সোনালি যুগের বাংলা চলচ্চিত্র

দেশের যুবকেরা তখন নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। প্রিয় নায়কের পোশাক, চুলের স্টাইল অনুকরণ করার চেষ্টা প্রায় সব যুবকের মধ্যেই কমবেশি দেখা যেতো। তারা বিভিন্নভাবে সিনেমার টিকিটের টাকা জোগাড় করতো। কেউ ঘরের মুরগির ডিম বিক্রি করতো, আবার কেউ ঘরের ধান বা চাল বিক্রি করতো।

মো: আবদুর রহিমমো: আবদুর রহিম
Published : 6 Oct 2022, 03:06 AM
Updated : 6 Oct 2022, 03:06 AM

একটানা কাজ করতে করতে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে, একঘেয়েমি সৃষ্টি হয়। আর এই একঘেয়েমি দূর করার জন্য প্রয়োজন বিনোদন। দেশকাল ভেদে বিনোদনেরও রকমফের আছে।

আমাদের দেশে ষাট, সত্তর ও আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য বিনোদনের মাধ্যম ছিল রেডিও, সিনেমা, ফুটবল, বিভিন্ন গ্রামীণ খেলা, মেলা, যাত্রাপালা, টেপরেকর্ডারে গানশোনা, বাউল গানের আসর ও পুতুল নাচ ইত্যাদি। একটা সময়  গ্রামীণ জীবনে রেডিও ছিল বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। এক বাড়িতে রেডিও থাকলে আশপাশের বাড়ির লোকজন ওই বাড়িতে জড়ো হয়ে রেডিওতে গান, নাটক ও খবর শুনতো।

টেপরেকর্ডারের আগমনে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিনোদনের ক্ষেত্রে একটা ভিন্নমাত্রা যোগ হলো। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের গ্রামে আমার জানামতে মাত্র তিনটি রেডিও ছিল, টেলিভিশনের কথাতো চিন্তাই করা যায় না। ওই তিনটি রেডিওতে যুদ্ধের খবর (বুলেটিন) শোনার জন্য সচেতন লোকজন ভিড় করতো। অবশ্য স্বাধীনতার পর প্রায় প্রতি বাড়িতেই রেডিওর আগমন ঘটে। ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে গ্রামে সাদা-কালো টেলিভিশন আসতে শুরু করে। তখন রেডিও থেকে মানুষের মনোযোগ চলে যায় ওই সাদাকালো পর্দার দিকে।

যুবকেরা বিভিন্নভাবে সিনেমার টাকা জোগাড় করতো। কেউ ঘরের মুরগির ডিম বিক্রি করতো আবার কেউ ঘরের ধান বা চাল বিক্রি করতো।

ওই সময় পুরো গ্রামে একটি বা দুটি টেলিভিশন ছিল। অনেক গ্রামে তখনও টেলিভিশন আসেনি। প্রতিমাসে একটা বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। যে গ্রামে টেলিভিশন ছিল না ওই গ্রামের যুবকরা দলবেঁধে অন্য গ্রামে গিয়ে টেলিভিশন দেখতো। বড় উঠানের একপাশে টেলিভিশন রাখা হতো আর শত শত মানুষ প্রবল উৎসাহের সাথে তাকিয়ে থাকতো। কেবল বিত্তবানদেরই টেলিভিশন কেনার সামর্থ ছিল। কোন কোন টেলিভিশনের মালিক বড় বেরসিক ছিল। নিজেরা ঘরে বসে টিভি দেখতো অন্যদেরকে টিভি দেখার সুযোগ দিত না। তখন অনেক ছেলেমেয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে টেলিভিশন দেখার চেষ্টা করতো। কেউ কেউ খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে সিনেমা বা নাটক উপভোগ করতো। পুরো গ্রাম বাংলার চিত্রই ছিল প্রায় অভিন্ন।

বস্তুত সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হওয়ার কিছুকাল পর সিনেমা হয়ে হয়ে উঠলো সর্বস্তরের মানুষের বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। ওই সাদা-কালো চলচ্চিত্রই গ্রাম ও শহরের মানুষের বিনোদনের প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বাংলা সিনেমা এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবাই সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। শহরের মানুষতো পারিবারিকভাবে একেবারে উৎসবের সাথে সিনেমা উপভোগ করতো। গ্রাম থেকেও মানুষ সদলবলে শহরে গিয়ে সিনেমা দেখতো।

