“আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লিখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।”
Published : 02 Nov 2022, 10:19 PM
১৯৫২ সালের ২-১২ অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সময়ের পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে এ সম্মেলনে যোগ দিতে নয়াচীন সফর করেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ তারই স্মৃতিনির্ভর এক ভ্রমণ কাহিনি।
এ ভ্রমনকাহিনি তিনি লিখেন ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে। শিল্পিত মন ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে সদ্য বিপ্লবোত্তর গণচীনের শাসনব্যবস্থা ও জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন প্রাঞ্জল ভাষায়। এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর সাম্রাজ্যবিরোধী মনোভাব, অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার গভীর পরিচয় মেলে। একজন তরুণ রাজনীতিকের মনন-পরিচয়, গভীর দেশপ্রেম এবং নিজ দেশকে গড়ে তোলার সংগ্রামী প্রত্যয় ফুটে উঠেছে রচনার পরতে পরতে।
অপার সৌন্দর্যপ্রিয়তা, জীবন-সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধদৃষ্টি এবং সঞ্জীবন-তৃষ্ণা এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য। এ ভ্রমণকাহিনি রচনার পটভূমি, বহু ঘাত-প্রতিঘাতে পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ, বর্তমান গ্রন্থ প্রকাশের ইতিবৃত্ত এবং দুর্লভ আলোকচিত্র গ্রন্থটিকে আকর্ষণীয় করেছে। বঙ্গবন্ধুর এ অমিয় ভ্রমণকাহিনি তার অন্য বইগুলোর মতো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
"আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বক্তৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা-রসুলের নাম নেবার সুযোগ পাই। এই তো আমার পরিচয়।”
বইয়ের ভূমিকায় শেখ হাসিনা লিখেছেন, “...এই লেখার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখি পাকিস্তানি শাসকবর্গ পূর্ববঙ্গের মানুষ যারা সংখ্যায় বেশি অর্থাৎ ৫৬ ভাগ, তাদেরকে কীভাবে বঞ্চনা করেছে সে ধারণাও পাওয়া যায়।...প্লেনে চড়ে আকাশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এমনকি ছোটখাটো বিষয়ে যেমন মেঘের ভেতরে বাতাস থাকে না বলে যে প্লেনে বাম্পিং হয় আর সেটা যে ভীতির কারণ তা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন।...বিপ্লবের পর সামাজিক ক্ষেত্রে যে একটা পরিবর্তন আসে তা নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দেশ কীভাবে পরিচালিত করা যায় তা তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।...তিনি শুধু সম্মেলনেই অংশগ্রহণ করেন নাই তিনি এই দেশকে খুব গভীরভাবে দেখেছেন। কৃষকের বাড়ি, শ্রমিকের বাড়ি, তাদের কর্মসংস্থান, জীবনমান সবই তিনি দেখেছেন। ছোট ছোট শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। শিশু বয়স থেকেই দেশপ্রেম ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করার যে প্রচেষ্টা ও কর্মপন্থা তাও অবলোকন করেছেন।”
বইয়ের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর স্বগতোক্তি, “১৯৫২ সালে জেল হতে বের হলাম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর। জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও।... এরপর আছে পাসপোর্ট বানানোর ঝক্কি। তখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সবকিছুর নিয়ন্তা ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী করাচি। পাসপোর্টের প্রথমবারের আবেদনপত্র হারিয়ে যায়। দ্বিতীয়বারের আবেদনপত্রও ঝুলে থাকে কারণ হোম ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নাই।...লাল ফিতার প্যাঁচ। করাচির হুকুম প্রয়োজন। তাহা না হলে পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার কোন জলসাই হয় না।...ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে গেলেও একটা সময় পর্যন্ত ভারতীয় এবং পাকিস্তানিদের বিদেশ ভ্রমণের সময় লিখতে হতো পাকিস্তানি বা ভারতীয় ব্রিটিশ নাগরিক।”
“আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লিখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।”
এটা বঙ্গবন্ধুর বিনয়, কারণ এই বই শেষ করে আপনি অবাক বনে যাবেন বঙ্গবন্ধুর প্রাঞ্জল বর্ণনা পড়ে। এখানে উপমার আধিক্য নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শব্দমালা দিয়েই উনি এক একটা বাক্য তৈরি করেছেন, ফলে প্রত্যেকটা বাক্যই হয়েছে সহজবোধ্য। এই ভ্রমণ কাহিনিতে ভাষার প্রথাগত কোন নিয়ম মানা হয়নি, তাই পড়তে গিয়ে কখনও একঘেয়ে লাগে না। বঙ্গবন্ধু বৃহৎ কোন কিছুর বর্ণনা থেকে শুরু করে একেবারে খুঁটিনাটি বিষয়ও সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে আছে ভ্রমণসঙ্গীদের সাথে খুনসুটি, নয়াচীনের শিশুদেরকে ভেঙচি কাটার মতো ব্যাপারও।
বঙ্গবন্ধুর ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। তার সাথে খুনসুটির বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “মানিক ভাইয়ের কথা কিছু না বললে অন্যায় হবে। মানিক ভাই যে এতো খেতে পারেন সে ধারণা আগে আমার কোনদিন ছিল না। হয়তো কোনদিন একটা মুরগিই খেয়ে ফেলে, সাথে সাথে ডিম, মাছ, ফলফলারি, বসে বসে শুধু খায় আর খায়। মানিক ভাই বলেন- বেশি কথার কাম নাই। খাবার সময় গোলমাল করো না। চুপচাপ খাও, সময় পাওয়া গেছে। দেশে লীগ আমলে কী খেতে পাই মনে নাই। রুমে ফিরে এসে আমি, আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক ভাই খুব হাসাহাসি করতাম, মানিক ভাইয়ের খাওয়া নিয়ে। আমি আর আতাউর রহমান সাহেব মানিক ভাইয়ের পিছনে লেগেই থাকতাম।”
নয়াচীনের একটা সেলুনে চুল কাটাতে গেলে সেলুনওয়ালা যখন তার পরিচয় জিজ্ঞেস করেন তখন বঙ্গবন্ধু মজার একটা উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার আবার পরিচয় কি? কী বলতে পারি? বললাম এমনি ঘুরে বেড়াই, দেশ বিদেশ দেখি। মনে মনে বলি, আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বক্তৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা-রসুলের নাম নেবার সুযোগ পাই। এই তো আমার পরিচয়।”
এ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর শিশু মনেরও পরিচয় মিলে। একদিন নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় দেখে বেরিয়ে একটা ঘটনার বর্ণনা করেছেন এভাবে, “ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কারণ, ওদের আমি একটু ঠাট্টা করেছিলাম, মুখ ভেঙচিয়া দিয়াছিলাম। ওরা মনে করলো, পেয়েছি মনের মতো লোক। তাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ওদের সাথে কিছু খেলা করে রওয়ানা হলাম। আমার বন্ধু-বান্ধবরা আগেই গাড়িতে উঠে বসে রয়েছে। মনে মনে বিরক্ত হলো বলে আমার মনে হলো। কিন্তু কী করবো? ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দময় সঙ্গ যেন হুট করে ছেড়ে আসা যায় না, আর আমার স্বভাবও সেরকম না। ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে আমি ভালোবাসি।”
“আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা প্রিভিলেজড ক্লাস, অন্য দেশে শিল্পপতিরা প্রিভিলেজড ক্লাস; কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই প্রিভিলেজড ক্লাস।"
