ডেঙ্গুতে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত যত রোগী মারা গেছে, এই সময়ে এত রোগী আগে কখনও দেখেনি বাংলাদেশে। অথচ ‘পিক সিজন’ এখনও আসেনি।
Published : 21 Jul 2023, 01:10 AM
চার বছর আগে ডেঙ্গু রোগী লাখের ঘর ছাড়ালেও চলতি বছর পরিস্থিতি ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ভীতি ছড়াচ্ছে।
এ বছরের প্রতি মাসে যে পরিমাণ রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তা গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত জানুয়ারি থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭ হাজার ৫৪৭ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৫৫ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুলাই মাস পর্যন্ত এত রোগী আর কখনও হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পরিমাণও এত ছিল না।
এ বছর দেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এর আগে কেবল ২০১৯ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল।
অতীতের বছরগুলোতে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত বাড়তে থাকে জুলাই মাস থেকে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সংক্রমণ চূড়ায় অবস্থান করে, পরে কমতে থাকে।
অতীতের এই প্রবণতার কারণে ২০২৩ সাল ডেঙ্গুর প্রকোপে ভয়াবহ একটি বছর হতে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা সংস্থা আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরড ডটকমকে বলেন, “গত বছর ডেঙ্গুর পিক ছিল অক্টোবর মাসে। এবারও সেদিকে যাচ্ছে। এখন যে অবস্থা তা উঠতির দিকে। অক্টোবরের আগেই পিকে চলে যায় কি না, বলা যাচ্ছে না।
“যে পরিস্থিতি, তাতে বলা যায় এই ধারা চলবে আরও কয়েক মাস। গত বছর শীতের সময়ও রোগী পাওয়া গেছে। ভর্তি রোগীর সংখ্যায় ২০১৯ কে ছাড়িয়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।”
অন্য জটিল রোগ আছে? ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ
ডেঙ্গু: আক্রান্ত বেশি পুরুষ, মৃত্যু বেশি নারীর
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের এলাকা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে।
এখন ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “একে মহামারী হিসেবে গণ্য করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে কাজ হবে না।”
তবে পরিস্থিতি এখনও মহামারীর পর্যায়ে যায়নি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম।
তিনি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “মহামারীর একটা ব্যাখ্যা আছে। সেটার সঙ্গে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর অবস্থা যায় না বলেই আমি জানি।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইডিস মশা এখনও পর্যন্ত যে পর্যায়ে আছে, রোগীর বাড়ার ধারা, ডেঙ্গুর মৌসুম বিশ্লেষণ করলে বলা সামনে অবস্থা আরও খারাপ হবে।
“এখনও ডেঙ্গুর মূল মৌসুম আসেনি। এখনও আমরা সংক্রমণের সর্বোচ্চ যাইনি। আগামী মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আক্রান্তে ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা আছে।”
নগরায়নের চরিত্র বদলানোয় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস মশা এখন কেবল বর্ষা নয়, সারা বছরই থাকছে জানিয়ে সব সময় সতর্ক থাকার তাগিদও দিয়েছেন মশা নিয়ে কাজ করে আসা এই কীটতত্ত্ববিদ।
তিনি বলেন, “মশা সারা বছরই ছিল। বৃষ্টিপাত বাড়ায় মশার ঘনত্ব আরও বেড়েছে। আর মানুষের শরীরে ভাইরাসের লোড ছিল। সেটাও ডেঙ্গু ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। আবার কোভিড পরবর্তী সময়ে জ্বর নিয়ে মানুষের একটা গা ছাড়া ভাব আছে। এসবের মিলিত ফল হচ্ছে ডেঙ্গুর এই বিস্তার।”
তুলনামূলক পরিস্থিতি
বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য রাখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০০০ সালে সারাদেশে ৫,৫৫১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, মারা যান ৯৩ জন।
২০০১ সালে ২৪৩০ জন, ২০০২ সালে ৬২৩২ এবং ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই তিন বছরে মৃত্যু হয় যথাক্রমে ৪৪, ৫৮ এবং ১০ জনের।
এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কখনোই চার হাজারের ঘরে পেরোয়নি। কোনো বছরেই ১৪ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ১৬ হাজার ২৫৩ জন রোগী ভর্তি হন। এ বছর জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনেই সংখ্যাটি ছাড়িয়ে গেছে।