তখন দেশে খুব অভাব ছিল। আমি প্রথম সিনেমা দেখি ১৯৭৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কোন এক প্রেক্ষাগৃহে। এই প্রথম আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর দেখি। বাবার হাত ধরেই শহরে গিয়েছিলাম। আমার দেখা প্রথম সিনেমাটি ছিল ‘ওরা ১১ জন’। টিকেটের মূল্য ছিল সম্ভবত আট আনা বা এক টাকা। সিনেমাটি দেখে আমি যে কতটা বিস্মিত হয়েছিলাম তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। তখন নগদ টাকার খুব অভাব ছিল। তাই যুবকরা বিভিন্নভাবে সিনেমার টাকা জোগাড় করতো। কেউ ঘরের মুরগির ডিম বিক্রি করতো আবার কেউ ঘরের ধান বা চাল বিক্রি করতো। বাবা-মায়ের অলক্ষ্যে এভাবেই যুবকরা সিনেমার টাকা জোগাড় করতো।

যুবকরা এতই সিনেমা-পাগল ছিল যে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রায় সব সিনেমাই তারা দেখার চেষ্টা করতো। যুবতীরাও পরিবারের সদস্যদের সাথে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতো। রেডিওতে বিজ্ঞাপন শুনে, নতুন সিনেমা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতো। আর ওই সিনেমাটা নিজের শহরের প্রেক্ষাগৃহে আসার সাথে সাথে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়তো। তবে সিনেমার টিকিট পাওয়া দুষ্কর ছিল। দুর্বল মানুষের দ্বারা টিকেট কাটা সম্ভব ছিল না। কালোবাজারিদের কাছ থেকে দুই-তিনগুণ দামে টিকিট সংগ্রহ করতে হতো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মুখ ও মুখোশ’ ছিল প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র। তখন বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) নির্মাতারা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন। তারপরও তখন অনেক অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৫৯ সন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বেশকিছু চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। তবে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন যত তীব্রতর হয়েছে, ছবি  নির্মাণের প্রবণতাও তত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৬৭, ৬৮, ৬৯ ও ৭০ সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছবি মুক্তি পেয়েছে। লেখার কলেবর বেড়ে যাবে বলে আমি শুধু প্রতিবছর মুক্তি পাওয়া একটি করে ছবির নাম নিচে উল্লেখ করলাম। ছবির নাম উল্লেখ করার কারণটা পরে ব্যাখ্যা করছি- ‘আকাশ ও মাটি’ (১৯৫৯), ‘রাজধানীর বুকে’(১৯৬০), ‘হারানো দিন’ (১৯৬১), ‘জোয়ার এলো’ (১৯৬২), ‘কাচের দেওয়াল’ (১৯৬৩), ‘এইতো জীবন’ (১৯৬৪), ‘রূপবান’ (১৯৬৫), ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’ (১৯৬৬), ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ (১৯৬৭), ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’ (১৯৬৮), ‘নীল আকাশের নিচে’ (১৯৬৯), ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ (১৯৭০) ও ‘নাচের পুতুল’ (১৯৭১) ।

১৯৭০ সালে প্রায় ৩৯টি ছবি মুক্তি পায়। তখন বাংলা ছবির পাশাপাশি কিছু উর্দু ছবিও মুক্তি পেয়েছিল। এবার ছবির নাম উল্লেখ করার কারণটা বলছি। তখনকার চলচ্চিত্রের শিরোনামের মধ্যেও এক ধরণের রুচিবোধ ও নান্দনিকতার ছাপ ছিল। ছবির নামের এই রুচিবোধ ও সৌন্দর্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে স্বাধীনতা-উত্তর চলচ্চিত্রের বেলায়। ১৯৭২ সাল থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টা ছিল বাংলা ছবির ‘সোনালি যুগ’। ওই সময়ের মধ্যে মুক্তিপ্রাপ্ত অসংখ্য ছবির মধ্যে কিছু ছবির নাম- ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ (১৯৭২), ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩), ‘আলোর মিছিল’ (১৯৭৪), ‘আলো তুমি আলেয়া’ (১৯৭৫), ‘প্রতিনিধি’ (১৯৭৬), ‘অনন্ত প্রেম’ (১৯৭৭), ‘অলঙ্ককার’ (১৯৭৮), ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ (১৯৭৯), ‘সখি তুমি কার’ (১৯৮০), ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ (১৯৮১), ‘দুই পয়সার আলতা’ (১৯৮২), ‘পুরস্কার’ (১৯৮৩), ‘ভাত দে’ (১৯৮৪) ও ‘দহন’ (১৯৮৫)।

দেশের লক্ষ লক্ষ যুবক তখন নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। প্রিয় নায়কের পোশাক, চুলের স্টাইল অনুকরণ করার চেষ্টা প্রায় সব যুবকের মধ্যেই কমবেশি দেখা যেতো। বড় সরকারি চাকরি পাওয়া যতটা সহজ ছিল সিনেমার নায়ক হওয়া ততটা সহজ ছিল না।

