“ডেঙ্গুকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটা যে জনস্বাস্থ্যের জরুরি সমস্যা, সে চিন্তা থেকে কাজ হচ্ছে না,” বললেন ড. মুশতাক হোসেন।
Published : 13 Aug 2023, 01:27 AM
হাতে ডাব, ফল আর খাবারের প্যাকেটে নিয়ে মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালের ফটক দিয়ে ঢুকছিলেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাজিম উদ্দিন। তার ভাই আর বোন ডেঙ্গু নিয়ে রাজধানীর এ হাসপাতালে ভর্তি।
গত সপ্তাহে ছোট্ বোনের ডেঙ্গু ধরা পড়লে শিবচরের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন নাজিমরা। বোনকে দেখাশোনা করছিলেন বড় ভাই। বোনের অবস্থার অবনতি হলে রোববার তাকে ডিএনসিসি হাসপাতালে নিয়ে আসেন তারা। সোমবার বড় ভাইয়েরও ডেঙ্গু ধরা পড়ে, শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকেও একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অসহায় কণ্ঠে নাজিম বললেন, “দুইজনরে নিয়া দৌঁড়াইতে হইতেছে। ওইদিকে বাড়িতেও দোকান সামলানোর লোক নাই। খুব পেরেশানির মধ্যে আছি। বোনের শরীর এখন কিছুটা ভালো, কিন্তু ভাই কিছু খাইতে পারে না, বমি করে দেয়।”
ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার শুরু হয়েছিল বর্ষা শুরুর অনেক আগেই; তখন থেকেই বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে আসছিলেন। কিন্তু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এড়ানো যায়নি।
অগাস্ট মাসে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে; প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হচ্ছে দশ জনের বেশি মানুষের।
ডেঙ্গু আক্রান্ত মেয়েকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে চিকিৎসকের সঙ্গে মারামারি করে গ্রেপ্তার হয়েছেন এক বাবা। মিটফোর্ড হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের বলা হচ্ছে, মেঝেতে বিছানা পাতার জায়গা আছে কি না দেখে নিতে।
পরিস্থিতি কতটা নাজুক, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরের কথায় স্পষ্ট।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ডেঙ্গু রোগী কমছে না, সারাদেশেই বাড়ছে। রোগীর ভিড় সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।
“আমরা আমাদের মতো র্যাশনালাইজ করে ম্যানেজ করছি। বিভিন্ন হাসপাতালে যাচ্ছি, বলছি যাদের প্রয়োজন আছে শুধু তাদরে ভর্তি নেওয়ার জন্য। যাদের ওয়ার্নিং সাইন নাই তারা টেলিমেডিসিন নেবে।”
গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই কমবেশি ভোগাচ্ছে এইডিস মশাবাহিত এই রোগ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা এবং পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পেলেও বাংলাদেশ পারছে না কেন?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে কয়েকটি কারণের কথা বলছেন।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু হয় প্রতিবছরের মৌসুমের শুরুতে; দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত কোনো উদ্যোগ এখানে অনুপস্থিত।
কয়েক বছরে এই রোগটি ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়লেও এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণের বেশিরভাগ উদ্যোগ শহরকেন্দ্রিক।
আর সবাই একবাক্যে বলছেন, এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মানুষের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভারতের কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সারাবছর ধারাবাহিকভাবে কাজ করায়। বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটা যে জনস্বাস্থ্যের জরুরি সমস্যা, সে চিন্তা থেকে কাজ হচ্ছে না।”
এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ৮২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান ধারায় রোগী বাড়তে থাকলে ২০১৯ সালের এক লাখ রোগীর রেকর্ড এ মাসেই ভেঙে যওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এরই মধ্যে ৩৮৭ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এক বছরে এত মৃত্যু আর কখনও বাংলাদেশকে দেখতে হয়নি।
