ধুকছে বলিউড; জাদু শেষ, ধসের ইঙ্গিত?

নাচ-গানের সম্ভারে বলিউডের সিনেমা ক’দিন আগেও ভারত ছাপিয়ে গোটা বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেও সেই জাদু বুঝি এবার ফুরোতে চলল।

নাবিলা আফসারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2022, 05:38 AM
Updated : 4 Sept 2022, 05:38 AM

“বলিউড মনে হয় ধসে পড়ছে, দায়টা বলিউডেরই”- এমনই সিদ্ধান্ত টানছেন ভারতের হিন্দি সিনেমার উজ্জ্বল তারকাদের একজন, যার সর্বশেষ সিনেমাটি বক্স অফিসে মার খেয়েছে।

তার এই মন্তব্যকে শিরোনাম ধরে মহামারী-পরবর্তী বলিউডের হাল-হকিকত বিশ্লেষণ করেছে রয়টার্স। তাতে ফুটে উঠেছে, নাচ-গানের সম্ভারে বলিউডের সিনেমা ক’দিন আগেও ভারত ছাপিয়ে গোটা বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেও সেই জাদু বুঝি এবার ফুরোতে চলল।

“সিনেমাগুলো মনে হয় কাজ করছে না, দোষটা আমাদের, দোষটা আমারও,” গত ১১ অগাস্ট নিজের সিনেমা ‘রক্ষা বন্ধন’ মুক্তি পাওয়ার পর ফ্লপের আভাস দেখে সাংবাদিকদের বলছিলেন অক্ষয় কুমার।

“আমাকে পরিবর্তন আনতে হবে, দর্শকদের চাওয়া বুঝতে হবে। কী ধরনের সিনেমা করা উচিৎ, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাই আমি,” বলছিলেন তিনি।

সত্যিকারেই সময় বদলেছে, আর আধুনিক ভারতের সংস্কৃতির স্তম্ভ বলিউডও তার আকর্ষণ হারাচ্ছে।

তিন বছর আগে কোভিড মহামারী শুরুর পর নেটফ্লিক্স ও আমাজন প্রাইমের মতো স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোর উত্থান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বলিউড নিয়ে এক ধরনের ক্লান্তি তৈরি করেছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে, বলিউডের সিনেমাগুলো সেকেলে হয়ে পড়েছে, এগুলো যুগের সঙ্গে যাচ্ছে না।

বলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের বাণিজ্যিক গতি-প্রকৃতির উপর নজর রাখা কইমই ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে যে ২৬টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, তার ২০টিরই অর্থাৎ ৭৭ শতাংশের সঙ্গে জুটেছে ফ্লপের তকমা। অর্থাৎ বিনিয়োগের অর্ধেক লগ্নিও উঠে আসছে না।

মহামারীর হানার পর সিনেমা হলগুলো বন্ধ করতে হয়েছিল, তখন বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন সিনেমায় বিনিয়োগকারীরা। এখন প্রেক্ষাগৃহ খুললেও আশার আলো দেখাচ্ছে না।

মহামারী শুরুর আগে ২০১৯ সালে ফ্লপ সিনেমার হার ছিল ৩৯ শতাংশ, যা এখন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

মুম্বাইয়ে দুই কিশোরী মেয়ের ৪০ বছর বয়সী মা ক্রিস্টিনা সুন্দরেসান মহামারীর আগে সপ্তাহে অন্তত একটি সিনেমা হলে গিয়ে দেখতেন। এখন তার যাওয়া হয় কালেভদ্রে।

সুন্দরেসান বলেন, “যদি হাসির খোরাক পেতে চান, তাহলে সিনেমাগুলো দেখতে যেতে পারেন। আমি তার জন্য সিনেমা হলে যাব না।

“আগে আমার মেয়েরা আমাদের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি সিনেমা দেখতে যেত। এখন তারাও যেতে চায় না। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে কোরিয়ান শো এবং সিরিজগুলো নিয়েই তাদের আগ্রহ বেশি।”

আন্তর্জাতিক স্ট্রিমিং সার্ভিসমুখী এই যাত্রায় গতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সুন্দরেসান পরিবারই শুধু প্রভাব রাখছে না, যদিও ভারতে তুলনামূলকভাবে দেরিতে পাওয়া গিয়েছিল তা দেখার সুযোগ।

২০১৬ সালে নেটফিক্স ও আমাজন প্রাইম চালু হয় ভারতে। ততদিনে আমেরিকা ও ইউরোপের পাশাপাশি ভারতসহ এশিয়ায় প্যারাসাইট, অ্যাভেঞ্জার, স্কুইড গেম এবং গেম অফ থ্রোনসের মতো কনটেন্ট এসে গেছে।

ভারতে ১৪০ কোটি মানুষের চার ভাগের এক ভাগ এখন এই ধরনের স্ট্রিমিং ব্যবহার করছে বলে স্ট্যাটিস্টার তথ্য, যা ২০১৯ সালে ছিল এখনকার অর্ধেকের কম।

২০২৭ সাল নাগাদ স্ট্রিমিং সার্ভিস ব্যবহারকারীর সংখ্যাটি আরও বেড়ে ৩১ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাহলে ভারতের বিনোদন জগতের নেতৃত্ব নিয়ে নেবে স্ট্রিমিং সার্ভিস। অনেকটা উত্তর আমেরিকার মতো, যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশের দখল তারা নিয়ে নিয়েছে।

সমস্যার গোড়া কোথায়?

