এই বলিউড তারকার ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে তার সিনেমাগুলোর কিছু অদেখা ছবি নিয়ে ভারতের ১৭টি শহরে চলছে প্রদর্শনী।
Published : 11 Oct 2022, 08:51 AM
বলিউড শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন, পেরিয়ে গেলেন ৮০ বছর। অভিনয়ের জাদু-দক্ষতায়-ভরাট কণ্ঠের একজন অমিতাভই ভারতের চলচ্চিত্রকে শাসন করছেন দশকের পর দশক।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বলিউডের অনেক তারকার ‘তারকা’ দাপট কমে গেলেও বিরল নজিরই গড়েছেন অমিতাভ। বহু আগেই তিনি স্পর্শ করেছেন জনপ্রিয়তার চূড়া, কিন্তু টানা পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারেও ভাটা পড়েনি সেটি জনপ্রিয়তায়, যে খ্যাতি বহমান তুমুল স্রোতে। বহু ভাষা, বহু বর্ণে-ধর্মে বিভাজিত ভারতে অমিতাভজি একজনই। বক্স অফিসের বহু প্রজন্মের তারকার সঙ্গে টক্কর দেওয়া এক অভিনেতা।
মঙ্গলবার অমিতাভের ৮০তম জন্মদিনকে স্মরণীয় রাখতে বলিউড মেগাস্টারের প্রথম দিকে অভিনীত সিনেমাগুলোর অদেখা ছবি নিয়ে ৮ থেকে ১১ নভেম্বর ভারতের ১৭টি শহরে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন।
সেই সিনেমাগুলোর কয়েকটির গল্প তুলে এনেছে বিবিসি। ছবিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ভারতে চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ, লেখক এবং সংরক্ষক এসএমএম আউসাজার কাছ থেকে, যিনি এমন সংরক্ষণের কাজ করছেন তিন দশক ধরে।
শুধু আলোকচিত্র প্রদর্শনীই নয়, ‘বচ্চন ব্যাক টু বিগিনিং’ শিরোনামে ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুর একটি মাল্টিপ্লেক্স চেইন ‘পিভিআর’র সহযোগিতায় বিগ বির ১১টি সিনেমা দেখানোর আয়োকজন করেছেন ওই ১৭ জেলার ২২টি হলে।
বাছাই করা ১১টি সিনেমা হল- ডন, কালা পাথর, কালিয়া, কাভি কাভি, অমর আকবর অ্যান্টনি, নমক হালাল, অভিমান, দিওয়ার, মিলি, সত্তে পে সত্তা, চুপকে চুপকে। এই সিনেমাগুলো ভারতের ১৭টি শহরের ২২টি হলে দেখানো হচ্ছে।
১৯৭৩ সালে অমিতাভ ও জয়ার তুমুল আলোচিত সিনেমা ‘অভিমান’। পরিচালক ছিলেন হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়। স্বয়ং অমিতাভের মতেই ‘অভিমান’ একটি ‘ক্ল্যাসিক’ সিনেমা। এর ‘তেরে মেরে মিলন কি এ’র গানটির আবেদন গত চল্লিশ দশকেও ফুরোয়নি।
সিনেমায় অমিতাভ তার স্ত্রী জয়ার গানের জগতের খ্যাতির ছটায় ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যেতে থাকেন। স্ত্রীর সেই সাফল্য মানতে অপরাগ গায়ক স্বামী রুদ্ধ করেন তার স্ত্রীর গান। কিন্তু জীবনের এক পর্যায়ে এসে সেই কাজের অনুতাপ-গ্লানিতে বিদ্ধ হন তিনি। বোধদয়ে গানে ফিরিয়ে আনেন স্ত্রীকে।
এই দম্পতির বিয়ের এক মাস পরে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি ব্যবসায় ভাসিয়েছে বক্স অফিসকেও। অমিতাভ-জয়া জুটির জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম সিনেমা ‘অভিমান’র কথা দর্শকেরা মনে রেখেছেন আজও। এই সিনেমা অমিতাভের ক্যারিয়ারকেও অনন্য করে তোলে।
‘দেবা’ সিনেমাটি শেষমেশ মুক্তির আলো দেখেনি। বলিউডের শীর্ষ পরিচালক সুভাষ ঘাই অবশ্য তার ওই সিনেমায অমিতাভকে নাম ভূমিকার জন্য ভাবেননি। জানা যায়, খুব তাড়াহুড়া করে ‘দেবা’র শুটিংও সারছিলেন নির্মাতা। কিন্তু পরে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ছবিটি তোলা হয় ১৯৮০ সালে সিনেমার শুটিংয়ের কোনো একটি মুহূর্তে।
