“এই গানটা ছাড়া যেন আমাদের ঈদে বাড়ি যাওয়া সম্পূর্ণই হয় না; এই গানটা কখনো পুরান হবে না।"
Published : 10 Apr 2024, 07:36 PM
অফিস শেষ করেই কমলাপুর স্টেশনে হাজির রাশেদ। তার স্ত্রী সুমাইয়া আরেকটি অটোরিকশায় ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে এলেন। ট্রেনের কামড়ায় ব্যাগ রেখেই স্বামীর সঙ্গে সেলফি তুললেন সুমাইয়া, ফেইসবুকে ছড়িয়ে দিলেন ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ শিরোনামে।
প্রতিবার ঈদেই সুমাইয়ার মত অনেকে বাড়ি ফেরার ছবি ফেইসবুকে পোস্ট করেন ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ ক্যাপশনে। গ্রামীণফোনের একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের এই কথায় নিজেকে খুঁজে পান ঘর ছেড়ে আসা অসংখ্য মানুষ। সেই বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেলে ব্যবহৃত ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটিও তাই প্রতি ঈদে ফিরে ফিরে আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক সাইম রানার কথায়, “কোটি মানুষের বাড়ি ফেরার আবেগেরই প্রকাশ ঘটে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি' গানটির কথা ও সুরে; সে কারণে গানটি অসংখ্য মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।”
প্রতি বছর ঈদে লাখো মানুষ ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের কর্মস্থল ছেড়ে বাড়িতে যান। ৭০ লাখের বেশি মানুষ থাকেন প্রবাসে; তাদেরও অনেকে ঈদে দেশে ফেরেন। গত বছর বুয়েটের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঈদের আগের চার দিনে ঢাকা ছেড়েছিলেন ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ।
যেভাবে জন্ম গানটির
২০০৯ সালে বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল হিসেবে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানের সুর করেন সংগীতশিল্পী ও সুরকার হাবিব ওয়াহিদ। গ্রামীণফোনের তৎকালীন কর্মকর্তা আনিকা মাহজাবিন নন্দিনীর লেখা জিঙ্গেলটি প্রথম কণ্ঠে তোলেন শিল্পী মিলন মাহমুদ।
ওই বছরই গ্রামীণফোন থেকে গানটির একটি ভিডিওচিত্র নির্মাণ করে প্রচার করা হয়। পরের বছরও গানটির ভিডিওচিত্র দেখা যায় টেলিভিশনে। এরপর প্রচার বন্ধ থাকলেও ঈদে ভেসে ভেসে বেড়ায় গানের সেই লাইন ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’।
২০১৬ সালে গ্রামীণফোন বিজ্ঞাপনটি নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। গানের শিরোনাম এক থাকলেও নতুন কথায় সাজানো হয় গানটি। ভিডিওচিত্রে তুলে ধরা হয় নতুন গল্প।
দ্বিতীয় পর্বে গানের নতুন কথা লেখেন রাসেল মাহমুদ, নতুন সুর করেন হাবিব ওয়াহিদই। এবার কণ্ঠ দেন মিঠুন চক্র।
গানটির গীতিকার রাসেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০০৯ ও ২০১০ সালে আনিকার লেখা জিঙ্গেল থেকে বিজ্ঞাপনটি দু’বছর প্রচার হয়েছিল। ২০১৬ সালে আমি এটিকে পূর্ণাঙ্গ গান হিসেবে লিখি।
“হাবিব ভাইয়ের সুরে গানটি গেয়েছেন মিঠুন চক্র। এখন পর্যন্ত আট বছর ধরে এই গানটিই প্রতি ঈদে চলছে। ওই গান থেকেই এবার পঞ্চমবারের মত বানানো হয়েছে বিজ্ঞাপনচিত্র।"
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ গানটি মুখে মুখে ফিরলেও অনেকেই জানে না কণ্ঠ কার। অনেকেই ধরে নেন হাবিব ওয়াহিদের, কেউবা মনে করেন কণ্ঠ মিলন মাহমুদের।
এ নিয়ে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ গানের কণ্ঠশিল্পীর খানিকটা আক্ষেপও আছে।
মিঠুন চক্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণত কোনো গানের ক্ষেত্রে প্রথম চেনে কণ্ঠশিল্পীকে। এরপর অন্যদের নাম আসে।
“কিন্তু এই গানটির ক্ষেত্রে কেন যেন এটি হয়নি! অনেকেই জানেন না, গানে আমার কণ্ঠ। আট বছর ধরে আমার কণ্ঠটিই শুনছে সবাই।"
‘সাদা সাদা কালা কালা’, ‘মুড়ির টিন’, ‘টাকা পাখি’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত গানের সংগীত আয়োজন করেছেন মিঠুন। একাধিক গানে কণ্ঠও দিয়েছেন।
মিঠুন চক্র বলেন, “কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আমার এখনো কোনো অ্যালবাম করা হয়নি। তবে একাধিক গান গেয়েছি। ২০১২ সালে অমিতাভ রেজার পরিচালনায় একটি গানেও কণ্ঠ দিয়েছি। ২০১৫ সালেও একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছি। এরপরই ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি' গানটিতে কণ্ঠ দিই।"
এবার নতুন বিজ্ঞাপনচিত্র