যারা আক্রান্ত হয়ে পরীক্ষা করান না, বা পরীক্ষা করালেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না, তাদের সংখ্যা এই হিসাবে আসেনি। ফলে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
ডেঙ্গু সারা বছর, সারাদেশে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ৫ জুন পর্যন্ত সারাদেশে ভর্তি রোগীর ২৮ দশমিক ০৯ শতাংশ ছিল ঢাকার বাইরের। সেই হার ৫ অগাস্টে বেড়ে হয়েছে ৪৬ দশমিক ০৩ শতাংশে।
গত ৩১ জুলাই থেকে ৭ অগাস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনই ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে রোগী ভর্তি হচ্ছে বেশি। অথচ ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু মোকাবেলার উদ্যোগ সামান্য।
ঢাকা ও চট্গ্রামের পর এ বছর সবচেয়ে বেশি রোগী বরিশাল বিভাগে। এ বিভাগে এ বছর ৭ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। রোববার পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ১০৫৮ জন রোগী এসেছেন পিরোজপুর জেলা থেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নে গত মাসে চালানো জরিপে মশার উপস্থিতি পাওয়া গেছে ঝূঁকিপূর্ণ মাত্রায়।
অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগের পরিচালক ডা.শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যতগুলো জায়গায় গেছি, সবখানেই এইডিস মশার মাত্রারিক্ত উপস্থিতি পেয়েছি। এই প্রতিবেদন আমরা সব জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। মশা নিধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও বলেছি।”
ওই এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম কেমন চলছে জানতে চাইলে বলদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো.সাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের ইউনিয়নে মশা নিধনে কোনো কার্যক্রমই নেই।
“আমাদের ইউনিয়নে অনেক মশা। তবে মশা মারতে আমাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। কোনো ওষুধ, মেশিনও আসে না।”
ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোনো কার্যক্রম চালানো হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরাও কোনো কার্যক্রম চালাই না।”
আলোচনায় কলকাতা মডেল, বাংলাদেশ কী করছে
ভারতের কলকাতায় এক সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকলেও সমন্বিত উদ্যোগে তা একদমই নিয়ন্ত্রণে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ৩১ জুলাই বিধানসভায় জানান, এ বছর পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে চার হাজার জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯০০ জন রোগী। এ পর্যন্ত রাজ্য আটজনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। তাদের মধ্যে কলকাতায় ২৯০ জন রোগী শনাক্ত এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে।
কলকাতায় মশা নিয়ন্ত্রণে তিনটি স্তরে কাজ করা হয়। প্রথমে প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যায়ে, কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে একটি বারা এবং সবগুলো বারার কার্যক্রম তদারক করে মিউনিসিপ্যালিটি।
নগর কর্তৃপক্ষের পাঁচজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যারা মশা নিয়ে নিয়তিম গবেষণা কার্যক্রম চালান। ৩২টি র্যাপিড অ্যাকশন টিম আছে, প্রতিটি টিমের জন্য একটি করে গাড়ি দেওয়া আছে। ডেঙ্গু শনাক্ত কেন্দ্র করা হয়েছে।
প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রক্ত পরীক্ষাসহ সব ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ৩০০ জন চিকিৎসক কাজ করছেন। প্রতিদিন যত ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়, তার রিপোর্ট নেওয়ার জন্য একজন লোক ঠিক করা আছে।
কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গত ১২ বছরে একটি কাঠামো তৈরি করেছেন তারা। এখন সেভাবে কাজ চলছে।
“আমরা সারাবছরই কাজ করি। আমরা ধোয়া দিই না, মশাকে উৎসে নির্মূলে জোর দিয়েছি। এজন্য কলকাতা শহরে সাড়ে তিন হাজার প্রশিক্ষিত কর্মী আছে। তারা প্রতি সাতদিন অন্তর একটি এলাকায় যায়। তারা মশা দেখলেই চিনতে পারে। রোগী শনাক্ত, ওই রোগীর বাড়ির আশপাশে আরও রোগী আছে কি না দেখে। সে অনুযায়ী মশক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা তারা নেয়।”
