“বাথরুমে বই পড়া আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কোনো স্থানই জ্ঞান লাভের জন্য খুব সাধারণ নয়।”
Published : 02 Jan 2025, 09:45 PM
পুরো নাম হেনরি ভ্যালেন্টাইন মিলার (১৮৯১-১৯৮০)। একজন আমেরিকান ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক ও প্রাবন্ধিক।
তিনি প্রচলিত সাহিত্যিক ধারার বাইরে এসে একটি নতুন ধরনের আধা-আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখেন। চরিত্র বিশ্লেষণ, সামাজিক সমালোচনা, স্ট্রিম অফ কনশাসনেস, স্পষ্ট ভাষা, প্রেম কিংবা রহস্য- দার্শনিক প্রতিফলন ঘটে এসব বইয়ে। তার এই ধরনের স্বতন্ত্র কাজগুলো হলো- ‘ট্রপিক অফ ক্যান্সার’, ‘ব্ল্যাক স্প্রিং’, ‘ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন’ এবং ত্রয়ী ‘দ্য রোজি ক্রুসিফিকশন’। তিনি ভ্রমণ স্মৃতিকথা ও সাহিত্য সমালোচনাও লিখেছেন, এঁকেছেন জলরঙে ছবি।
অনেক লেখক তাদের চিন্তাধারায় যেসব সাহিত্যিক প্রভাব ফেলেছেন তা গোপন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু হেনরি মিলার তা করেননি। উঠতি বয়সে তার বই পড়া নিয়ে অকপট বিবরণ দিয়েছেন। এ নিয়ে লিখেছেন ‘দ্য বুকস ইন মাই লাইফ’ নামে একটি বই। এতে তিনি বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।
‘দ্য বুকস ইন মাই লাইফ’ বইয়ে বাথরুমে বই পড়া নিয়ে আছে মজার এক চ্যাপ্টার। মিলারের মতে, বাথরুম শুধু একটি ব্যবহারিক জায়গা নয়, এটি নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা ও পড়ার আশ্রয়স্থল।
তিনি উল্লেখ করেছেন, মানুষ সাধারণত বাথরুমে পড়ার জন্য এমন বই বেছে নেয় যা ছোট, আকর্ষণীয় এবং সহজে পড়া যায়। এর মধ্যে থাকতে পারে ম্যাগাজিন, পত্রিকা, অথবা এমন বই যা হালকা এবং যে কোনো সময় তুলে নিয়ে পড়া সম্ভব।
বাথরুমে পড়ার মতো সাধারণ বিষয়ও মানুষের গভীর প্রবণতাকে প্রতিফলিত করেছেন মিলার। তার নিজের বাথরুম ছিল তার চিন্তা ভাবনার বৈশিষ্ট্যে সাজানো, সাধারণ বাথরুমের ধারণার একেবারে বাইরে। এটি ছিল এমন জায়গা যেখানে মিলার নিজের মনকে মুক্তভাবে বিচরণ করতে দিতে পারতেন।
মিলারের বাথরুমে অনেক ছবির সমাহার ছিল, যেগুলো নানা ধরনের অভিজ্ঞতা ও চিন্তার পথ দেখাতো। বাথরুমের দেয়ালে ছিল বৌদ্ধ ধর্মের ছবির পাশাপাশি পেশাদার নারী এবং এমনকি মানসিক রোগীদের ছবি, যারা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতো। এসব ছবির মধ্যে কোন শৈল্পিক আভাস ছিল না, বরং তারা মিলারের নিজের জীবনের নানা দৃষ্টিকোণ এবং ভাবনা প্রতিফলিত করত।
মিলার বর্ণনা করেছেন, তিনি অনেক সময় এ ছবিগুলো দেখে ভাবতেন, কেন তিনি এগুলো সংগ্রহ করেছিলেন এবং কেন সেগুলো তার বাথরুমে স্থাপন করেছিলেন। এখানে সে জায়গাটি শুধু শৌচকর্মের জন্য নয়, বরং এমন একটি জায়গা হয়ে উঠত যেখানে মনস্বিত চিন্তা, কল্পনা ও অনুভূতি একসঙ্গে মিলিত হয়।