এক এক দশকে ভারতে সিনেমার আয় ফি বছরেই বাড়ছিল, মহামারী বিপর্যয়ের আগে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২০০ কোটি ডলারে। মহামারীর বিরতির পর এখন তাতে গতি আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

এই বছরের মার্চ থেকে প্রায় প্রতি মাসে ধারাবাহিকভাবে সিনেমার টিকেট বিক্রির হার কমেছে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং ফার্ম ইলারা ক্যাপিটালের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বলিউড ফিল্ম থেকে রায় কোভিড পূর্ববর্তী অবস্থার তুলনায় ৪৫ শতাংশ কমেছে।

প্রযোজক, পরিবেশকসহ এই জগতের আধা ডজন হর্তা-কর্তার সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স ধারণা পেয়েছে, দর্শক আপনা-আপনি মিলবে, এমন আশা করার কোনো সুযোগ নেই, আশা বাঁচিয়ে রাখতে হলে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।

সার্বিক অবস্থায় একটি ধূসর ভবিষ্যৎই দেখছেন সিনেমা সংশ্লিষ্ট চারজন নির্বাহী; ওটিটি বা ওভার-দ্য-টপ সাইটগুলোর জন্য দর্শকদের রুচির পরিবর্তন এবং মহামারীর জন্য মুক্তি আটকে যাওয়া সিনেমাগুলো নিয়ে তাদের এই উদ্বেগ।

ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাল্টিপ্লেক্স অপারেটর ইনোক্স’র চিফ প্রোগ্রামিং অফিসার রাজেন্দর সিং জায়ালা এসব নিয়ে কথা বলেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে।

তিনি জানান, প্রযোজকরা চিত্রনাট্যগুলো নিয়ে পুনরায় কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং অগ্রিম অর্থ দেওয়ার পরিবর্তে সিনেমার ব্যবসার ভিত্তিতে অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা ভাবছে।

“কেউ জানে না প্রকৃত সমস্যাটা আদতে কী? মহামারী চলাকালে কোনো সিনেমা রিলিজ হয়নি, প্রায় সবকিছু বন্ধ ছিল। ফলে মানুষের কাছে ওটিটি এবং বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট দেখার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল। তাই প্রশ্ন জাগে, দুই বছর আগে এমন কী ধরনের কনটেন্ট নিয়ে কাজ হয়েছে, যা এখন সময় উপযোগী নয়?”

জায়ালা ও অন্যান্য নির্বাহীরা বলছেন, এর মানে এই নয় যে এখনই সব শেষ। বলিউডের আগের অবস্থা হয়ত ফেরানো সম্ভবপর হবে না। তবে কয়েকটি সিনেমা ব্যবসাসফল হলেই এই শিল্পের পুনর্জীবন ঘটতে পারে। তবে নির্বাহীদের দ্রুত মানিয়ে নিতে হবে।

নয়াদিল্লির ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলেছেন, ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প সিনেমাগুলোর আয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশের উপর নির্ভরশীল।

গলদ গল্পে?

শতবর্ষী বলিউডের ভক্তদের মতে, অবস্থার উন্নতির জন্য প্রাসঙ্গিক এবং সময়োযোগী হওয়া প্রয়োজন। সমাজকে সঠিকভাবে চিত্রিত করতে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা আবশ্যক। সমকামী সম্পর্ক এবং এমন সব চরিত্র, যারা নিজেদের লিঙ্গ পরিবর্তন করেছে, এগুলো উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়।

নয়া দিল্লির কলেজছাত্রী বৈষ্ণবী শর্মার মতে, সিনেমার বিষয়বস্তুগুলোকে আরও প্রসারিত করা প্রয়োজন।

তিনি এক পোস্টে লিখেছেন, “স্টোরিলাইন একটি বড় সমস্যা এবং গত দুই বছরে দর্শকরা অনেক নতুন থিম আবিষ্কার পাশাপাশি নতুন কনসেপ্টের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। আমার মনে হয়, বলিউডের এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।”