এসব চলচ্চিত্রের নামের মধ্যে যে শুধু সৌন্দর্য আছে তা-ই নয়, সাহিত্যের ছোঁয়াও আছে। তখন দেশের মানুষ এত শিক্ষিত ছিল না। সিনেমার দর্শকের একটা বড় অংশ ছিল অক্ষরজ্ঞানহীন। কিন্তু এসব সাহিত্যিক নাম তাদের বিভ্রান্ত করতো না বা নামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়ে তারা খুব একটা মাথা ঘামাতো না। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ছবির নাম যাই হোক ছবি ভাল হবেই। শুধু ছবির নাম ব্যবহার করে কেউ কেউ তখন চমৎকার চিঠি লিখে ফেলতো যা বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ছাপা হতো।

ধীরে ধীরে বাংলা চলচ্চিত্রের মান কমতে থাকে। ছবির নামের সৌন্দর্যও হ্রাস পেতে থাকে। এর পেছনে কতকগুলো কারণ ছিল। এর প্রধান কারণ হলো- আশির দশকের শুরুতে বা মাঝামাঝি সময়ে ভিসিআর এর আগমন। ভিসিআর এর আগমনে বাংলা সিনেমা বিভিন্নভাবে পাইরেসি হতে থাকে। ঘরে বসে বিত্তবানরা ভিসিআর-এ ছবি দেখা শুরু করে। ধীরে ধীরে মধ্যবিত্তরাও ভিসিআর-এর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। শুধু বাংলা ছবি নয়, ভিসিআর-এ বিদেশি ছবি দেখারও সুযোগ হয়ে গেল। এক পর্যায়ে দর্শকদের একটা বড় অংশ সিনেমা হল বিমুখ হয়ে পড়লো। সিনেমা হলের মালিকরা পড়লেন বিপাকে। চরম লোকসানের সম্মুখীন তারা। এর প্রভাব পড়তে লাগলো পুরো চলচ্চিত্র শিল্পের উপর।

এদিকে কতিপয় নির্মাতা হালকা, চটুল কাহিনির উপর ছবি নির্মাণ করে বিশেষ ধরণের দর্শক টানার চেষ্টা করলেন। এ ধরণের চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে, ডায়লগে, নৃত্যে, অশ্লীলতার ছড়াছড়ি চলতে লাগলো। এতে এক বিশেষ শ্রেণির দর্শক সৃষ্টি হলো। চমৎকার সাহিত্য নির্ভর রোমান্টিক ডায়লগের পরিবর্তে কুৎসিত গালাগালপূর্ণ ডায়লগই হয়ে উঠলো এ সমস্ত ছবির মূল উপজীব্য। এতে সিনেমা হলে কিছু দর্শকের সমাগম ঘটলেও, শিক্ষিত ও রুচিশীল দর্শক সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগলেন। এ ধরণের নিম্নমানের চলচ্চিত্রগুলোও পাইরেসির শিকার হতে লাগলো। একটি চক্র পাইরেটেড ছবির সিডি বানিয়ে বিক্রি করতে লাগলো। এতে সাধারণ দর্শকও সিডির প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। গুণী পরিচালকরা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিলেন।

১৯৯২ সনে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাঙ্গা’ ছবিটি দর্শককে আবার সিনেমা হলমুখী করলো। ‘দাঙ্গা’ ছিল একটি ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র। পরিচালক ছিলেন কাজী হায়াৎ। এই ছবিতে নায়ক মান্নার অসাধারণ অভিনয় দর্শক হৃদয়ে দাগ কাটে। কাহিনির বৈচিত্র্য দর্শককে দারুণ আকৃষ্ট করে।  তারপর কয়েক বছর মান্না, সালমান শাহ, শাবনূর, পূর্ণিমা ও মৌসুমীর অনেক ছবি দর্শকপ্রিয়তা পায়। আর এই সময়টাও ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। সালমান শাহ-শাবনূর জুটি আলাদাভাবে এক সোনালি অধ্যায় সৃষ্টি করেন। কিন্তু এর স্থায়িত্ব ছিল কম।

