্পীর দর্শন, চিন্তন, মনন নিয়ে পথেঘাটে আলোচনা চলতেই থাকে- এতটাই তার প্রভাব। এবছর শিল্পী শেখ মুহাম্মদ সুলতানের জন্মশতবর্ষ। বছরভর আমাদের প্রতিজ্ঞা থাকবে শিল্পীর দর্শনকে আরো বেশি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া, তাদের ‘শিশুস্বর্গ’ নির্মাণে উৎসাহিত করা।