তার লেখা চিঠিগুলো থেকে ২৪০টিরও বেশি স্কেচ পাওয়া গেছে। এগুলো বেশিরভাগই কলম দিয়ে দ্রুত আঁকা, তবে কখনও কখনও আরও স্পষ্ট ও রঙিন চিত্রকর্ম।
Published : 09 Jun 2024, 10:58 AM
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ (১৮৫৩-১৮৯০) একজন ওলন্দাজ চিত্রশিল্পী। ছোটোবেলা থেকেই ছবি আঁকা শুরু করেন তিনি। তার আঁকা একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম হল- ‘দ্য স্টারি নাইট’।
ভ্যান গঘ দুই হাজারেরও বেশি চিঠি লিখেছিলেন। তার চিঠির ভাষা ছিল আবেগপ্রবণ। চিঠিতে তিনি তার ইচ্ছা, পরামর্শ ও অনুভূতি প্রকাশ করতেন। ভিনসেন্টের ভাই-বোনেরা সবাই বাড়ি থেকে দূরে বসবাস করতো, তাই তারা প্রায়ই একজন অন্যজনকে এবং বাবা- মাকে চিঠি লিখতো।
ভিনসেন্টের লেখা অনেক চিঠি ও সেসবের বেশ কিছু উত্তর এখনও টিকে আছে। সব মিলিয়ে ৯০৩টি চিঠি পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৮২০টি ভ্যান গঘের নিজের লেখা এবং বাকি ৮৩টি অন্যরা তাকে লিখেছিলেন।
তিনি সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন তার ভাই থিওকে, যিনি তার একাধারে প্রিয় বন্ধু এবং সমর্থকও বটে। থিও খুব যত্ন সহকারে ভিনসেন্টের চিঠিগুলো রেখেছিলেন। তবে ভিনসেন্ট খুব বেশি যত্নবান না হওয়ায় অনেক চিঠি হারিয়ে ফেলেছেন, নয়তো পুড়িয়ে দিয়েছেন।
ভ্যান গঘ আসলে অনেক বেশি চিঠি লিখেছেন, সম্ভবত ২ হাজারেরও বেশি। আমরা ভেবে নিতে পারি, বেশ কিছু চিঠিতে মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। যেমন ‘আমি... আজকে লিখেছি’ এবং ‘আমি এইমাত্র একটি চিঠি পেয়েছি...’।
ভ্যান গঘ ফরাসি ভাষায়ও অনেক চিঠি লিখেছিলেন, যদিও তিনি একজন ডাচশিল্পী। কিন্তু তিনি তার চিঠির প্রায় এক তৃতীয়াংশ ফরাসি ভাষায় লিখতেন। সেই সময়ে, ফরাসি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ভাষা।
মধ্যবিত্তদের ছেলেমেয়েরা ফরাসি ভাষা শিখবে, এমন ইচ্ছে পোষণ করতো প্রতিটি পরিবার। ভ্যান গঘ ছোটবেলা থেকেই ফরাসি বলতে পারতেন। তবে ১৮৮৬ সালে প্যারিস চলে যাওয়ার পর তিনি পুরোপুরি ফরাসি ভাষায় লেখালেখি শুরু করেন। তার ভাই থিও বোন উইলেমিয়েনকে এক চিঠিতে লিখেন- “যদি তুমি আমাকে ফরাসি ভাষায় লিখার অনুমতি দাও...এ ভাষা সত্যিই আমার চিঠি লেখাকে সহজ করে দেবে”।
ভিনসেন্ট ফ্রান্সকে তার ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ মনে করতেন। সেখানকার শিল্পী হিসেবে নিজের নামও প্রচার করতে পছন্দ করতেন। ভিনসেন্ট সাধারণত তার ভাইকে লেখা চিঠিগুলো শেষ করতেন ‘তু তা তোয়া, ভিনসেন্ট’ অর্থাৎ ‘তোমারই, ভিনসেন্ট’- এমন আবেগময় কথাগুলো দিয়ে। তিনি ‘ভিনসেন্ট’ লিখে তার চিত্রকর্মে স্বাক্ষর করতেন, কারণ ফরাসিদের ‘ভ্যান গঘ’ উচ্চারণ করতে অসুবিধা হতো।
ভ্যান গঘ তার চিঠিতে ছবিও আঁকতেন। কিছু চিঠিতে তার আঁকা স্কেচ থাকায় সেগুলো আরো মূল্যবান ও বিশেষ হয়ে উঠেছে। থিও বা কোন একজন শিল্পীবন্ধুকে তিনি কী কাজ করছেন কিংবা তার আঁকা চিত্রকর্ম কেমন দেখাচ্ছে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য চিঠিতে আঁকাগুলো যোগ করতেন। আজকাল আমরা ঠিক যেভাবে হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমেলের মাধ্যমে একটি ছবি পাঠাই, তেমনই।