বঙ্গবন্ধু নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছেন নয়াচীনের শিক্ষা ব্যবস্থা। তার ভাষায়, “আমাদের দেশের মতো কেরানি পয়দা করার শিক্ষাব্যবস্থা আর নাই। কৃষি শিক্ষা, শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।... বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে।... আমাকে একটা কৃষি স্কুল দেখানো হয়েছিল। সেখানে যুবক কৃষকদের কিছুদিনের জন্য শিক্ষা দিয়ে খামার জমিতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়।...মাত্র চার বৎসরে তারা শতকরা ৩০ জন লোককে লেখাপড়া শিখিয়ে ফেলেছে। গর্ব করে আমাকে আবার বললো, ১০ বৎসর পরে যদি চীনে আসেন তবে দেখবেন একটা অশিক্ষিত লোকও নাই।”
পাশাপাশি নিজের মনেই তুলনা করেছেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে। তার ভাষায়, “আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা প্রিভিলেজড ক্লাস, অন্য দেশে শিল্পপতিরা প্রিভিলেজড ক্লাস; কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই প্রিভিলেজড ক্লাস।...নয়াচীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার সাহায্য করবে।...খাওয়া-পরা পেয়ে নয়াচীনের ছেলেমেয়েদের চেহারা খুলে গিয়েছে। মুখে তাদের হাসি, বুকে তাদের বল, ভবিষ্যতের চিন্তা নাই। মনের আনন্দে তারা খেলছে। প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে খেলতে হয়, প্যারেড করতে হয়।”
নয়াচীনের মিল মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে একটা সাম্যাবস্থা তৈরি করা হয়েছে। শ্রমিকদের জন্য মিলের সাথে আছে নার্সিং হোম, হাসপাতাল এবং শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল আছে। এছাড়াও মিলের মালিক চাইলেই ইচ্ছেমতো লাভ করতে পারে না। একটা কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং শ্রমিক প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “আমরা শ্রমিক ও মালিক পাশাপাশি দেশের কাজ করছি। মিলটা শুধু মালিকের নয়, শ্রমিকের ও জনসাধারণেরও। আজ আমাদের মধ্যে কোন গোলমাল নাই। আমরা উভয়েই লভ্যাংশ ভাগ করে নেই। শ্রমিকের স্বার্থও আজ রক্ষা হয়েছে, মালিকের স্বার্থও রক্ষা হয়েছে। চিয়াং কাইশেকের আমলে আমাদের মধ্যে তিক্ততা ছিল। মাঝে মাঝে মিল বন্ধ রাখা হতো। আমাদেরও ক্ষতি হতো আর শ্রমিকদেরও ক্ষতি হতো।”
নয়াচীনে যদি শোনা যায় যে, কোন এলাকায় কোন লোক না খেয়ে মারা গেছে, তবে সেই এলাকার সরকারি কর্মচারীদের কৈফিয়ত দিতে হয়। সন্তোষজনক কৈফিয়ত না দিতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নয়াচীনে একটা বড় সমস্যা ছিল বেকারত্ব। সেই বেকারত্ব দূর করতে সরকার কুটিরশিল্পের দিকে নজর দেয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, “নয়াচীন বেকার সমস্যা দূর করতে চেষ্টা করছে। এজন্য তারা নজর দিচ্ছে কুটিরশিল্পের দিকে। কুটিরশিল্পে সরকার থেকে সাহায্য করা হয়। হাজার হাজার বেকারকে কাজ দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের তাঁতিদের মতো লক্ষ লক্ষ তাঁতি কাপড় তৈয়ার করে সুতা কেটে জীবন ধারণ করে।”
সাংহাই ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকের সাথে আলাপকালে তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানান, “এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষ বেকার আছে, তাদের সরকার টেকনিক্যাল ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করেছে। কাহারও ছয় মাস লাগবে, কাহারও ১ বৎসর, আর কাহারও ৪ বৎসর লাগবে। এদের ট্রেনিং হওয়ার সাথে সাথে কাজ মিলে যাবে। ট্রেনিংয়ের সময় সরকার এদের এলাউন্স দেয়, যদিও তা যথেষ্ট নয়।... তিন বৎসর পরে যদি কোনদিন আসেন তবে দেখতে পাবেন, একটাও আর বেকার লোক নয়াচীনে নাই।” এগুলো দেখেশুনে বঙ্গবন্ধু স্বগতোক্তি করেছেন, “কতবড় সংকল্প এদের মনে।”