মিলার বাথরুমকে কেবল দৈনন্দিন কাজের স্থান হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে একটি নির্জন ও অন্তর্মুখী স্থান হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যেখানে মানুষ নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পারে। মিলারের দৃষ্টিতে, তার বাথরুমে বই পড়া ছিল এমন একটি অভ্যাস যা পড়ার আনন্দ এবং জীবনের মজার দিকগুলোর সংমিশ্রণ ঘটায়। বাথরুম এমন একটি জায়গা যেখানে দৈনন্দিন জীবনের চাপ এবং গোলমালের বাইরে গিয়ে মানুষ নিজেকে একটু সময় দিতে পারে।
তিনি লিখেছেন, “বাথরুম একটি আশ্রয়স্থল, একটি স্থান, যেখানে মানুষ তার চিন্তাভাবনার সঙ্গে একা থাকে এবং প্রায়ই, তার বইগুলোর সঙ্গেও।” তিনি বাথরুমে পড়াকে নিছকই একটি আরামদায়ক অভ্যাস হিসেবে দেখেননি; এটি ছিল তার কাছে একটি ধ্যানের মতো অভিজ্ঞতা।
তার মতে, “বাথরুমে পড়া সাধারণত হালকা ও সহজপাঠ্য হওয়া উচিত, যেন মূল খাবারের আগে ভালো এপেটাইজারের মতো।” এটি ম্যাগাজিন, পত্রিকা, কিংবা সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ হতে পারে। তবে মিলারের দৃষ্টিতে, কোনো বইয়ের গুণমান তার স্থান নির্ধারণ করে না। বাথরুমেও একটি মহান সাহিত্যিক বই পড়া সম্ভব।
মিলারের জন্য বাথরুমে পড়া কেবল শখ নয়; এটি জীবনের প্রতি তার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে। তিনি বলেন, “বাথরুমে বই পড়া আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কোনো স্থানই জ্ঞান লাভের জন্য খুব সাধারণ নয়।”
তিনি মনে করতেন, মানুষের যদি পড়ার অভ্যাস থাকে, তবে স্থান বা পরিস্থিতি বাধা হতে পারে না। বাথরুমে পড়া মানে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে পূর্ণতা দেওয়ার একটি চমৎকার উদাহরণ।
মিলার তার মজার লেখায় এই বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন যে, অনেকেই বাথরুমে পড়ার কথা বলতে লজ্জা পায়। কিন্তু তার মতে, এটি মানুষের জীবনের স্বাভাবিক একটি অংশ। তিনি বলেন, “বাথরুমে পড়া মন্দ কাজ নয়, এটি একটি গুণ, একাকিত্বের উদযাপন।” তিনি বাথরুমে পড়াকে এক ধরনের মুক্তি ও নির্জনতার উদযাপন হিসেবে দেখতেন।
অবশ্য মিলারের মতে, বই পড়া সবাইকে জ্ঞানী করে না। তিনি মজার ছলে বলেন, “একজন মূর্খ বই পড়লেও মূর্খ, কিন্তু কমপক্ষে তিনি জানেন যে জ্ঞানীরা কী নিয়ে কথা বলেছেন।” অনেকেই বই কিনে সাজিয়ে রাখেন, কিন্তু পড়া হয় না। মিলার এটিকে নিছক মজার দৃষ্টিতে দেখেছেন।
হ্যাঁ, হেনরি মিলার নিজেই বাথরুমে বই পড়তেন, এবং তিনি এটি নিয়ে কোনো লজ্জা বা দ্বিধা অনুভব করতেন না। তার মতে, “বাথরুম হল একমাত্র স্থান যেখানে নিশ্চিত গোপনীয়তা থাকে, আর এর চেয়ে ভালো উপায় কী হতে পারে সময় কাটানোর জন্য, একটি বই হাতে নিয়ে?”