তার এই লেখাটি গত মাসে যখন ওয়ালে ঝুলছিল, তখন বলিউড দুজন হিট অভিনেতা অক্ষয় কুমার ও আমির খানের বড় বাজেটের দুটি সিনেমা বক্স-অফিসে খাবি খাচ্ছিল।

ভাই-বোনের সম্পর্ক নিয়ে গড়ে ওঠা ‘রক্ষা বন্ধন’র দুর্বল গঠন অক্ষয় কুমারকে এমন কথা বলতে বাধ্য করে যে সিনেমাগুলো কাজ করছে না।

আমির খানের ‘লাল সিং চাড্ডা’ ১৯৯৪ সালের হলিউড হিট ‘ফরেস্ট গাম্প’র রিমেক। সিনেমাটি টিকেট বিক্রি করে প্রায় ৫৬ কোটি রুপি আয় করেছে, যা মূল বাজেটের এক-চতুর্থাংশের মতো।

ফ্লপ সিনেমা দুটি দুজন হিট নায়কের জন্য ছিল ব্যতিক্রমী। তাদের অ্যাকশন কিংবা কমেডি সিনেমাগুলো বছরের পর বছর প্রথম সপ্তাহেই লগ্নি তুলে এনেছিল। অথচ দর্শক খরার কারণে মাল্টিপ্লেক্সগুলো লাল সিং চাড্ডার প্রদর্শনী এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে আনে বলে জানান জায়লা।

যার দুটি বড় বাজেটের মুক্তির অপেক্ষায়, বলিউডের এমন একজন প্রযোজক বলেছেন, অভিনেতাদের বাজেট ও স্ক্রিপ্ট নিয়ে নতুন করে ভাবছেন তারা।

“দর্শকদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে আমাদের এবং তাদের চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে। আমার কাছে এর আর কোনো সমাধান নেই,” বলেন তিনি।

অর্থনৈতিক সঙ্কট

মহামারী ও যুদ্ধের বাজারে চলচ্চিত্র অনুরাগীদের কাছে এখন খরচাটাও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতও জীবনযাত্রার ব্যয়-সঙ্কটের সঙ্গে লড়াই করছে, সেসময় সিনেমা দেখার জন্য বাজেট রাখা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে একটি সিনেমা দেখতে চাইলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ হতে পারে ৩০০০ থেকে ৫০০০ রুপি, অথচ ভারতে বেশিরভাগ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। সেখানে এটি বিলাস হয়ে দাঁড়ায়। যখন একটি পরিবারের গড়ে বার্ষিক আয় দেড় লাখ রুপির মতো।

এ্ই ব্যয়ের বিপরীতে নেটফ্লিক্সের মতো স্ট্রিমিং সেবাগুলোর মাসিক গ্রাহক ফি শুরু হয় ১৫০ টাকা থেকে।

“কিছু বিষয়ে কাটছাঁট আনতে হবে। বাজেট নিয়ে পুনরায় কাজ করতে হবে এবং সিনেমা দেখার খরচও কমাতে হবে কিছুটা,” বলেছেন ফিল্ম প্রোডাকশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মালিক অনিল থাদানি।

বলিউড অভিনেত্রী রাভিনা ট্যান্ডনের স্বামী থাদানি বলেন, “হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সিনেমার মধ্য দিয়ে জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না। আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হিন্দি ভাষার সিনেমাগুলোর সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারছে না।”

মুম্বাইয়ের সুন্দরেসান বলছেন, “থিয়েটারে যাওয়া, আসনে বসে থাকা এবং নিজের পছন্দ অনুযায়ী সিনেমা দেখতে না পারলে সেটাকে সময়ের অপচয় মনে হয়। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিনোদনের জন্য আরও ভালো কনটেন্ট আছে।”

ইলারা ক্যাপিটালের মিডিয়া বিশ্লেষক করণ তৌরানি, শীর্ষ অভিনেতাদের পারিশ্রমিকে একটি ভারসাম্য আশা করছিলেন তিনি। যেখানে অভিনেতার আয় সিনেমার আয়ের অনুপাতে হবে। আর সিনেমার বাজেটের বেশিরভাগ এটি নির্মাণ এবং স্পেশাল ইফেক্টের পেছনে ব্যয় হবে।

“পাঁচ মাসেরও বেশি সময়ে মাত্র তিনটি হিট সিনেমা, আর সেগুলোও বড় কোনো তারকার নয়।”

হুট করেই বলিউডের কোনো পরিবর্তন দেখছেন না তিনি, বরং সামনে খারাপ সময়ই দেখছেন তৌরানি।

“আগামী বছরের শুরুর দিকে একটি বড় ধাক্কার মুখোমুখি হবে ইন্ডাস্ট্রি, যখন মহামারী চলাকালীন এবং তার আগে নির্মিত সিনেমাগুলো মুক্তি পাবে।”