"তোমার দেশের রাষ্ট্রদূতরা মনে করে দুনিয়ার মানুষ আহম্মক! আমি বললাম, কেন এ কথা বলছেন? তিনি উত্তর করলেন যে, রাষ্ট্রদূত ও কর্মচারীরা যেভাবে থাকেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও সেভাবে থাকতে পারেন না।"
যে কোন দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সে দেশের কৃষিকাজ। বঙ্গবন্ধু নয়াচীনের কৃষিরও আদ্যোপান্ত খবর নিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, “নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, লাঙল যার জমি তার এই প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে। বড় বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব জমিহীন কৃষকের মধ্যে বন্টন করে দিলো। সত্যিকারের কৃষক জমির মালিক হলো। যে সমস্ত অনাবাদি খাস জমি পড়ে ছিল, তাও ভাগ করে দিলো কৃষকের মধ্যে। হাজার হাজার বেকার কৃষক জমি পেল।... নয়াচীনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে।... যে চাষি সকলের চেয়ে বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারবে, তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। গ্রামে গ্রামে মিউচুয়াল এইড সোসাইটি গড়ে উঠেছে।... এতে সকলের মধ্যে একতা গড়ে উঠেছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য, সকলেই সকলের জন্য - এই নীতির খুব প্রচার হয়েছে এবং কাজও সেইভাবে হতেছে। গ্রামের গরিব চাষিরা একতাবদ্ধ হয়ে চাষাবাদ করাতে মানুষের মধ্যে বিভেদ ভাব দিন দিন দূর হয়ে যেতেছে।”
যে কোন দেশের উন্নয়নই টিকসই হতে পারে না যদি এতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করা যায়। নয়াচীনের সরকার এই জায়গাটাতে নজর দিয়েছিল এবং রাষ্ট্রীয় সব কাজে জনগণকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাতো। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “চীনের সরকারের কাজের একটা কায়দা আছে। তারা সকল কাজেই জনগণের সাহায্য চায়। জনগণ বুঝতে পারে এ কাজ তাদের মঙ্গলের জন্য, তাই সরকার যখনই ডাক দেয়, লক্ষ লক্ষ লোক তাতে সাড়া দেয়। এক জায়গায় শুনলাম, সরকার ডাক দিলো - একশত মাইল একটা রাস্তা করতে হবে। তোমাদের যথেষ্ট অসুবিধা হতেছে; সরকারের অত টাকা নাই, তাই তোমাদের নিজেদের কাজ নিজেদের করাই উচিত। প্রত্যেকের আসতে হবে, অন্তত ২ দিন কাজ করতে হবে। সমস্ত লোক এসে কাজ শুরু করলো, সরকার তাদের খাবার দিলো। নারী পুরুষ নির্বিশেষে ১ মাসের ভিতর রাস্তা করে দিল।... এমন বহু ছোট বড় কাজ এই তিন বৎসরে চীন সরকার করেছে।”
দুর্নীতি যেকোন দেশের জীবনমান উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। সমাজের প্রতিটা স্তর থেকে এর নির্মূল সম্ভব না হলে সমাজে কখনোই সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব না। নয়াচীন সরকার দুর্নীতি তুলে দিতে ছিল বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, “নয়াচীন থেকে দুর্নীতি তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে, রাষ্ট্রের কর্ণধাররা ঘুষ দুর্নীতি তুলে দিতে বন্ধপরিকর। আমি নয়াচীনে একটা ঘটনা শুনেছিলাম যে, মাও সে তুংয়ের একজন প্রধান বন্ধু এবং নয়াচীনের নেতা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিল বলে তাকে বিচার করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ইচ্ছা করলে মাও সে তুং তাকে রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু বিচারে যাকে ফাঁসির হুকুম দিয়েছে তাকে রক্ষা করা অন্যায়।” এটা দেখে বন্ধবন্ধু স্বগতোক্তি করেছেন, “দুর্নীতি সমাজের ক্যান্সার রোগের মতো। একবার সমাজে এই রোগ ঢুকলে সহজে এর থেকে মুক্তি পাওয়া কষ্টকর।...ফাঁসি যদি কাহাকেও দিতে হয়, তবে চোরাকারবারি ও দুর্নীতিপরায়ণ লোকদেরই দেয়া উচিত।”