ছবি পাইরেসি কিন্তু তখনও চলছিল। তাই সিনেমা হলের দুর্দশা আর রোধ করা গেল না। তাছাড়া, সালমান শাহ ও মান্নার মৃত্যু বাংলা সিনেমায় এক শূন্যতার সৃষ্টি করে। দর্শক যখন সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল বারবার ঠিক তখন হুমায়ূন আহমেদ কিছু অসাধারণ ছবি নির্মাণ করেন। এগুলোর মধ্যে ‘আগুনের পরশমনি’ (১৯৯৪), ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯), ‘দুই দুয়ারী’ (২০০৩), ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ (২০০৬) যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ছবিগুলো বড় পর্দায় দেখার জন্য দর্শক আবার সিনেমা হলমুখী হয়। এসময় আরেকজন ভিন্নধর্মী নির্মাতার আবির্ভাব ঘটে। আর তিনি ছিলেন তারেক মাসুদ। তিনিও দর্শকদের জন্য কিছু ভিন্ন স্বাদের ছবি উপহার দিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল যে, তারেক মাসুদ (২০১১) ও হুমায়ুন আহমেদ (২০১২) সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে বড় অসময়ে চলে গেলেন। তাদের চলে যাবার পর সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে আবারও বড় একটা সংকট দেখা দিলো।

তারপরও কিছু ভাল ছবি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হ্রাস পেতে লাগলো। প্রেক্ষাগৃহগুলো শপিংমল ও  ফ্ল্যাটবাড়িতে পরিণত হতে লাগলো। তাছাড়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও দর্শকের সিনেমা হল বিমুখতার পেছনে কাজ করেছে।

আবার ফিরে আসি সোনালি যুগের সিনেমার কথায়। ওই সময় বাংলা ছবির জনপ্রিয়তার পেছনে কতকগুলো কারণ ছিল। কারণগুলো হলো- দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী, সুন্দর ও রুচিশীল গল্প, দক্ষ ও ডেডিকেটেড পরিচালক। প্রায় প্রতিটি ছবিতে ছিল মনছোঁয়া কিছু অসাধারণ গান। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলচ্চিত্র জগতের সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রী- রাজ্জাক, আলমগীর, জাভেদ, ওয়াসিম, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল, বুলবুল আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, জসীম, শাবানা, ববিতা, কবরী, শবনম, অলিভিয়া, সুচরিতা, রোজিনা, সুবর্ণা মোস্তফা দর্শকের মনে এমনভাবে স্থান করে নিয়েছিলেন যে তারা হয়ে উঠলেন একেবারে আইডল। দেশের লক্ষ লক্ষ যুবক তখন নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। প্রিয় নায়কের পোশাক, চুলের স্টাইল অনুকরণ করার চেষ্টা প্রায় সব যুবকের মধ্যেই কমবেশি দেখা যেতো। বড় সরকারি চাকরি পাওয়া যতটা সহজ ছিল সিনেমার নায়ক হওয়া ততটা সহজ ছিল না। কারণ সুন্দর শারীরিক গঠন, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, চমৎকার অভিনয় পটুতা, নৃত্য ও ফাইটিং-এ দক্ষতা না থাকলে নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

তখনকার চলচ্চিত্রগুলোর জনপ্রিয়তার পেছনে গানের একটা বড় ভূমিকা ছিল। কিছু খ্যাতিমান গীতিকার অসংখ্য কালজয়ী গান লিখে বাংলা সিনেমার সঙ্গীত ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। উনাদের মধ্যে সেরা কয়েকজন হলেন- আবু হেনা মোস্তফা কামাল, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মনিরুজ্জামান, মো: রফিকুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, মাসুদ করিম, আমজাদ হোসেন, খান আতাউর রহমান ও আরও কেউ কেউ। এ মহান গীতিকাররা যেসব কালজয়ী গান লিখেছেন সেসব গানে ছিল মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি ও পতিভক্তি। সর্বোপরি অনেক গানে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তিরও নিদর্শন রয়েছে। তাছাড়া রোমান্টিক গানতো ছিলই। ছবির কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য রেখে লেখা গানগুলো দর্শকের মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতো।

অপূর্ব সুরের মূর্ছনা, কথার ঐন্দ্রজালিক বুনন ও কণ্ঠশিল্পীর মধুর কণ্ঠ দর্শককে এক অন্য জগতে নিয়ে যেতো। একটা রোমান্টিক গান যেমন দর্শককে রোমাঞ্চিত করতো আবার একটা কষ্টের গান শুনে দর্শক অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তো। এসব গান পাষাণ হৃদয়কে গলিয়ে দিতে পারতো, আবার কোন কোন গান অশান্ত হৃদয়ে প্রশান্তির পরশ এনে দিতো। শুধু গান শোনার জন্য একটা ছবি বহুবার দেখেছে এমন দর্শকের সংখ্যাও কম ছিল না। ওই সময়ে কিছু অসামান্য প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পীর আবির্ভাব ঘটে যারা নেপথ্যে কাজ করে নিজেদের কণ্ঠের গান অভিনেতা-অভিনেত্রীর ঠোঁটে তুলে দিতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হলেন- নীনা হামিদ, ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, শাহানাজ রহমাতুল্লাহ, আবেদা সুলতানা, নিলুফার ইয়াসমিন, আঞ্জুমান আরা বেগম, শাম্মী আক্তার, কনকচাঁপা, আব্দুল আলীম, মোস্তফা জামান আব্বাসী, আবদুল জব্বার, সৈয়দ আবদুল হাদী, খুরশেদ আলম, মাহমুদুন্নবী, বশির আহমেদ, এন্ড্রু কিশোর ও সুবীর নন্দী প্রমুখ।

