“বেইজমেন্টে যে মশা জন্মায়- সে বিষয়ে তেমন সচেতনতা তৈরি করা হয়নি। এ কারণে ওই জায়গাটায় বাড়ির মালিকরাও নজর দেন না,” বলেন ড. কবিরুল বাশার।
Published : 16 Jul 2023, 01:11 AM
মশার প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ঢাকায় বিভিন্ন বহুতল ভবনের বেইজমেন্ট। বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক বহুতল ভবন এবং নির্মাণাধীন স্থাপনার বেইজমেন্টে জমে থাকা পানিতে জন্মাচ্ছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস মশা।
চলতি মৌসুমে রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও ভবনের সেই ভূগর্ভস্থ অংশ নিয়ে অনেক ভবন মালিকের উদাসীনতা কাটছে না।
নগর সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা দেখছেন, বেইজমেন্টের নালায় গাড়ি ধোয়ার পানি, পানির পাম্প এবং দেয়াল চুঁইয়ে আসা পানি জমছে। সেই পানি অপসারণ না করায় সেখানে ডিম দিচ্ছে এইডিস মশা।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ভবনের বেইজমেন্টে এইডিস মশার ডিম থেকে লার্ভা জন্মানোর সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ পায়। কিন্তু ভবন মালিকরা সেখানে মশা নিধনে তেমন নজর দেন না, এ কারণে সামান্য পানি পেলেই সেখানে মশার প্রজনন হয়।
দেশে গত এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন রেকর্ড ১৬২৩ রোগী; তাতে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৫৪ জনে।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১০০ ডেঙ্গু রোগী, তাদের অর্ধেকেরও বেশির (৫৩ জন) মৃত্যু হয়েছে চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে।
গবেষণার সঙ্গে সাযুজ্য
ঢাকায় এইডিস মশার উপস্থিতি জানতে গত ১৮ থেকে ২৭ জুন ঢাকার ৯৮টি ওয়ার্ডে প্রাক-বর্ষা জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এইডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত সেই জরিপের ফল প্রকাশ করা হয় ৪ জুলাই।
তাতে বলা হয়, জরিপ চলার সময় ৩ হাজার ১৯০টি ভেজা পাত্র পরিদর্শন করে ৭২২টিতে এইডিস মশার লার্ভা মিলেছে।
সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে ভবনের বেইজমেন্টের পানি জমে থাকা মেঝেতে। এই হার ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম লার্ভা পাওয়া গেছে ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত টায়ারে, যার হার ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের মিল দেখতে পাচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সম্প্রতি সংস্থা দুটি যে অভিযান শুরু করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ ভবনের বেইজমেন্টেই মিলছে লার্ভা।
ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম গত ৮ জুলাই মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি, পিসি কালচার হাউজিং এবং রি-রোডের ছয়টি বাড়ির বেইজমেন্টে যান। এ সময় পাঁচটি ভবনের বেইজমেন্টে এইডিস মশার লার্ভা মেলে।
এরপর সোমবার মেয়র আতিকুল ইসলাম কারওয়ানবাজার এলাকার সরকারি-বেসরকারি আটটি ভবনের বেইজমেন্ট পরিদর্শন করে পাঁচটিতে এইডিস মশার লার্ভা পান।
উত্তর সিটির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা সারওয়ারও নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রমে যাচ্ছেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এবার বিভিন্ন ভবনের বেইজমেন্টে জমে থাকা পানিতে সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।
“বেশিরভাগ ভবনের বেইজমেন্টে গাড়ি ধোয়া হয়। মাটির নিচে দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলায় পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকে না। এসব জায়গা থেকে পানি সরানোও খুব কঠিন। প্রথমে পানি সমতল লেভেলে আনতে হবে। তারপর পানি ড্রেনে যাবে। এই সুযোগটা নিচ্ছে মশা। পানি জমে থাকলে সেখানে ডিম পাড়ছে, লার্ভা হচ্ছে।”
অভিযানে বেশিরভাগ বাড়ির বেইজমেন্টেই লার্ভা মিলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মঙ্গলবার অঞ্চল-৪ এর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাতটি বাড়ির বেইজমেন্টে গিয়ে চারটিতেই এইডিস মশার লার্ভা পেয়েছি। এই চিত্র মোটামুটি সব এলাকার।”
একই ধরনের তথ্য দিচ্ছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বাড়ির বেইজমেন্ট। আমরা (বেইজমেন্টের) যেখানেই হাত দিচ্ছি, সেখানেই মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। স্থাপনার অন্যান্য অংশের চেয়ে বেইজমেন্ট অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে আমাদের জন্য। আমরা ব্যাপকভাবে লার্ভা পাচ্ছি।”