ওই বছর সর্বোচ্চ ৫২ হাজার ৬৩৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল অগাস্ট মাসে।
এ বছর জানুয়ারি মাসে হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি ছিল ৫৬৬ জন। এর আগে সর্বোচ্চ ১৯৯ জন রোগী ভর্তি ছিল ২০২০ সালে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬৬ জন। এটিও ছিল রেকর্ড। এর আগে শীত কমে আসার এই মাসে সর্বোচ্চ ৫৮ জন রোগী ভর্তি হয় ২০১৭ সালে। সেটিও ছির আগের ১০ বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
১১১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিল চলতি বছরের মার্চে। এই মাসে এর আগে সর্বোচ্চ ৩৬ জন রোগী দেখা গেছে ২০১৭ সালে।
গ্রীষ্মের প্রথম মাস এপ্রিলে এবার ১৪৩ জন, মে মাসে ১০৩৬ জন এবং জুনে পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ভর্তি হন হাসপাতালে।
২০১৭ সালের মে মাসে ৭৩ জন, ২০১৯ সালের মে মাসে ১৯৩ জন এবং ২০১৯ সালের জুনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৮৪ জনের ভর্তি হওয়ার রেকর্ড ছিল।
চলতি বছর যে ১৫৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তার মধ্যে ১০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে জুলাইয়ের প্রথম ২০ দিনে।
বাংলাদেশে এর আগে পুরো বছর জুড়েই এর চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল মাত্র তিনবার। ২০১৯ সালে ১৭৯ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন এবং ২০২২ সালে ১৮১ জন।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মাসভিত্তিক তথ্য মেলেনি। তবে এই ছয় বছরে দেশে প্রকোপ অতটা বেশি ছিল না।
২০১৯ সাল থেকে চলতি চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মাসভিত্তিক যে হিসাব তাতে কোনো মাসে এত রোগী মারা যায়নি।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে মৃত্যু হয়েছিল ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই বছর একমাসে সর্বোচ্চ ৮৩ জনের মৃত্যু হয় অগাস্ট মাসে।
২০২০ সালে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম। সে বছর ১ হাজার ৪০৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয় তাদের মধ্যে ৭ জন মারা যায়।
২০২১ সালে জুলাইয়ে ১২ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই মাসে ৯ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
মোকাবেলার পথ কী?
ডেঙ্গু পরিস্থিতি এমন হয়ে ওঠার জন্য প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন।
সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য প্রশাসন ও নগর কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতিকে ‘গা ছাড়া ভাবে’ দেখছে। এ কারণেই এ অবস্থা।
“সরকারের উচিৎ, এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। এটাকে মহামারীর মত পরিস্থিতি হিসাবে মোকাবেলা করা।”
পরিকল্পিত উপায়ে লড়াই করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যে সম্ভব, তার নজির হিসেবে কলকাতাকে দেখান নিনি।
ডেঙ্গুর এমন বিস্তার ‘গা ছাড়া ভাবের’ খেসারত: ড. মুশতাক
ড. মুশতাক বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখন যে কাজ হচ্ছে সেটা রুটিন কাজ। স্থানীয় সরকার,স্বরাষ্ট্র- এই তিন মন্ত্রণালয় মিলে একটা সমন্বিত জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
“প্রত্যেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডেঙ্গু রোগীকে শনাক্ত করে তিন পর্যায়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে, মাধ্যমিক পর্যায়ে এবং জরুরি রোগীদের জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হবে।”
আক্রান্ত সবাইকে চিকিৎসার মধ্যে রাখলে রোগ ছড়ানো নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গুরুতর রোগীও কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
মশা নিধন নিয়ে ড. মুশতাক বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে যে কমিটি করার কথা বলা হয়েছিল সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
“কমিটির ভলান্টিয়াররা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেবে ডেঙ্গু রোগী আছে কি না? তারা স্থানীয়দের নিয়ে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করবে। রোগী পাওয়া গেলে তাকে হাসপাতালে পাঠাবে।”