পরে সংবাদ মাধ্যমের কাছে দুঃখকপ্রকাশ করে ঘাইয়ের ভাষ্য ছিল, “অমিতাভের সঙ্গে যে কাজটি আমি করতে পারিনি এজন্য আমি মর্মাহত। সম্পূর্ণ আমার কিছু ভুলভ্রান্তিতে সিনেমার কাজটি এগোয়নি। পরে নতুন করে কাজ শুরু করার সুযোগও আসেনি।”
এই নির্মাতার আক্ষেপ হল, পরবর্তীতে তিনি অনেকবার অমিতাভকে নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর কথা ভেবেছেন। কিন্তু যখন ‘অমিতাভ’কে নিয়ে কাজ করার ভাবনা হয়, তখন এমন একটি প্রজেক্টের দরকার হয়, যেখানে এই গুণী অভিনেতাকে তার যোগ্য চরিত্র দিতে হবে।
১৯৭৩ সালে ‘বাঁধে হাত’ সিনেমায় অমিতাভের ব্যতিক্রমী অভিনয় দৃষ্টি কাড়ে সমালোচকদের। এখানে অমিতাভকে ‘একজন ‘চোরের’ চরিত্রে দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তবে বক্স অফিসে ‘বান্ধে হাত’ খুব একটা ভালো ব্যবসা করেনি।
নির্মাতা হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় তার ‘জুরমানা’ সিনেমায় অভিনেত্রী রাখীর বিপরীতে আনেন অমিতাভ বচ্চনকে। ১৯৭৯ সালে নির্মাণ করা হয় এই সিনেমাটি। এখানে বচ্চনকে একজন ফুর্তিবাজের চরিত্রে দেখা যায়। রাখী এবং অমিতাভ জুটির আটটি সিনেমার মধ্যে ‘জুরমানা’কে সেরা একটি হিসেবে আখ্যায়িত করেন সিনেমা সমালোচকরা।
তবে অমিতাভের ভাষ্য, ‘জুরমানা’র জনপ্রিয়তায় তার নিজের তেমন কোনো কৃতিত্ব আছে বলে মনে করেন না তিনি। কারণ পরিচালক হৃষিকেশ তাকে যেমনটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ঠিক তেমনটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
মনমোহন দেশাই পরিচালিত অ্যাকশন সিনেমা ‘মর্দ’এ অমিতাভ এক ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীর ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন, যিনি লড়াই করেন শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। অমিতাভকে অ্যাকশন সিনেমায় নায়ক বানানোর জন্য পরিচালক মনমোহন দেশাইয়ের ভূমিকা অন্যতম।
‘মর্দ’ মুক্তির পর কেউ কেউ এর কাহিনীর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই সিনেমায় অমিতাভকে অযাচিতভাবে ‘সুপারম্যান’ করে তোলা হয় বলে সমালোচনাও উঠেছিল এক চিত্র সমালোচকের কাছ থেকে। এই ধরনের সিনেমা দর্শক গ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ হলেও এই সিনেমাটিও হিট।
অমিতাভ বচ্চন ‘হিরো হীরালাল’ সিনেমায় আসেন অতিথি চরিত্রে। প্রধান চরিত্রে ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, যিনি একজন অটোচালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সিনেমার গল্পে নাসিরুদ্দিন একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যায়। পরে অটোচালকের প্রেমে পড়েন ওই অভিনেত্রীও।
এই একটি সিনেমাতেই মেহতা অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।
এদিকে, ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুর জানান, তার প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই মুম্বাইয়ে অমিতাভের সিনেমার একটা আর্কাইভও গড়ে তুলেছে। আধুনিক কায়দায় নির্মিত ওই আর্কাইভে বিগ বি’র ৬০টি সিনেমা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