ভবনের বেইজমেন্টের পরিবেশ এইডিস মশার লার্ভা জন্মানোর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ কারণে সেখানে লার্ভা বেশি জন্মায়।
“সেখানে আলো, বাতাস কম। তাপমাত্রাও তুলনামূলক কম। এ ধরনের পরিবেশ এইডিস মশার লার্ভা জন্মানোর জন্য সবচেয়ে ভালো।”
ড. কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেইজমেন্টে যে মশা জন্মায়- সে বিষয়ে তেমন সচেতনতা তৈরি করা হয়নি। এ কারণে ওই জায়গাটায় বাড়ি মালিকরাও নজর দেন না।”
সরেজমিন যা মিলল
ঢাকার কয়েকটি এলাকায় ঘুরে ভবনের বেইজমেন্টে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ ভবনের মালিক বা কর্মীরা দাবি করছেন, তারা নিয়মিত পানি পরিষ্কার রাখেন। সামান্য পানিতেও যে লার্ভা হতে পারে তা জানা ছিল না তাদের।
মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের বড়বাগ এলাকায় অভিযানে গিয়ে অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অব সেপটিক অ্যাবরশন-বাপসা ভবনের বেইজমেন্টে লার্ভা পায় ঢাকা উত্তর সিটির কর্মীরা।
বাপসার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মামুন হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের বন্ধ থাকায় সবাই ছুটিতে ছিল। এ কারণেই লার্ভা জন্মানোর সুযোগ ছিল।
“আমরা ছুটিতে থাকায় স্টাফরা বিষয়টা সেভাবে খেয়াল করে নাই। আমরা সাধারণত নিচতলা সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখি। আমরা না থাকার কারণেই এটা হয়েছে।”
বড়বাগ এলাকার নির্মাণাধীন একটি বহুতল আবাসিক ভবনের বেইজমেন্টে গিয়ে সেখানেও মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
ওই ভবনের মালিক শাহী নূর গাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ভবনের বেইজমেন্টে পানি জমতে দেন না। তারপরও দেয়াল বেয়ে পানি জমেছিল।
“উপরে থেকে নিচে পানি আসছিল। সেখানে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। আমরা তো ডেইলিই কাজ করছি, সেখানে লার্ভা হওয়ার কথা না!”
বৃহস্পতিবার মহাখালীর আরজেড চেম্বার ভবনের বেইজমেন্টে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে নালায় পানি জমে আছে। আলো ফেলে দেখা গেল এইডিস মশার অসংখ্য লার্ভা।
ওই ভবনের ইলেকট্রিশিয়ানসহ কয়েকজন চালক বেইজমেন্টে ছিলেন। তারা জানালেন, সেখানে মাঝেমধ্যে গাড়ি ধোয়া হয়। এছাড়া পানির পাম্পের কিছু পানি নালায় এসে জমে। তবে সেখানে যে লার্ভা হতে পারে, সে বিষয়ে তাদের জানা নেই।
বেইজমেন্টের একপাশের ছোট চৌবাচ্চা দেখিয়ে ইলেক্ট্রিশিয়ান রকিবুল হাসান বলেন, নিয়মিত পানি অপসারণ করেন তারা।
“আজও এইখান থেকে পানি তুলে ফেলে দিয়েছি। ড্রেনও নিয়মিতই পরিষ্কার করা হয়।”
ওই ভবনের সেক্রেটারি জাহিদ হাসান বলেন, “আমি নিয়মিত ভবন তদারক করি। কালও তাদের নির্দেশনা দিয়েছি পানি সরানোর জন্য।”
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্মাণাধীন ভবনগুলোর তদারকির দায়িত্ব রিহ্যাবের উপর পড়ে। কিন্তু যেসব ভবন নির্মাণ শেষে মালিকদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটার দায় আর রিহ্যাবের ওপর পড়ে না।
“নির্মাণাধীন স্থাপনা যেন নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়, সেজন্য আবাসন ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত বার্তা দিচ্ছে রিহ্যাব। আমি প্রতি সপ্তাহে দুটি করে এসএমএস পাঠাচ্ছি আমাদের সব মেম্বারদের। আমি মেম্বারদের সচেতন করছি। আমি এরচেয়ে বেশি কি করতে পারি বলেন?”
রিহ্যাব সভাপতি বলেন, “ভবনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন না করায় কোনো কোনো ভবনে লার্ভা পাওয়া যায়। আমরা নিয়মিত ক্যাম্পেইন করছি, এর কিছুটা ফল পাওয়া গেছে। এবার নির্মাণাধীন ভবনে লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে কম।”
ফ্ল্যাট মালিকদের কোন্দলও অনেক ক্ষেত্রে ভবন ব্যবস্থাপনায় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করেন শামসুল আলামিন।
তিনি বলেন, “বহুতল ভবনগুলোর মধ্যে কিছু ভবন পরিচালনা করা হয় ভালোভাবে, সেখানে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক জায়গায় ফ্ল্যাট মালিকদের নিজেদের মধ্যেই মিল নেই, যার প্রভাব পড়ছে।
“কিছু কিছু ভবন আছে- যেগুলো প্রফেশনালি হ্যান্ডল করে, সেখানে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু কিছু ভবন আছে, যাদের মধ্যে সমন্বয় নাই। একটি ভবনে একাধিক কমিটি, কেউ কাউকে মানে না, মালিক-ভাড়াটিয়ার মধ্যে মিল নাই। এসব ভবনে অনিয়ম হচ্ছে বেশি।”