এবার ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ বিজ্ঞাপনে প্রবাসীদের গল্প তুলে ধরেছে গ্রামীণফোন। এক প্রবাসী ফোনে জানান, এবারও তার ঈদে বাড়ি ফেরা হচ্ছে না। এ কথা শুনে স্ত্রীর মন বেজার হওয়ায় তাকে নতুন শাড়ি কিনতে বলেন ওই প্রবাসী।
কিন্তু স্বামীকে ছাড়া স্ত্রীর ঈদ যেন পূর্ণতা পাচ্ছিল না। হুট করেই ঈদে ওই প্রবাসী বাড়ি এসে ‘সারপ্রাইজ’ দেন স্ত্রীকে।
বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করেছেন শাহরিয়ার পলক। ক্যামেরায় ছিলেন রাজু রাজ। প্রেক্ষাগৃহ ভিজ্যুয়াল ফ্যাক্টরি থেকে নির্মিত এ বিজ্ঞাপনচিত্রে স্ত্রী চরিত্রে আছেন থিয়েটারশিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা ইভা, আর প্রবাসীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মেহেদী আকাশ।
ইভা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বিজ্ঞাপনটি তো অনেক বছর ধরেই মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। আমি এবারই প্রথম গানটির ভিডিওচিত্রে অভিনয় করেছি।
“শুটিংয়ের সময়ও ভাবনায় আসেনি, এটি প্রচার হওয়ার পর এতটা প্রতিক্রিয়া পাব। এটি এখন কোটি কোটি মানুষ দেখছে, অনেকেই প্রশংসা করছেন। ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ তো আসলে সবারই মনের কথা। সে কারণে হয়ত সবাই এতটা পছন্দ করছেন।”
বিজ্ঞাপনচিত্রটি ৪ এপ্রিল প্রকাশ পাওয়ার পর কেবল ফেইসবুকেই দেখা হয়েছে দেড় কোটিবার। আর ইউটিউবে দেখা হয়েছে ৭০ লাখ বার।
সেখানে সাদমান সিফাত নামের একজন মন্তব্য করেছেন, “এই তো কয়েক বছর আগের কথা, এই গানটি ঠিক ফিল করতে পারতাম না; কিন্তু এখন ১ বছর হলো বাসা থেকে ৫০০ কিমি দূরে, ২ দিন পর বাড়ি যাব আর এইটা কানে বাজলেই চোখ ভিজে যায়। স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।”
শুভ লিখেছেন, “এই গানটা ছাড়া যেন আমাদের ঈদে বাড়ি যাওয়া সম্পূর্ণই হয় না। এই গানটা কখনো পুরান হবে না।"
রমিজ নামের একজন মন্তব্য করেছেন, “আমাদের মত যারা প্রবাসে বসবাস করে, তাদের এক আবেগ এই গানটা। কিন্তু বাস্তবতা আলাদা। আমাদের স্বপ্ন যে বাড়ি যেতে পারে না!”
স্বপ্ন যাবে বাড়ি কেন মুখে মুখে?
এক যুগের বেশি সময় ধরে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক সাইম রানা বললেন, “এ গানটি আমিও শুনেছি, সুর এবং কথা ভালো হয়েছে। গায়কিও বেশ ভালো।
“এটি হাই পিচে গাওয়া একটি গান। সাধারণত হাই পিচ বা উচ্চ সুরের গান অনেক বেশি আকর্ষণ করে। এছাড়া এই গানটি বিজ্ঞাপনচিত্রে ব্যবহার হওয়ার কারণে এটি অনেকবার প্রচার হয়েছে। কোনো একটি গানের কথা ও সুর যদি হৃদয়গ্রাহী হয় এবং সেটি বারবার বাজানো হয়, তখন সেটি মানুষের মাঝে অনেক বেশি নাড়া দেয়।”
গানের ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ অংশ মানুষের মুখে বেশি নাড়া দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাইম রানা বলেন, বিজ্ঞাপনচিত্রে যেটুকু অংশ ব্যবহার হয়েছে, ওইটুকুই মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে।
“আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি কিন্তু অনেক বড়। কিন্তু আমরা যে কয়েক লাইন বেশি বেশি গাইছি, ওইটুকুই কিন্তু আমাদের মাঝে বেশি মনে থাকছে। পুরো গানটি কিন্তু আমাদের অনেকেই জানেন না।
“‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটির ক্ষেত্রে যেটুকু অংশ বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হয়েছে এবং এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ভিডিওচিত্র নির্মাণের কারণে ওই অংশটুকুই মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিচ্ছে। মানুষ ওই লাইনটুকুর মধ্যে তার নিজের স্মৃতিকে খুঁজে ফেরে।”
সংগীতের এই শিক্ষক বলেন, “মানুষ যখন কোনো কবিতা বা গানে নিজের স্মৃতি বা অনুভূতির মিল খুঁজে পান, সেটিই তিনি বারবার আওড়াতে থাকেন। এই গানটির কথা ও সুর হৃদয়গ্রাহী এবং তার সঙ্গে গ্রামীণফোন যেহেতু বড় কোম্পানি, তারা নানান জায়গায় বিজ্ঞাপনটি প্রচার করছে- এজন্যই আমার মনে হয়, গানটি প্রতিবার ঈদের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিচ্ছে।”
আর বাউলশিল্পী শফি মণ্ডল মনে করেন, স্বপ্ন যাবে বাড়ি গানের কথা ও সুরের মধ্যেই পরিবার-স্বজনের কাছে ফেরার একটা আকুতি আছে। যার কারণে দীর্ঘদিন পরিবার বিচ্ছিন্ন থাকা মানুষ এই গানের মাধ্যমে নিজেকে খুঁজে পান।
শফি মণ্ডলের ভাষায়, "আমাদের দেশের গান তো বেশির ভাগই বাণীপ্রধান। 'স্বপ্ন যাবে বাড়ি' গানের মধ্যেও কথার শক্তি এবং সুরের মায়া আছে।
“কথাগুলো শুনলেই যে কারো ভালো লাগবে। পরিবার-পরিজনদের ছেড়ে থাকা মানুষ নিজেকে খুঁজে পাবে এ গানটাতে।"