ডলার-এলসির জটিলতায় ব্লাড ব্যাগের সঙ্কট

১৪০ টাকার ‘সিঙ্গেল’ ব্লাড ব্যাগের দাম এখন ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা। ২৫০ টাকার ‘ডাবল’ ব্যাগের দাম ৩২০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা আর ৩২০ থেকে ৩২৫ টাকার ‘ট্রিপল’ ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা করে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2023, 07:57 PM
Updated : 10 Feb 2023, 07:57 PM

টাকার দরপতন আর ডলার সঙ্কটে ‘এলসি খুলতে বিধিনিষেধের কারণে’ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত জোগাড় কঠিন হয়ে যেতে বসেছে।

এরই মধ্যে বেড়ে গেছে রক্ত সংগ্রহের ব্যাগ বা ব্লাড ব্যাগের দাম। চাহিদামত আমদানিও হচ্ছে না। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে প্রয়োজনীয় ব্যাগ মিলছে না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে সঙ্কট আরও বাড়বে।

ব্লাড ব্যাগ আমদানিকারকদের একজন জানিয়েছেন, গত অক্টোবর থেকে আমদানি বিঘ্নিত হওয়ায় এখন তাদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে চলতি মাসেই একটি বড় চালান আসার কথা, সেটা এলে সঙ্কট কেটে যাবে।

রক্ত সংগ্রহ ও পরিসঞ্চালন কাজে ‘সিঙ্গেল’, ‘ডাবল’ ও ‘ট্রিপল’-এই তিন ধরনের ব্যাগ প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচার বা দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের দাতার কাছ থেকে নেওয়া পুরো রক্তটাই সরাসরি দেওয়া হয়। এতে ‘সিঙ্গেল’ ব্যাগ লাগে।

প্লাটিলেট, প্লাজমা আলাদা করে দিতে প্রয়োজন হয় ‘ডাবল’ ও ‘ট্রিপল’ ব্যাগ। রক্ত সংগ্রহ, রক্তের বিভিন্ন উপাদান পৃথক করা এবং তা পরিবহনেও এই ব্যাগগুলো দরকার।

এই তিন ধরনের ব্যাগের মধ্যে শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সিঙ্গেলগুলোর দাম। কখনও কখনও আগের দামের চেয়ে দ্বিগুণ পড়ছে এখন। সব ধরনের ব্যাগের দামই খুচড়ায় ৭০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে।

বাংলাদেশে বছরে চাহিদা আছে ১৫ থেকে ২০ লাখ ব্লাড ব্যাগের, যার পুরোটাই আমদানি করতে হয়। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ১৪টি প্রতিষ্ঠান এই ব্যাগগুলো আমদানি করে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংকগুলো তাদের কাছ থেকে ব্যাগ সংগ্রহ করে।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ও বার্ন ইউনিটে মজুদ শেষের পথে

স্বাভাবিক আমদানি না হওয়ায় চাহিদা মত ব্যাগ পাচ্ছে না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ। সেখানে প্রতি মাসে ৬ থেকে সাড়ে ৭ হাজার ব্যাগ প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন গড়ে লাগে দুই থেকে আড়াই শ। ‘সিঙ্গেল’ ব্যাগের সরবরাহ থাকলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ‘ডাবল’ ও ট্রিপল ব্যাগ পাচ্ছে না তারা।

বিভাগের ইনচার্জ মো. রকিবুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্রিপল ব্যাগের মজুদ প্রায় শেষের দিকে। আমদানিকারক জানিয়েছে, এ মাসের শেষের দিকে তারা ব্যাগ দিতে পারবে।”

জেএমএস নামে একটি কোম্পানি থেকে এই ব্যাগ সংগ্রহ করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল। তারা দিতে না পারায় এখন অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও কথা বলছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ‘এলসি খুলতে না পারায়’ ব্যাগ আমদানি করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে সবাই।

রকিবুল বলেন, “আমাদের কাছে অনেকে ‘ডাবল’ ও ‘ট্রিপল’ ব্যাগ চাচ্ছে, কোথায় পাওয়া যাবে তাও জানতে চাইছে। ব্যাগ সঙ্কটের কারণে অনেকেই রক্ত সংগ্রহ করতে পারছে না। আমদানি করতে না পারলে ব্লাড ব্যাংকগুলো ব্যাপক ক্রাইসিসে পড়বে।”

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আশরাফুল হক জানান, তাদের হাসপাতালে ‘ডাবল’ ব্লাড ব্যাগই বেশি লাগে। মাসে দরকার পড়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ব্যাগের। এখন যে মজুদ আছে দিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন কাজ চালানো যাবে।

তিনি বলেন, “আমাদের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে কিছু ব্যাগ দেয়। আর আমরাও কিছু ব্যাগ সংগ্রহ করি। গত চার মাস ধরে আমরা ব্যাগ সংগ্রহ করতে পারছি না। সিএমএসডি থেকে যা পেয়েছি তা দিয়ে চলেছি। এখন সরকারি সরবরাহও নাই। এজন্য সঙ্কটে পড়ে গেছি।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের রেজিস্ট্রার আল মামুন বলেন, “আমাদের হাসপাতালে সিঙ্গেল ও ডাবল ব্যাগের সরবরাহ আছে। কিন্তু ট্রিপল ব্যাগ শেষ হয়ে গেছে, এটা বাইরে থেকে কিনতে হয়। তবে ট্রিপল ব্যাগ লাগে কম।”

