গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন: সংকট সমাধানে ৬৭ জনের বিবৃতি

বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির দায়’ ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্বকেই বহন করতে হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2023, 07:36 AM
Updated : 21 May 2023, 07:36 AM

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে অনাস্থা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে; সংগঠনের অচলাবস্থা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে থিয়েটার চর্চার সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন ৬৭ জন নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠক।

এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির দায়’ ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্বকেই বহন করতে হবে।

ফেডারেশন থেকে ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ প্রত্যাহারের পর নাট্য সংগঠনগুলোর এ জোটের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে দেশের শীর্ষ চার নাট্য সংগঠনের প্রধানের চিঠি পাঠানোর ধারাবাহিকতায় এই বিবৃতি এল।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্বের চরম স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও অকার্যকর ভূমিকায় বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় চারজন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, ম হামিদ ও সারা যাকের (যারা ইতোপূর্বে ফেডারেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন) সম্প্রতি ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারের ফেডারেশন হতে নিজেদের প্রত্যাহার ও ফেডারেশনের অনিয়ম বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ফেডারেশন বরাবর পত্র লিখেছেন।

“ইতোপূর্বেও ফেডারেশনের অনিয়ম, নিষ্ক্রিয়তা ও করণীয় বিষয়ে শ্রদ্ধেয় নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিবৃতি এবং ফেডারেশনকে লিখিত পত্র প্রদান করলেও ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব তা উপেক্ষা এবং তাচ্ছিল্যের সাথে অবজ্ঞা করেছেন। এছাড়া ফেডারেশনের সাবেক তিনজন জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য (নাট্যজন শিশির দত্ত, মলয় ভৌমিক ও আহমেদ ইকবাল হায়দার) উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে ফেডারেশনের প্রতি আহ্বান জানালেও বর্তমান নেতৃত্ব তা আদৌ আমলে নেননি।”

বিবৃতিদাতারা বলছেন, “আমরা জানি, 'সাধারণ নাট্যকর্মী' ব্যানারে ঢাকাসহ সারাদেশের প্রায় ৪ শতাধিক নাট্যকর্মী ফেডারেশনের চেয়ারম্যান বরাবর যৌক্তিক কারণে তার পদত্যাগের দাবি করে স্মারকলিপি প্রদান করে। ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব সে বিষয়েও কোনো সাড়া দেয়নি।

“ইতোমধ্যে ঢাকায় থিয়েটার চর্চার সংকট ও ফেডারেশনের নিষ্ক্রিয়তা বিষয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। আমরা আরও লক্ষ্য করছি যে, ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব সম্প্রতি বিভাগীয় সম্মেলন করে ওইসব সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে প্রতিনিধিত্বের অনুমোদন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে অগঠনতান্ত্রিক।”

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফেডারেশনের আগামী নির্বাচনে ‘সুবিধাপ্রাপ্ত ও অনুগত প্রতিনিধি নিয়ে একটি দায়সারা নির্বাচন করার’ পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে বিবৃতিতে।

সেখানে বলা হয়, “আমরা মনে করি। ফেডারেশনের বর্তমান কমিটি অবৈধভাবে মেয়াদ বাড়িয়ে স্বেচ্ছাচারিতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। গত বেশ কয়েক বছর যাবত ফেডারেশন বাংলাদেশে থিয়েটার চর্চার নানাবিধ সংকট নিরসনে কার্যকর কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। মূলত ফেডারেশন দরকষাকষির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

Also Read: গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ছাড়ল ঢাকা থিয়েটার

Also Read: গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ‘সংকট’ সমাধানে সভাপতিকে সাবেকদের চিঠি

“এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে নজিরবিহীনভাবে একই ব্যক্তি বছরের পর বছর ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদে দায়িত্ব পালন করায়। ফলে ঢাকাসহ সারাদেশের নাট্যচর্চা আদর্শিক দিশাহীনতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং নানাবিধ সংকটের সম্মুখিন হয়েছে।”

বিবৃতিদাতারা বলছেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি নিকট অতীতে দেশে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সংস্কৃতির উত্থান রুখতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও এ সংগঠনের সংগ্রামী ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।

“এমতাবস্থায় আমরা মনে করি নাট্যকর্মীদের বৃহত্তর ঐক্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আদর্শিক অবস্থান অটুট, সৃজনশীলতার বিকাশ ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারের ফেডারেশনের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে আগামী ৩০ মে ২০২৩ এর মধ্যেই ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব সার্বিক বিষয়ে দায়িত্বশীলতার সাথে সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। অন্যথায় পরবর্তী উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্বকেই বহন করতে হবে।”

বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন- অধ্যাপক মলয় ভৌমিক, আহমেদ ইকবাল হায়দার, ফয়েজ জহির, আজাদ আবুল কালাম, হারুন রশীদ, শহীদুজ্জামান সেলিম, মোহাম্মদ বারী, অলোক বসু, মোহাম্মদ আলী হায়দার, ঠান্ডু রায়হান, অধ্যাপক রতন সিদ্দকী, হাসান শাহরিয়ার, সামিনা নিত্রা, মারুফ কবীর, নূনা আফরোজ, তৌফিকুল ইমন, কামরুন নূর চৌধুরী, মোমেনা চৌধুরী, বিপ্লব প্রসাদ, তৌফিক হাসান ময়না, মাহবুব আলম, আজিজ বাবু, ড. কামালউদ্দিন কবির, অপু শহীদ, আনন জামান, প্রশান্ত হালদার।

মো. শাহনেওয়াজ, সগীর মোস্তফা, সুচরিত দাশ খোকন, শুভংকর চক্রবর্তী, অলোক মাহমুদ, বিক্রম চৌধুরী, সুচরিত টিংকু, দীপক চৌধুরী, জুলফিকার চঞ্চল, কামারউল্লা সরকার কামাল, আবুল কাশেম, শাহাজাদ আলী বাদশা, আসলাম আলী, সালাম সাকলাইন, রজত কান্তি গুপ্ত, বিজয় প্রসাদ তপু, সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল, ওয়াহিদুল ইসলাম, তোসাদ্দেক হোসেইন মান্না, আসাদুল্লাহ ফরাজী, মামুন উর রশীদ মুকুল, মুনির হোসাইন, আব্দুস সালাম, এম রাশিদুল আওয়াল রিজভী, নিতাই কুমার সরকারও রয়েছেন বিবৃতিদাতাদের মধ্যে।

আরও আছেন আসাদুজ্জামান খোকন, আহসান কবীর লিটন, রতন দাস, জসিম উদ্দিন, সাগর কুমার সরকার, সাজিদুল করিম, মশগুল হোসেন ইতি, আবু জাফর মো: ফজলুল বারী রনি, সেলিম জাহাঙ্গীর, মো. মুনিরুজ্জামান, এড. সুখময় রায় বিপলু, অতনু করঞ্জাই, হোসেন আনোয়ার, খোয়াজ রহিম সবুজ ও শামসুল বাসিত শেরো।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

সংকটের ইতিবৃত্ত

২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সম্পাদক (প্রচার) মাসুদ আলম বাবুর স্বাক্ষরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ ও অর্থ সম্পাদক রফিকুল্লাহ সেলিমকে ফেডারেশন থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানানো হয়।

সেখানে বলা হয়, “আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও সাংগঠনিক স্বেচ্ছাচারিতার দায়ে সেক্রেটারি জেনারেল ও অর্থ সম্পাদককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।”

পরে সংবাদ সম্মেলন করে কামাল বায়েজীদ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কাউকে অব্যাহতি দেওয়া ‘অগণতান্ত্রিক’।

কামাল বায়েজীদ সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে দুদকে একটি অনুসন্ধান চলছে। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। আমি তাকে একদিন এ বিষয়ে মৌখিকভাবে বলেছিলাম, তিনি যেন কিছুদিন সংগঠনের কাজ থেকে বিরতি নেন। এই কারণে হয়ত তিনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে অব্যাহতি দিয়েছেন।”

ফেডারেশনের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ ঢাকা থিয়েটার প্রতিনিধি। তাকে ফেডারেশান থেকে এভাবে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যাখ্যা চেয়ে একটি টিঠি দেয় ঢাকা থিয়েটার।

তার জবাব না পেয়ে এ বছর ২২ মার্চ ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে লেখা এক চিঠিতে ফেডারেশন ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানান ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ।

ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ প্রত্যাহারের ঘটনায় ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে ১৩ এপ্রিল ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে চিঠি দেন নাট্যচক্রের ম হামিদ, নাট্যদল থিয়েটারের রামেন্দু মজুমদার, আরণ্যকের মামুনুর রশীদ এবং নাগরিকের সারা যাকের। তারা চারজনই বিভিন্ন মেয়াদে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

ফেডারেশনের পদক্ষেপের বারণে ঢাকা থিয়েটার ওই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে মন্তব্য করে তারা চিঠিতে বলেন, "আমরা বিভিন্ন সময়ে বলে এসেছি যে ফেডারেশানে আমরা কোনো বিভাজন চাই না। আমাদের সমবেত চেষ্টায় গড়ে ওঠা এতদিনের ঐক্য বজায় থাকুক - এটা আমাদের কাম্য।"

ফেডারেশনকে সময় বেঁধে দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, "আমাদের বিশেষ অনুরোধ, আগামী ৩০ মে, ২০২৩ এর মধ্যে এ ব্যাপারে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান আপনারা দেবেন। আপনাদের কোনো পদক্ষেপ যেন নাট্যাঙ্গনে বিভাজন সৃষ্টি না করে - এটা আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা।"