উনাদের মতো প্রতিভাবান শিল্পীদের জন্ম না হলে বাংলা সিনেমার গান এত জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ হত না। তাছাড়া কিছু ক্ষণজন্মা সুরকার অসাধারণ সুর সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সিনেমার গানকে এতটা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। উনাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- আবদুল আহাদ, আজাদ রহমান, আলাউদ্দিন আলী, খান আতাউর রহমান, সত্য সাহা, আলম খান, সুবল দাস, শেখ সাদী খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও মুকুল চৌধুরী প্রমুখ। উনাদের বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি।

মায়ের মৃত্যুতে বা মায়ের অসহায়ত্বে বা হারিয়ে যাওয়া মাকে ফিরে পাওয়ার জন্য সন্তানের যে আকুতি তা যখন গানের মাধ্যমে প্রকাশ পায় তখন দর্শক নিজের মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তো।

ওই সময়ে বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই ছিল সুস্থধারার। চলচ্চিত্রের কাহিনি দর্শকের মনে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতো। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার একটা বড় মাধ্যমও ছিল সোনালি যুগের চলচ্চিত্রগুলো।

এতো গেল চলচ্চিত্রের কাহিনির প্রভাবের কথা। চলচ্চিত্রের গানগুলোও দর্শকের মন প্রচণ্ড  নাড়িয়ে দিত। মায়ের মৃত্যুতে বা মায়ের অসহায়ত্বে বা হারিয়ে যাওয়া মাকে ফিরে পাওয়ার জন্য সন্তানের যে আকুতি তা যখন গানের মাধ্যমে প্রকাশ পায় তখন দর্শক নিজের মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তো।

মাকে নিয়ে রচিত কিছু বিখ্যাত গানের প্রথম কলি: ১. মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারিনা/ দোহাই মা আমার লাইগা আর কান্দিস না (রুনা লায়লা, আগুন), ২. সবাই বল মা, মায়ের দাম কি হয় না/ পৃথিবীতে মায়ের নেই তুলনা/ মাগো তোমার নেই তুলনা (সাবিনা ইয়াসমিন, প্রতিনিধি), ৩. মায়ের মত আপন কেহ নাইরে/ মায়ের মত আপন কেহ নাই/ মা জননী নাইরে যাহার/ ত্রিভুবনে তাহার কেহ নাইরে (রুমানা খান, দিন যায় কথা থাকে)।

‘পতিভক্তির’ কিছু কালজয়ী গান: ১. আমি তোমার বধু  তুমি আমার স্বামী/ খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি (শাম্মী আক্তার, আরাধনা), ২. তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছো/ দুটি চোখের তারায় শুধু আমাকে দেখছো (সাবিনা ইয়াসমিন, জীবন নৌকা), ৩. তুমি আছ বলে আমি সোহাগিনী/ দুটি পায়ে দিয়ে ঠাঁই করেছ ঋণী (সাবিনা ইয়াসমিন ও সৈয়দ আবদুল হাদি, বউরানী) অবশ্য এ গানে পুরুষ কন্ঠেও স্ত্রীর প্রতি অনুরূপ ভালবাসার প্রকাশ পেয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এ গানগুলোর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।

সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি ও ভরসার কিছু গানের কলি- ১. হাত তুলে দরবারে আমি চাই যে দয়া আজ/ দিন দুনিয়ার মালিকরে তুই রাজার মহারাজ (সাবিনা ইয়াসমিন, বিজয়িনী সোনাভান), ২. তুমি রাহিম তুমি কারিম তুমি রহমান/ আমার গোনা মাফ করে দাও আল্লাহ মেহেরবান (সৈয়দ আবদুল হাদী ও সাবিনা ইয়াসমিন, ভাল মানুষ), ৩. তোর বান্দা আজ হাত তুলেছে তোরই দরবারে/ তোর রহমতেরই ভিক্ষা আমায় দেরে মওলা দে (ফেরদৌসী রহমান, ঈমান)।