সে তুলনায় মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিস্থিতি ভালো। এখানকার ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দানিশ আরেফিন বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে ১০ হাজার ব্যাগ দিয়েছে, ফলে আমাদের কোনো ক্রাইসিস নেই। তবে আমিও শুনেছি অনেক সেন্টারে নাকি ব্যাগ নাই।”

তিনি জানান, মিটফোর্ডের ব্লাড ব্যাংক প্রতি মাসে রক্তদাতাদের কাছ থেকে আড়াই হাজার ব্যাগ রক্ত নিতে পারেন। মাসে গড়ে দুই হাজার ব্যাগ হলে বছরে ২৪ হাজার ব্যাগ প্রয়োজন।

খরচ বেড়েছে ব্লাড ব্যাংকের

কোয়ান্টাম ব্ল্যাড ব্যাংকের দিনে ব্যাগ লাগে গড়ে ১৫০ থেকে ১৬০টি। কিন্তু এখন তা যোগাড় করা কঠিন হয়ে গেছে।

ব্লাড ব্যাংকটির সিনিয়র প্রো-অর্গানিয়ার আশিকুর রহমান বলেন, “আমরা জেএমআইয়ের ব্যাগ বেশি ব্যবহার করি। তারা বলছে এলসির কারণে ব্যাগ আনতে পারছে না। এছাড়া ডলারের দাম বাড়ায় ব্যাগের দামও বেড়েছে।”

স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের সংগঠন ‘বাঁধন’ এর ট্রান্সফিউশন সেন্টার মাসে ৪শ থেকে ৬শ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করতে পারে। ব্যাগের মূল্য বৃদ্ধি এবং সঙ্কটে রক্ত সংগ্রহ কার্যক্রমে চালাতে সমস্যা হচ্ছে।

‘বাঁধন’ এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপদেষ্টা মীর নাঈমুর রহমান নাঈম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেএমএসের ব্যাগের ক্রাইসিসটা বেশি, ওই ব্যাগটা ভালো। দাম বেশি হওয়ায় আমরা সেটা নিতে পারছি না, কোয়ালিটি রক্ষা করতে পারছি না।

“ব্যাগের দাম, ক্রসম্যাচিং চার্জ, স্ক্রিনিং রিপোর্ট মিলে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে প্রতি ব্যাগ রক্তের জন্য ৬০০ টাকা নিতে হয়। প্রকৃত খরচ বেশি হলেও আমরা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তাই রোগীদের কাছ থেকে ৬০০ টাকাই নিচ্ছি। কাজ চালাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।”

দাম কতটা বাড়ল?

একজন আমদানিকারক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ১৪০ টাকার ‘সিঙ্গেল’ ব্যাগের দাম এখন ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা হয়ে গেছে। অর্থাৎ ১১০ থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

২৫০ টাকার ‘ডাবল’ ব্যাগের দাম এখন ৩২০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা; বেড়েছে ৭০ থেকে ১০০ টাকা।

৩২০ থেকে ৩২৫ টাকার ‘ট্রিপল’ ব্যাগের দাম বেড়ে হয়েছে ৪৫০ টাকা, বেড়েছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদকরা দাম বাড়িয়েছেন। আবার এলসি করতে না পারায় ব্যাগও আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে তারা ব্যাগ সরবরাহ করতে পারছেন না।

“আমি জার্মানির একটা সিঙ্গেল ব্যাগ আগে ১৩০ টাকা বিক্রি করতাম। ইউরোর দাম বাড়ায় এটার দাম বেড়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে এলসিও হচ্ছে না। চীন থেকে কোনো ব্যাগই আনা যাচ্ছে না। আমরাও দিতে পারছি না।”

তবে বাংলাদেশ মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যান্ড মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ইমপোর্টার্স অ্যান্ড মেনুফ্যাকচারস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগ বেশি চলে, এটার কোনো ক্রাইসিস নাই। ডলার সংকটের কারণে দামের যে ঊর্ধ্বগতি ছিল, তাও এখন কমতির দিকে। ট্রিপল এবং ডাবল ব্যাগের ব্যবহার কম হওয়ায় আমদানিকারকও কম।”

এলসি সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ডলার সংকটের কারণে গত বছরের অক্টোবর মাস থেকেই বড় অংকের কোনো এলসি খোলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে কিছু কিছু মাল শর্ট আছে। ‘ডাবল’ এবং ‘ট্রিপল’ ব্যাগের একটা বড় চালান এ মাসেই আসবে। আশা করি এ ক্রাইসিস কেটে যাবে।”

সঙ্কটের কথা জানেন না মন্ত্রী

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বৃহস্পতিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাগের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তবে বাজারে ব্যাগের সঙ্কটের বিষয়টি তিনি অবহিত নন।

তিনি বলেন, “আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আমদানিকারকরাও জানায়নি। যেসব জিনিস বাইরে থেকে আনতে হয় তাদের দাম কিছুটা বেড়েছে। চিকিৎসা সামগ্রী আমদানিতে এলসি খুলতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। ব্যাগের যেন ঘাটতি না হয় তা নিয়ে আমি কথা বলব।”