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় মশা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চিফ ভেক্টর কন্ট্রোল অফিসার দেবাশিষ বিশ্বাস।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মানুষকে শুধু সচেতন নয়, সক্রিয় করেছেন তারা। কারও বাড়িতে মশার লার্ভা পাওয়া গেলে প্রথমদিন সতর্ক করে মশা নির্মূলে প্রয়োজনীয় কৌশলগুলো দেখিয়ে আসা হয়। কিন্তু সাতদিন বা দশদিন পর গিয়ে আবার লার্ভা পেলে জরিমানা করা হয়।
“আপনি যদি মানুষকে শুধু মুখে বলেন সচেতন হতে, তারা হতে চায় না। সচেতন হয়, সক্রিয় হয় না। এজন্য আইনের চড় দিতে হবে। সমাজের মানুষ যদি ভাবে, এটা তো সরকারি সিস্টেমের কাজ, তাহলে তারা সক্রিয় হবে না। কিন্তু এটা সামাজিক আন্দোলনের কাজ। এটা তৈরি করতে গেলে একটি কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে সমাজ সক্রিয় হবে না।”
সিঙ্গাপুরে মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে দেশটির ন্যাশনাল এনভায়ারনমেন্টাল এজেন্সি-এনএআই। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নিয়মিত গণপরিসর, নির্মাণাধীন ভবন, বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ডেঙ্গু মশার প্রজননস্থল খুঁজে ধ্বংস করে।
আর বাংলাদেশে কীভাবে কাজটি হয়? ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে দুই সিটি করপোরেশন।
সকালে লার্ভিসাইডিং এবং বিকেলে অ্যাডাল্টিসাইডিং করেন সিটি করপোরেশনের মশক কর্মীরা। সিটি করপোরেশন মশা মারতে কীটনাশক ছিটায় বাড়ির বাইরের রাস্তায়, খোলা জায়গায় এবং ড্রেনে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত কীটনাশকের জায়গায় জৈব বালাইনাশক বিটিআইয়ের প্রয়োগ শুরু করেছে কয়েকদিন ধরে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করছে দুই সিটি করপোরেশন। মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু সমন্বিত কোনো উদ্যোগ না থাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ সামান্য। আর গ্রামাঞ্চলে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
২০১৯ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে কলকাতার কয়েকজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল। সে সময় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু সুপারিশ করেছিলেন তারা।
কলকাতার সাফল্যের প্রসঙ্গ ধরে ড. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কলকাতায় মেয়র-কাউন্সিলররা তাদের কাজের স্তর ভাগ করে নিয়েছেন। কীটতত্ত্ব বিভাগ, জনপ্রতিনিধি সবাই মিলে কাজ করেছেন। সেখানে ওয়ার্ড একটা স্তর, তারওপর সিটি করপোরেশন।
“তাদের যে কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, তারা হাসপাতালে গিয়ে দেখে কোথায় ডেঙ্গু রোগী আছে, রোগীর বাড়ির চারপাশে তারা খোঁজ নেয় আরও রোগী আছে কি না, পাশাপাশি তারা মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজে সেটা ধ্বংস করে। তাদের অভিযান সারা বছর ধরে চলে, এই সমস্যাটাকে তারা মানুষের সমস্যা হিসেবে বোঝাতে পেরেছে।”
মুশতাক হোসেন বলেন, ২০১৯ সালে বাংলাদেশেও বিষয়টি নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। তখন গাইডলাইন তৈরি, সমন্বিত ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট, একটা আলাদা অধিদপ্তর করাসহ আরও কিছু কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোভিড মহামারী আসায় ডেঙ্গু নিয়ে পরিকল্পনাগুলো আর এগোয়নি।
“২০২২ সালে ডেঙ্গুতে অনেক আক্রান্ত এবং মৃত্যু হয়েছে। সে সময়ই আমাদের হুঁশ ফেরা দরকার ছিল। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারিনি। আমরা ভেবেছি যে এটা চলে যাবে। কারণটা হল আমরা দেখেছি, যে বছর বেশি ডেঙ্গু হয় এর পরের বছর আক্রান্ত কিছুটা কম হয়।”
পরিত্রাণ কোথায়
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু রোগী এখন সারাদেশেই পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য একটা আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ করা দরকার। যেখানে নানা ধরনের বিশ্লেষণ হবে, সে অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়ে নির্দেশনা যাবে।