এ সফরে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্র বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। একটা রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র প্রতিনিধির উপর দেশের ভাবমূর্তির অনেকটাই নির্ভর করে। সফরে বিভিন্ন দেশের ডেলিগেট এসেছিলেন। তাদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু বিদেশে তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির একটা ধারণা পান। তার লিখেছেন “অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি আমার সাথে আলাপ করতে করতে বললেন, তোমার দেশের রাষ্ট্রদূতরা মনে করে দুনিয়ার মানুষ আহম্মক! আমি বললাম, কেন এ কথা বলছেন? তিনি উত্তর করলেন যে, রাষ্ট্রদূত ও কর্মচারীরা যেভাবে থাকেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও সেভাবে থাকতে পারেন না।...দেশের মানুষ না খেয়ে মরে সেই দেশের কর্মচারী অথবা রাষ্ট্রনায়করা যেভাবে বাজে খরচ করে তা ভাবলে আমাদেরও লজ্জা হয়।” বিদেশে দেশের পরিচয়ও অনেকটাই নির্ভর করে দূতদের উপর। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার একটা দেশের ডেলিগেট বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান কি একটা স্বাধীন দেশ না ভারতের একটা প্রদেশ?’
নয়াচীনের মানুষের দেশপ্রেমও বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল। চীনের মানুষের দেশপ্রেম নিয়ে লিখেছেন, ‘পহেলা অক্টোবর নয়াচীনের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হবে।... চীনে এই দিনটাকে লিবারেশন ডে বলা হয়।... এই দিন সমস্ত চীনের লোক কাজকর্ম ছেড়ে আনন্দ করে। দিন দিন যে আনন্দ বেড়ে চলেছে এদের। এইদিন প্রত্যেকে তাদের কাজের হিসাব নেয় ও দেয়। দেশের জন্য কী করেছে এক বৎসরে কী কী ভালো কাজ করেছে। দেশ কতদূর অগ্রসর হয়েছে? রাস্তা কত হয়েছে? শিল্প কতগুলি বেড়েছে। কৃষক জমি পেয়ে কত বেশি ফসল উৎপাদন করেছে? এইদিনে তারা তার হিসাব করে। যার যা ভালো কাপড় আছে তা বের করে পরে।”
অবশেষে লেখাটা শেষ করেছেন একটা সুন্দর দেশের ইচ্ছে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, “আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবনবোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।”
দেশকে ভালোবাসার এবং বিদেশের মাটিতে দেশের সম্মান রক্ষা করার বিষয়েও এ বইয়ে বঙ্গবন্ধু একটা ধারণা দিয়েছেন, “আমরা হংকং থাকতে সভা করে নিয়েছিলাম, আমাদের দেশের ভিতরের খবর কেহ সভায় বলবো না এবং আলোচনা করবো না। আমাদের দেশের মুসলিম লীগের শাসনের কথা যদি বলি তবে দুনিয়া হাসবে। কারণ, মুসলিম লীগের গণতন্ত্রের যে রূপ তা কোনো সভ্য সমাজে না বললেই ভালো হয়। কারণ, তাতে পাকিস্তানের ইজ্জত যাবে।”
বঙ্গবন্ধু গোছানো মানসিকতার একটা পরিচয় পাওয়া যায় বইয়ের শেষে ভ্রমণের নোটগুলো পড়ে। আসলে যেকোন লেখা শুরু করার আগে এভাবে নোট নিয়ে নিলে লেখাটা অনেক সহজ হয়ে যায় এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেন বাদ না পড়ে সেটাও নিশ্চিত করা যায়। শেষে যুক্ত করা দুর্লভ আলোকচিত্রগুলো বইটিকে যেন পূর্ণতা দিয়েছে।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!