কেন এত গরম

প্রায় একশ বছর আগেই সতর্ক করেছিলেন সুইডিশ পদার্থবিজ্ঞানী আরহেনিয়াস। কী বলেছিলেন তিনি!

সৌমিত্র চৌধুরীসৌমিত্র চৌধুরী
Published : 4 June 2023, 04:50 PM
Updated : 4 June 2023, 04:50 PM

তীব্র গরম। সারা দেশ জ্বলছে। তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরী। দিনের বেলা বের হলেই প্রচণ্ড গরমের আঁচ লাগছে গায়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে রোদের তীব্রতা যত বাড়ে, গরমে নগরবাসীকে ততটাই গলদঘর্ম হতে দেখা গেছে। পরিত্রাণ কোথায়? কেনই বা বাড়ছে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা?

উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয় বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড আর অন্য কয়েকটি গ্যাস। প্রায় একশ বছর আগে বিজ্ঞানী স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (১৮৫৯-১৯২৭) মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, “বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে চলেছে দ্রুত। গ্যাসটি বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যত পৃথিবীর বড় বিপদ ডেকে আনছে। অতএব সাবধান।”

আরহেনিয়াস ছিলেন একজন সুইডিশ পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি ১৯০৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯০৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আরহেনিয়াসই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন যে বাতাসে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সরাসরি সম্পর্ক আছে। বাতাসে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন আছে ৯৯ ভাগ, বাকি এক ভাগের মধ্যে আছে অল্প পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড। ভূপৃষ্ঠ থেকে যে তাপ নিঃসরণ হয় তা শুষে নেয় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প, পৃথিবীর তাপমাত্রা তাই বেড়ে যায়। এ কারণেই পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে পৃথিবীতে প্রাণ-প্রকৃতির উদ্ভব হয়।

আরহেনিয়াস হিসাবপত্র করে দেখিয়েছেন যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড যদি হ্রাস পেয়ে অর্ধেক হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রি হ্রাস পেতে পারে। এতে পৃথিবীতে আবার বরফযুগ শুরু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে কী হবে? পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাবে, জলবায়ুর বড় পরিবর্তন আসবে।

আরহেনিয়াস প্রায় একশ বছর আগেই আমাদের সাবধান করেছিলেন, কিন্তু আমরা সতর্ক হইনি। তাই আজ বিশ্ব উষ্ণায়ন। দেশে দেশে ভয়ংকর ঝড়-বাদল-তুফান-খরা-বন্যা ঘটে চলেছে। অনেক দেশ জলে ডুবে গেছে, ডুবতে বসেছে বহু দ্বীপরাষ্ট্র। পরিত্রাণ কোথায়? তার আগে অন্য প্রশ্ন। কোন কৌশলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল বা সমুদ্রতলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়? গ্যাসটি তাপ শোষণ করে রাখে বলেই এমনটা ঘটে। কেমন করে?

উত্তর লুকিয়ে আছে গ্যাসটির রাসায়নিক গঠনে। তিনটি মাত্র পরমাণু, একটা কার্বন আর দুটো অক্সিজেন দিয়ে তৈরি রাসায়নিক যৌগ কার্বন ডাই-অক্সাইড। গ্যাসটি শুষে নেয় অবলোহিত আলো বা ইনফ্রারেড লাইট। সূর্যের সাত রঙের বর্ণালিতে দীর্ঘতম তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল আলোর। কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় লাল আলো এবং বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো। ফলে বাতাস উত্তপ্ত হয়। উত্তাপ ঊর্ধ্বাকাশে না গিয়ে মাটিতে ফিরে আসে, যাকে আমরা গ্রিনহাউস ইফেক্ট বলি। গ্রিনহাউস গ্যাসের অন্য সদস্যও করে এমন কাজ। তবে ভূপৃষ্ঠে তাপ ফিরিয়ে আনার কাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইড আর জলীয় বাষ্পের।

আশ্চর্য ঘটনা! নেপথ্যের কারণটাও জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস। বলছেন, বাতাস দুভাবে তাপ ধরে রাখে। বাতাসের মধ্য দিয়ে তাপ প্রবাহিত হওয়ার সময়- যাকে বলা হয় ‘সিলেক্টিভ ডিফিউশন’ এবং তাপ শোষণ বা অ্যাবজর্পশনের মাধ্যমে। বাতাসের অন্য উপাদানগুলোয় যেমন দুই পরমাণুর নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনে তাপের প্রভাবে কম্পন ঘটে। অর্থাৎ দুই পরমাণুর মধ্যকার বন্ধনীর কম্পন। ফলে প্রচুর পরিমাণ তাপ শোষণ করতে পারে তারা।

কিন্তু বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাস্প তাপ গ্রহণ করে শোষণ প্রক্রিয়া বা অ্যাবজর্পশনে। এদের (CO2, H2O) পরমাণুগুলো কাঁপতে থাকে বর্ণালির অবলোহিত বা হিট ইনফ্রারেড অঞ্চলে। কাঁপতে থাকা একটি অণু তাপমোচন বা ইমিশন করলে আরেকটি অনু সেটি গ্রহণ করে কাঁপতে থাকে। অর্থাৎ তাপ ধরে রাখতে পারে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড অনু (CO2)!

তাহলে তাপ থেকে পরিত্রাণ পাবো কীভাবে? পরিত্রাণ গাছের কাজকর্মে। বৃক্ষই পারে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা কমিয়ে রাখতে। কেমন করে? বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে নিজের খাদ্য বানায় গাছ, যাকে ফটোসিন্থেসিস বলে। এ প্রক্রিয়ায় গাছ বাতাসে ছড়িয়ে দেয় অক্সিজেন। বায়ুমণ্ডল শুদ্ধ করার প্রাকৃতিক সম্পদ গাছ, বৃক্ষসমৃদ্ধ অরণ্য।

এমন জেনেও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অরণ্য ধ্বংস করছি আমরা। আমাদের দরকার গাছ লাগানো, বৃক্ষ সম্পদ নষ্ট না করা। গাছ লাগানো মানে যে কোনও গাছ। বড় বৃক্ষ না হোক, বাঁশ-ঘাস-লতা হলেও নিজ গুণে সেই উদ্ভিদ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেবে। অর্থাৎ আমাদের অক্সিজেন জোগাবে, ধরণী শীতল হবে।

গাছ লাগানোর সুযোগ না থাকলে আমাদের অন্য উপায়ও আছে। ফল খেয়ে তার বীজ নষ্ট না করা। বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে মাঠে প্রান্তরে, বাসে বা রেলপথে যেতে যেতে। কিছু পড়বে পাথরে, রুক্ষ মাটিতে। কিছু পড়বে সঠিক মৃত্তিকায়, জন্ম নেবে গাছ।