“২০০০ সাল থেকে প্রতি বছরই ডেঙ্গু হলেও তা ঠেকাতে কোনো দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটা অনেকটা ডায়রিয়ার প্রকোপের মত। রোগী আসবে স্যালাইন তৈরি করে রাখ। ডেঙ্গুকেও এরকম মনে করা হয়েছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জুলাই মাসের শুরুতে মশার উপস্থিতি দেখতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বরিশাল এলাকায় গিয়েছিলেন তিনি। তখনই ‘যথেষ্ট খারাপ’ পরিস্থিতি তিনি দেখেছেন।
“পরিস্থিতি এখনও খারাপ, অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এইডিস মশা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অথচ মশক নিধন কার্যক্রম তেমন একটা চোখে পড়ে নাই। বরিশাল শহরে কিছু মশা নিধন কার্যক্রম আছে। কিন্তু বাইরে চোখে পড়েনি।
“সেখানে গত বছরও মশা বেশি ছিল, কেইসও গত বছর বেশি ছিল। কোথাও ডেঙ্গু একবার গেলে যদি মশা নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে সেটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সোর্স রিডাকশনে জোর না দিলে হবে না।”
তিনি বলেন, ঢাকায় যেভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তাও সঠিকপথে এগোচ্ছে না। লক্ষ্য অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না।
“এইডিস মশা হয় বেইজমেন্টে, পার্কিংয়ে, বাসার ভেতরে, বাড়ির আঙ্গিনায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব জায়গায় মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে? যারা স্প্রে ম্যান, তারা ওই পর্যন্ত মশার ওষুধ ছিটাতে পারেন না বা ছিটান না। এই জায়গাটায় একটা গ্যাপ আছে।”
নাগরিক অসচেতন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর অংশগ্রহণ জরুরি। বেশিরভাগ এইডিস মশার লার্ভার উৎস বাড়িঘর, বহুতল ভবনের ভেতরে হলেও লোকজন দায় চাপাচ্ছে সিটি করপোরেশনের ওপর।
মিরপুরের কাজীপাড়ার বসুন্ধরা গলিতে একটি বাড়ির সিড়ির নিচে বালতিতে জমে থাকা পানিতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
ওই বাড়ির আহমেদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এমন পানিতেও লার্ভা হতে পারে সেই ধারণা ছিল না তার। তবে তার অভিযোগ, সিটি করপোরেশন ঠিকমত ওষুধ দেয় না বলেই মশা হচ্ছে।
“আমরা পানি টানতেছি, এরমধ্যে যে লার্ভা পাওয়া যাবে এইটা আমাদের ধারণার অতীত। আর এই এলাকায় মশার ওষুধ ছিটাইতে আসে না। গত তিন মাসের ভেতর আমার বাসায় কেউ আসে নাই। আমি দেখি নাই।”
পাশেই আরেকটি নির্মাণাধীন ভবনে ফেলে রাখা একটি কলসিতে জমে থাকা পানিতে মেলে লার্ভা।
ওই ভবনের নিরাপত্তায় থাকা কর্মী আল আমিন বলেন, কলসিতে পানি আছে তা তিনি জানতেন না। তিনিও বললেন, সিটি করপোরেশন ঠিকমত মশার ওষুধ দেয় না।
“আমি গত তিন মাসে কাউকে ধোঁয়া দিতে দেখি নাই। আর ১০-১২ দিন আগে একজন লোক আসছিল, এসে একটা তরল ওষুধ ছিটাইয়া গেছে।”
বেইলি রোডে দক্ষিণ সিটির অভিযানে একটি নির্মাণাধীন বাড়ি এবং একটি অ্যাপার্টমেন্টে লার্ভা পাওয়া যায়।
নির্মাণাধীন বাড়িটির নিচতলায় বালু ঢেকে পলিথিনের ভাঁজে জমে থাকা পানিতেই জন্মেছিল মশার লার্ভা। আর পাশেই বেইলি ব্যালেরিনা নামের বহুতল ভবনের গাড়ি পার্কিংয়ে ছোট বালতিতে জমা পানিতে লার্ভা পান সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। দুটি ভবনের প্রতিনিধিকেই জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
ওই ভবনের ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সভাপতি মির্জা একরাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাসাবাড়ির ভেতরের মশা নিয়ন্ত্রণেও সিটি করপোরেশনের ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু বাড়ির মালিকদের পক্ষে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
“শুধু ফাইন করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? আমি আমার জায়গায় যতটুকু পারি করব। সিটি করপোরেশনকেও তো এগিয়ে আসতে হবে। সারা ঢাকা শহরেই তো মশা।”
মশা ঘরে, ওষুধ বাইরে?
