২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি এক লাখে ২২ জনে নামিয়ে আনতে চায় সরকার।
Published : 17 Oct 2023, 07:07 PM
বাংলাদেশে সম্ভাব্য যক্ষ্মা রোগীদের অন্তত ১৮ শতাংশ শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছেন বলে ধারণা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একটি মডেল ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তারা।
যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত টিবি হাসপাতালে গেলে এই ধারণার পক্ষে তথ্য প্রমাণ মেলে।
শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা করাতে ঢাকা জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে এলে যক্ষ্মা ধরা পড়ে নরসিংদীর মাধবদী এলাকার গৃহিনী রোকসানা খানমের।
তার স্বামী সাদিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন “অন্তত দেড় বছর আগে থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তার স্ত্রী। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসককে দেখালেও যক্ষ্মার কথা বলেননি কেউ।”
সাদিকুরের নিজের ও শ্বশুরবাড়ির কারও যক্ষ্মা নেই। অন্য কোনোভাবে তার স্ত্রী এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন ধারণা তার।
রোকসানা এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও আবাসিক চিকিৎসক সেরাজুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, “অন্তত দেড় বছর আগে থেকেই তার (রোকসানা) টিবির সব লক্ষণ ছিল, এ কারণে তার অজান্তেই যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা আছে। এজন্য তার পরিবারের অন্যদেরও যক্ষ্মা আছে কি না তা পরীক্ষা করা দরকার।”
আক্রান্ত রোগীকে শনাক্তের গুরুত্ব সম্পর্কে ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাইফুদ্দিন বেন নূর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি হিসাবের বাইরে থাকা যক্ষ্মায় আক্রান্তদের দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটাতে আছে যারা সঠিকভাবে শনাক্ত হয়েছে, চিকিৎসা কিন্তু সরকারের খাতায় আসছে না। আরেক ভাগে আছে যাদের রোগটাই শনাক্ত হচ্ছে না।
“তারা যে ভুগছে তাদের কোনো ডাক্তার বা প্যারামেডিক টিবি বলে সন্দেহ করছে না, তাদের চিকিৎসাও হচ্ছে না। তারা কফের মাধ্যমে জীবাণু ছড়াচ্ছে। এই গ্রুপটা ভয়াবহ। তাদের মাধ্যমে রোগটা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আশপাশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। এই ধরনের বড় একটা গ্রুপ আমাদের আশপাশে আছে।”
শনাক্তের বাইরে থাকা এসব রোগীরা চিকিৎসা নিতে দেরি করছেন, অনেকে চিকিৎসাই নিচ্ছেন না। এতে এসব রোগীদের অজান্তে রোগটি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি এক লাখে ২২ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। শতভাগ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত না করতে পারলে এই লক্ষ্য অর্জন করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের কথা বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন মানদণ্ড বিবেচনা করে কোনো দেশে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর একটা হিসাব দেয়। সে হিসাবে ২০২১ সালে সারাদেশে ৩ লাখ ৭৫ হাজার যক্ষ্মা রোগী ছিলেন। তাদের মধ্যে শনাক্ত রোগীর ৩ লাখ ৭ হাজার ৫৬১ জন এবং শনাক্তের বাইরে ছিলেন ৬৭ হাজার ৪৩৯ জন। ওই বছর ৪২ হাজার রোগীর মৃ*ত্যু হয়েছে।
২০১৪ সালে যক্ষ্মাকে ‘নোটিফায়েবল ডিজিজ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ সরকার। সে অনুযায়ী, আক্রান্ত রোগীকে শনাক্তের আওতায় এনে তা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি- এনটিপিকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে অনেক বেসরকারি অনেক হাসপাতাল এই তথ্য জানাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।। ফলে আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি থেকে যাচ্ছে।
সফল হয়নি ‘জানাও’
যক্ষ্মা রোগীদের তথ্য জানাতে ২০১৯ সালে চালু করা করা হয় মোবাইল অ্যাপ ‘জানাও’। এই অ্যাপ মোবাইলে ডাউনলোড করেছেন কেবল দেড় হাজারের মত চিকিৎসক। এতেও যক্ষ্মার প্রকৃত তথ্য পাওয়ায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নোটিফায়েবল ডিজিজ’ বিষয়টি অনেক চিকিৎসক জানেন না। এটি জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
“আমরা যক্ষ্মা আক্রান্তের ডাটা পাচ্ছি সেটার মধ্যে আমার মনে হয় কিছুটা ঘাটতি থাকতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালের ডেটা আসছে না, এছাড়া অনেক প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসকরা রোগী পেলেও নোটিফাই করে না।
“জানলে সেটা কোথায়, কাকে জানাতে হবে সে বিষয়ে তাদের কোনো ওরিয়েন্টেশন নাই। এ বিষয় মটিভেট করার কোনো উদ্যোগ সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নেই।”
কয়েকজন চিকিৎসক বলছেন, ‘জানাও’ নামে যে একটা মোবাইল অ্যাপ আছে তা তারা জানেনই না। আবার যারা জানেন তারা বলছেন এটি ‘ইউজার ফ্রেন্ডলি’ না। এখানে তথ্য যোগ করতে গেলে কিছুটা জটিলতায় পড়তে হয়।
অনেক চিকিৎসক বিষয়টি গুরুত্ব দেন না, ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণেও অনেক সময় রোগী পেলেও তারা অ্যাপে দিতে পারেন না।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক নিরুপম দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ১০ বছরের চাকরিজীবনে তিনি অ্যাপটির কথা শোনেনইনি।
“আমার মনে হয় ওই অ্যাপটি নিয়ে তেমন প্রচার চালানো হয়নি। আমি ঢাকার টিবি হাসপাতালেও চাকরি করেছি, সে সময়ও ওই অ্যাপটির বিষয়ে আমি জানতাম না যে, জানাও নামে একটি অ্যাপ আছে”, বলেন তিনি।
ওই চিকিৎসকের মত, জানাও অ্যাপ মোবাইলে থাকলেও নিজেদের চেম্বারে বসে রোগীর তথ্য পূরণ করা সম্ভব না।
তিনি বলেন, “সরকারি হাসপাতালে এজন্য আলাদা লোক আছে, রোগী শনাক্ত হলে তারা অ্যান্ট্রি করে দেয়। আমার কাছে এসে রোগী শনাক্ত হলে আমরা ব্র্যাকে পাঠাই। তারা হয়ত অ্যান্ট্রি দেয়, আমার সঠিক জানা নেই।”
(প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে: ফেইসবুক লিংক)