বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী নামে এক জনপদে ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হয়েছিল এমন এক মানুষের, যার মতো জ্ঞানবান পণ্ডিত সে যুগে ছিল বিরল।
Published : 04 Jul 2024, 02:18 PM
গত শতকের আশির দশকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে অতীশ দীপঙ্করকে নিয়ে একটা লেখা ছিল। সেই লেখাটার একটা সুন্দর নামও ছিল। তখন বুঝিনি, তিনি আসলে কতবড় সাধক ছিলেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বই পড়ে যখন মনের দরজা-জানালা খুলে যেতে শুরু করলো, তখন আবার নতুন করে তার কথা মনে হলো। আর তখনই একটা বই পেয়ে গেলাম। বইয়ের নাম ‘অতীশ দীপঙ্কর’। হাতে পেয়েই একবারে পড়ে ফেললাম। কিশোর উপযোগী করে লেখা এ বইয়ের লেখক একরাম আলি। প্রকাশক ‘নালন্দা’। অনেকটা সামনাসামনি বসে গল্প বলার ঢঙে লেখা এ বই।
অনেক আগের কথা। তখন বাংলাদেশ আর পশ্চিমবাংলার মিলিত রূপ রাঢ়, বরেন্দ্র, হরিকেল, সমতট ও বঙ্গ নামে ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। সমতটের প্রধান নগরী ও রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। সেই বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী নামে এক জনপদে ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হয়েছিল এমন এক মানুষের, যার মতো জ্ঞানবান পণ্ডিত সে যুগে ছিল বিরল। আজ তাকে আমরা অতীশ দীপঙ্কর নামে চিনি, কেউ কেউ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বা দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নামেও চেনেন।
পরে তিনি এসব নামে জগৎজোড়া খ্যাতি পেলেও বাবা-মা নাম রেখেছিলেন ‘চন্দ্রগর্ভ’। কল্যাণশ্রী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ রাজন্য। তার স্ত্রীর নাম ছিল প্রভাবতী। তাদেরই মেজ ছেলে এই চন্দ্রগর্ভ, বড় ছেলের নাম পদ্মগর্ভ, ছোটটি শ্রীগর্ভ। বজ্রযোগিনী জনপদ কিন্তু আজও টিকে আছে। তবে, এখন সেটি নেহাতই একটি গ্রাম। একটি ঢিবিকে স্থানীয়রা চিহ্নিত করে রেখেছেন হাজার বছর ধরে, অতীশের ভিটা।
ছোটবেলা থেকেই চন্দ্রগর্ভ ছিলেন একটু অন্য ধরনের। আর-পাঁচটা ছেলের মতো খেলাধুলায় আর সামান্য পড়াশোনায় জীবন তার কাটাতে চাইল না। মাত্র দশ বছর বয়সেই সে যেকোন বই পড়ার মতো শিক্ষিত হলো। তার হাতের লেখা ছিল ছবির মতো সুন্দর। সেসময় রাজপরিবারের ছেলেদের এটুকু শিক্ষাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এ-ছেলে তো আর রাজকার্য করার জন্য জন্মায়নি! তার সামনে একটাই লক্ষ্য, সবকিছু জানতে হবে তাকে। এতসব জানতে গেলে, বুঝতে গেলে, চাই আরও পড়াশোনা। চাই উপযুক্ত শিক্ষা। এমন শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে!
মাত্র ১২ বছর বয়সেই রাজপরিবারে বেড়ে ওঠার মোহ তার ভেঙে গেলো। প্রাসাদের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। দেশান্তরে উচ্চশিক্ষার খোঁজে। আচার্যের খোঁজে। যেসময় তিনি সম্পূর্ণভাবে তন্ত্রচর্চায় নিয়োজিত, সেসময় একরাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে অসংখ্য শিষ্যসহ ভগবান বুদ্ধদেব তাকে দেখা দিয়ে বলেন, ‘এ জীবনের প্রতি তোমার আসক্তি কেন? কেন তুমি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করছ না?’
তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, আর নয়। যোগী আর সিদ্ধাচার্য আর ডাকিনীদের সঙ্গ ছেড়ে তিনি বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেবেন। আচার্য ধর্মরক্ষিত তাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন। আর এই প্রবর্জ্যগ্রহণের সময়ই তার নাম রাখা হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর।
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর দুবছর বঙ্গ আর মগধের বিখ্যাত আচার্যদের কাছে পড়াশোনা করেন অতীশ। ওদন্তপুরী বিহারে আচার্য ধর্মরক্ষিতের কাছে মহাবিভাষা আয়ত্ত করেন। মহাসাঙ্ঘাক, সর্বাস্তিবাদী, সম্মিতীয় আর স্থবিরবাদী, এই চার সম্প্রদায়েরই ত্রিপিটক পাঠ করেন। তান্ত্রিকদের ছেড়ে বিশুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মচর্চাই তার জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
বুদ্ধদেব দেবতা মানতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ নিজের চরিত্রকে শুদ্ধ করে ক্রমে ক্রমে দেবতাদের থেকেও উঁচুতে পরমপদে উঠতে পারে। তার মতে, তৃষ্ণাই নানারকম জন্মের কারণ। তাই এই তৃষ্ণাকে ধ্বংস করতে হবে। তিনি আরও বলতেন, ‘প্রাণী বধ করবে না। তোমাকে দেওয়া হয়নি এমন বস্তু নিয়ো না। মিথ্যা কথা বলবে না। মদ খাবে না। ব্যভিচার করবে না। সুগন্ধি ব্যবহার করবে না। উঁচু শয্যায় শোবে না। সোনা-রুপো ছুঁয়েও দেখবে না।’
বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর বৌদ্ধসমাজ ক্রমে ক্রমে ‘হীনযান’ আর ‘মহাযান’ নামে দুদলে বিভক্ত হয়ে গেলো। ‘যান’ শব্দের অর্থ পথ বা মত। দুই যানেই ত্রিশরণগমের ব্যবস্থা আছে। তবে হীনযানের ত্রিরত্ন এরকম- প্রথমে বুদ্ধ, তারপরে ধর্ম, শেষে সঙ্ঘ। কিন্তু মহাযান বৌদ্ধদের ত্রিরত্ন হচ্ছে প্রথমে ধর্ম, পরে বুদ্ধ ও শেষে সঙ্ঘ। মহাযানীরা বুদ্ধের থেকেও ধর্মকে বেশি গুরুত্ব দিলেন। তারপর ক্রমে ক্রমে এই মহাযান থেকেই উৎপত্তি হলো নানা যানের। মন্ত্রযান, বজ্রযান, সহজযান ও কালচক্রযান। সহজযানদের ধর্মচিন্তায় তন্ত্র এসে যাওয়ায় তাদেরকে তান্ত্রিক বৌদ্ধও বলা হয়। এসব সহজিয়া সাধকদের বলা হতো ‘সিদ্ধ’ বা ‘সিদ্ধাচার্য’। তারা নিজেরা গান লিখে এবং গেয়ে ধর্মপ্রচার করতেন।
বাংলাদেশের সিদ্ধারা গানগুলো লিখেছেন বাংলা ভাষায়। জেগে উঠেছিল সেই সময়ের নিচতলার মানুষেরা। যেমন, শবরপা ছিলেন ব্যাধ, মীনপা ছিলেন জেলে, চমরিপা ছিলেন মুচি, নারোপা ছিলেন শুঁড়ি, যোগিপা ছিলেন চণ্ডাল। তাদের বক্তব্য ছিল- মানুষে মানুষে উঁচুনিচু ভেদাভেদ নেই, সব মানুষই সমান। অখাদ্য বলে কিছু নেই, সবকিছুই খেতে হবে। অপবিত্র বলে কিছু নেই, সবকিছু পবিত্র। অস্থান-কুস্থান বলে তারা কিছু মানতেন না, সর্বত্র যেতেন। একে তখনকার সমাজ-আন্দোলনই বলা যায়। এরপর দীপঙ্কর দীক্ষা নেন আচার্য ধর্মকীর্তির তত্ত্বাবধানে। চারদিকে মহা অশান্তি দেখে অতীশ দীপঙ্কর দেশে ফিরে আসেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৪৩ বছর।