অমিতাভ ৮০ পেরিয়ে
জন্ম: ১৯৪২ সালে ১১ অক্টোবর ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর জন্ম অমিতাভ বচ্চনের। বাবা প্রখ্যাত কবি হরিবংশ রাই বচ্চন এবং মা শিখ-পাঞ্জাবি সমাজকর্মী তেজি বচ্চন।
প্রথম নাম টেকেনি: জন্মের পর প্রথম নাম দেওয়া হয়েছিল ইনকিলাব, আর পদবি শ্রীবাস্তব। কিন্তু কোনোটিই টেকেনি, ইনকিলাব শ্রীবাস্তব হয়ে যান অমিতাভ বচ্চন।
কর্ম শুরু অন্য পেশায়: ৫০০ রুপি বেতনে কলকাতায় একটি জাহাজ কোম্পানিতে চাকরির মাধ্যমে পেশাজীবন শুরু অমিতাভের। অভিনেতা হওয়ার নেশায় পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে।
প্রথম সিনেমা: ‘সাত হিন্দুস্তানি’ দিয়ে চলচ্চিত্রে যাত্রা। ওই সিনেমায় প্রথম উপার্জন এক হাজার রুপি।
ব্যর্থতা: ভরাট কণ্ঠের জন্য সুপরিচিত হলেও ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র অডিশন থেকে দু-দুবার বাদ পড়েন অমিতাভ।
গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাগুলো: আনন্দ, গুড্ডি, অভিমান, জঙ্জির, সওদাগর, দিওয়ার, শোলে, দো আনজানে, অমর আকবর অ্যান্টনি, ডন, সুহাগ, লাওয়ারিশ, শাহেনশাহ, সিলসিলা, ম্যায় আজাদ হু, অগ্নিপথ, হাম, বুম, বাগবান, ব্ল্যাক, সরকার, নিঃশব্দ, কুলি, শক্তি, দোস্তানা, পা, অরক্ষণ, পিঙ্ক, সত্যাগ্রহ, রিস্তা, মোহাব্বাতে, ভাগবান, কাভি খুশি কাভি গম, ভূতনাথ, ভুতনাথ রিটার্ন, গুলাবো সিতাবো, পিকু।
সম্মাননা: কাজের স্বীকৃতিতে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার আইফা, স্টারডাস্ট, জি সিনে পুরস্কার, পিপলস চয়েজসজ অসংখ্য পুরস্কার ঘরে তুলেছেন অমিতাভ। এছাড়া ২০০৭ সালে ফ্রান্সের তরফ থেকে পান ‘নাইট অব দ্য লন্ডন’।
পারিবারিক জীবন: আভিনেত্রী জয়া ভাদুড়ি তার জীবনসঙ্গী। দুই সন্তান শ্বেতা বচ্চন ও অভিষেক বচ্চন। পেশায় অভিনেতা অভিষেকে স্ত্রী ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন এবং তাদের একমাত্র সন্তান আরাধ্যা বচ্চন।
রাজনৈতিক জীবন: রাজনীতিতেও জড়িয়েছিলেন অমিতাভভ। ১৯৮৪ সালে পারিবারিক বন্ধু প্রয়াত রাজীব গান্ধীর সমর্থনে লোকসভা আসনের জন্য উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এইচ এন বহুগুণার বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ান অমিতাভ এবং বহু ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। তবে তিনি পদত্যাগ করেন তিন বছরের মাথায়।
কৌন বনেগা ক্রোড়পতি: অমিতাভের ক্যারিয়ারের কিছুটা মন্দা দেখা দেয় নব্বইয়ের দশকে। অমিতাভ নেন গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত, যার সুবাতাস বইছে আজ অবধি। অমিতাভ মনোযোগী হন ছোট পর্দায়। সঞ্চালকের ভূমিকায় আসেন ভারতের জনপ্রিয় গেম শো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র।
এখনকার ব্যস্ততা: ১৯০টির বেশি সিনেমায় কাজ করা অভিতাভের জয়রথ ছুটছেই। সম্প্রতি অয়ন মুখার্জি পরিচালিত হালের সবচেয়ে আলোচিত বলিউড ছবি ব্রহ্মাস্ত্রে দেখা গেছে অমিতাভকে। এছাড়া তিনি কন্নড় অভিনেত্রী রশমিকা মানদানা এবং নীনা গুপ্তের সঙ্গে বিকাশ বেহলের ‘গুডবাই’ সিনেমায় বাবার চরিত্রে আছেন, যা মুক্তি পায় রোববার। সম্প্রতি সুরুজ বরজাতিয়া পরিচালিত ‘উঁচাই’ সিনেমার শুটিং করেন অমিতাভ, যা মুক্তি পাবে ১১ নভেম্বর।