এইডিস মশা বাড়ির ভেতরে বা আশপাশে পানিভর্তি পাত্রে ডিম পাড়ে, সেখানেই লার্ভা হয়। পরিণত মশা বাড়ির ভেতরের আলমারি, বিছানার নিচে, দরজা বা জানালার পেছনে বিশ্রাম নেয়। তবে দুই সিটি কীটনাশক দিচ্ছে বাড়ির বাইরে, রাস্তায় বা ড্রেনে।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, রাস্তাঘাটে, নালায় লার্ভা বা পূর্ণাঙ্গ এইডিস মশা তেমন পাওয়া যায় না। ফলে সিটি করপোরেশন বাইরে মশার যে ওষুধ দিচ্ছে তা কতটা কাজে আসছে সে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৮ থেকে ২৭ জুনের জরিপে দুই সিটির ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৫৪৯টি বাড়িতে এইডিস মশার লার্ভা মেলে। এরমধ্যে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বস্তি বা সেমিপাকা ভবন আর ৫ দশমিক ১০ শতাংশ খালি প্লটে মেলে এইডিস মশার লার্ভা।
জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাড়ির ভেতরে এবং আঙ্গিনায় লার্ভা পাওয়া গেছে বেশি, বাড়ির বাইরে কম।
মশা শনাক্তে করা জরিপে অংশ নেওয়া কীটতত্ত্ববিদ বিশ্বজিত চৌধুরী বলেন, এইডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া যায় বাড়ির ভেতরে, বাইরে খুব একটা নয়।
“বাড়ির আঙ্গিনার বাইরে, মানে রাস্তায় পাওয়া যায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ। আর ওই লার্ভা মেলে সড়কে ফেলে রাখা কন্টেইনারে। ড্রেনে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় না। আমার ২৭ বছরের অভিজ্ঞতায় ড্রেনে কখনও এইডিস মশার লার্ভা পাইনি।”
রাস্তাঘাটে ছিটানো ওষুধ কতটা কাজে আসছে সেই প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লক্ষ্য অনুযায়ী মশার ওষুধ দেওয়া হলো কি না সেটা জরুরি। ওইটা ঠিকমত না হলে মশা নিধন হবে না। আর সিটি করপোরেশন বলে ঘরের ভেতরের মশা মারা তাদের কাজ নয়। কিন্তু সিঙ্গাপুরে কী করে? তারা বাড়ির ভেতর গিয়ে ওষুধ দিয়ে আসে।”
যা বলছে কর্তৃপক্ষ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে তারা জনগণের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
“এটাই একমাত্র সমস্যা, বারবার বলার পরও ঘরে পানি জমিয়ে না রাখার অনুরোধ তারা শুনছেন না। এটা যতক্ষণ পর্যন্ত না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত এইডিস মশা থেকে মুক্তি মিলবে না।”
তিনি বলেন, “আমাকে এইডিস এবং কিউলেক্স দুটা মশার কথাই চিন্তা করতে হবে। এজন্যই আমরা বারবার বলছি যতদিন পর্যন্ত জনগণ সচেতন না হবে, ঘরে পানি জমে থাকা বন্ধ না করবে ততদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আমরা এখন ঘরের ভেতরে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতিটি ঘরের ভেতরে যাওয়া সম্ভব না।”
ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে, টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে।
তাহলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না কেন? উত্তরে মেয়র বলেন, “এটার উত্তর অ্যান্টামোলজিস্টরা বলতে পারবে, আমার কাছে নাই। ডেঙ্গু এখন সব দেশেই হচ্ছে। আমি চেষ্টা কম করছি না। চেষ্টা থামিয়েও রাখছি না। আমি সবাইকে বলছি, আর কি করা দরকার বলেন?”
মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, “বাড়ির ভেতরে গিয়ে মশার ওষুধ দেওয়া সম্ভব না। লার্ভিসাইডিং আমাদের রেগুলার প্রোগ্রাম, আরেকটা হচ্ছে হটস্পট ধরে মশা নিধন।
“আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর। প্রতিটি ওয়ার্ডে শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করা হচ্ছে।”
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধান কি জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এরইমধ্যে একটি সমন্বিত গাইডলাইন করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের সব প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাইরের যেসব জেলা উপজেলায় এইডিস মশা পাওয়া যাচ্ছে তারা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে পারেন।
“জেলা পর্যায়ে ডিসির নেতৃত্বে একটি কমিটি আছে সেখানে জানাতে পারেন। কোনো উপজেলায় অথবা কোনো গ্রামে ডেঙ্গুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে- এ বিষয়টি আমার কাছে নতুন। আমি আমার অফিসকে বলছি এগুলোর তথ্য নেওয়ার জন্য।”
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতাকে অনুসরণ করা যায় কি না এ প্রশ্নে তাজুল ইসলাম বলেন, “অনেকে কলকাতার, সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দেয়। কিন্তু কলকাতায় গত বছর ৬৮ হাজার লোক আক্রান্ত হয়েছে। এবার অবশ্য তাদের ওখানে আক্রান্ত কম। আমাদের কাছে মনে হয় সমাধানের সবচেয়ে বড় উপায় হলো মানুষকে সচেতন করা।”