তিব্বতের রাজার অনুরোধে অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দে দীপঙ্কর তিব্বতে পৌঁছান। তখন তার বয়স ৬০ বছর। তিব্বতে দীপঙ্করের প্রথম ঘাঁটি ছিল থোলিং বিহার। সেখানকার তান্ত্রিক রত্নভদ্র অবশেষে স্বীকার করেন যে, মহাপণ্ডিতদের মধ্যে দীপঙ্করই শ্রেষ্ঠ। টানা ১০ বছর সাধনার পর তিনি যে ঘরে থাকতেন তার তিনটি দরজার প্রথমটিতে লিখলেন, ‘যদি পার্থিব কোন চিন্তা এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে উদিত হয়, তা হলে ধর্মের প্রহরীরা আমার মাথা চূর্ণ করে দিক।’ দ্বিতীয় দরজার গায়ে লিখলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে উদিত হয়, তা হলে ধর্মের প্রহরীরা আমার মাথা চূর্ণ করে দিক।’ আর তৃতীয় দরজায় লিখলেন, ‘যদি তুচ্ছ কোন চিন্তা এক মুহূর্তের জন্যও মনে উদিত হয়, তা হলে ধর্মের প্রহরীরা আমার মাথা চূর্ণ করে দিক।’ তারপর দীপঙ্কর হয়ে গেলেন সেখানকার ‘জোবো জে’, অর্থাৎ মহাগুরু।
তিব্বতে দীপঙ্করের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ‘বোধি-পথ-প্রদীপ’ বইটি লেখা। তার প্রধান শিষ্যদের অনুরোধে অতীশ ছোট্ট বইটির একটা ব্যাখ্যা লিখেন ‘বোধিমার্গ-প্রদীপ-পঞ্জিকা’ নামে। সেটা ছিল একটা বিরাট বই। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষকে তিন শ্রেণির বলে জানবে: অধম, মধ্যম ও উত্তম। এই তিন শ্রেণিরই চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত পরিষ্কার। তাদের প্রত্যেকের লক্ষণগুলো আমি স্পষ্ট করে লিখছি। অধম সে-ই, যে শুধু নিজের স্বার্থ আর সংসার-সুখের জন্য কাজ করে। সংসার-সুখের প্রতি উদাসীন আর কোন পাপকাজও করে না, অথচ যে শুধুই নিজের ভালোর কথা চিন্তা করে, সে হলো মধ্যম পুরুষ। আর উত্তম তাকেই বলা হয়, যে নিজেকে কষ্ট দিয়ে সর্বদা অন্যের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করে।’
ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম গিয়েছিল তিব্বতে। বৌদ্ধধর্মের রূপে আসলে গিয়েছিল এক নতুন সভ্যতা, এক নতুন জ্ঞান আর নতুন জীবনচর্চা। নতুন ভাষা আর লিপি। দীপঙ্করকে তিব্বতের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরতে হয়েছিল মরো-মরো বৌদ্ধ সভ্যতার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। তাপর অক্লান্ত পরিশ্রমে একসময় শরীরে অসুখ করে। একসময় তিনি শেষ নিশ্বাস ফেলেন। সেটা ছিল ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দ।
তিব্বতে এখনও তাকে ‘অদ্বিতীয় গুরুরূপে’ স্মরণ করা হয়। আমরাও তাকে পুরোপুরি ভুলে যাইনি। বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে স্মরণফলক আর কমলাপুরের বৌদ্ধবিহার তার প্রমাণ। বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার চিতাভস্ম তিব্বত থেকে নিয়ে আসে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন।
কমলাপুর বৌদ্ধবিহারে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের চিতাভস্ম রাখা আছে। বহু মানুষ সেই চিতাভস্ম দেখতে যান। শ্রদ্ধা জানাতে যান মানবতার সেই পূজারি পরিব্রাজককে, যার কোন দেশভেদ ছিল না, সব দেশকে যিনি নিজেরই দেশ বলে বিশ্বাস করতেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যিনি ছিলেন অক্লান্ত। হাজার বছর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘ভিড়ের ভেতর বসবাস করার সময় এটা নয়। এখন নিঃসঙ্গতার মধ্যে আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে।’ আমরা মনে রেখেছি তার সেই উক্তি, ‘কখনো নিজের জন্য কিছু করবে না, এমনকি নিজের জন্য বাড়িয়ে যাবে না পুণ্যেরও সঞ্চয়!’