তার লেখা চিঠিগুলো থেকে ২৪০টিরও বেশি স্কেচ পাওয়া গেছে। এগুলো বেশিরভাগই কলম দিয়ে দ্রুত আঁকা, তবে কখনও কখনও আরও স্পষ্ট ও রঙিন চিত্রকর্ম। পেইন্টিংয়ের রঙ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য ভিনসেন্ট প্রায়ই তার সাদাকালো স্কেচগুলোতে রঙের নাম লিখে দিতেন। স্কেচে নীল, ধূসর-সবুজ, হলুদ এবং বেগুনি রঙ কোনটি কোথায় বসবে তা-ও উল্লেখ করেছেন এক চিঠিতে।
ভ্যান গঘ তার আঁকা ছবি ডাকযোগে পাঠাতেন। চিঠির পাশাপাশি, ভিনসেন্ট তার ভাই থিওকে পেইন্টিং বা চিত্রকর্ম পাঠাতেন। ভাইয়েরা সবাই চেয়েছিলেন, ভিনসেন্টকে মাসিক ভাতা দেওয়ার বিনিময়ে থিও তার আঁকা সবগুলো শিল্পকর্ম নিয়ে নেবে। তারপর থিও সেগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করবে। ভিনসেন্ট তার পেইন্টিং কখনও কখনও বাক্সে প্যাকেট করতেন ঠিকই, কিন্তু প্রায়ই সেগুলো পাঠাতেন কেবল কোনকিছু দিয়ে মুড়িয়ে।
ভিনসেন্ট নিজেও ডাকযোগে সব ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেয়েছিলেন। ফ্রান্সের আল শহরে ভালো পেইন্টিং উপকরণ পাওয়া যেতো না। তাই থিও প্যারিস থেকে ভিনসেন্টের ক্যানভাস, ব্রাশ এবং রঙের টিউব পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, “তোমাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, শরতের ছবির একটি বড় অর্ডার খুব দ্রুত পাবো আমি। আমার বিশ্বাস, এটি চমৎকার কাজ হবে।”
এ চিঠি তিনি ১৮৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে লিখেছিলেন। সে বছরের এপ্রিলে তিনি তার ভাইয়ের কাছে শতাধিক রঙের টিউব অর্ডার করেছিলেন। চিঠিতে ভ্যান গঘ মাঝে মাঝে গোপনীয় বিষয়ও প্রকাশ করতেন। ভিনসেন্ট ও থিও দুই ভাই একে অপরকে বিশ্বাস করতেন। এমনকি নিজেদের অন্তরঙ্গ বিষয়গুলোও লিখতেন। উনিশ শতকে এটা কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল, কারণ বেশিরভাগ মানুষ চিঠিতে খুব ব্যক্তিগত কিছু লিখতে চাইতো না।
১৮৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভিনসেন্ট এমন কিছু প্রকাশ করেছিলেন যা গোপন রাখা প্রয়োজন ছিল। “কিছু একটা ঘটেছে থিও, যেটা সম্পর্কে এখানকার বেশিরভাগ মানুষই জানে না বা জানবেও না। তাই এটি সম্পর্কে একেবারেই চুপচাপ থাকবে। ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে। মিস বেগম্যান বিষ খেয়েছেন।”
মার্গট বেগম্যান ছিলেন ভিনসেন্টের ১২ বছরের বড় প্রতিবেশী। তাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। মার্গট বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন, কারণ তার পরিবার ভিনসেন্টের সঙ্গে তার সম্পর্ক মেনে নিতে পারছিল না। ভিনসেন্ট তার ভাইয়ের কাছে পরবর্তীতে কী ঘটেছিল তা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। এটি তার মনের উপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল। সৌভাগ্যক্রমে মার্গট বেঁচে যান, কিন্তু পরে তাদের সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে।
ছবি ও তথ্যসূত্র: ভ্যান গঘ মিউজিয়াম