‘জেকে ১৯৭১’ মুক্তির পর গল্প নিয়ে বিতর্ক

অমিত মল্লিক নামে একজন দাবি করেছেন, তার গল্প চুরি করেছেন ফাখরুল আরেফিন খান। এই নির্মাতা তা অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি মামলা লড়তেও রাজি।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2023, 05:43 PM
Updated : 13 March 2023, 05:43 PM

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত ‘জেকে ১৯৭১’ সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর এর কাহিনীকার নিয়ে উঠল বিতর্ক। অমিত মল্লিক নামে একজন দাবি করেছেন, এই গল্প তার। তবে তা উড়িয়ে দিচ্ছেন নির্মাতা ফাখরুল আরেফিন খান।

বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস বলছে, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন ভিন্ন চিত্রনাট্য নিয়ে চলচ্চিত্র হতেই পারে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ফ্রান্সের অর্লি বিমানবন্দরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) একটি বিমান ছিনতাই করেছিলেন ফরাসি যুবক জ্যঁ কুয়ে।

ঐতিহাসিক সেই ঘটনা চলচ্চিত্রে তুলে এনেছেন ভুবন মাঝি, গণ্ডির নির্মাতা ফাখরুল আরেফিন।

তার ‘জেকে ১৯৭১’ সিনেমাটি মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নিয়েছে সেরা ঐতিহাসিক সিনেমার পুরস্কার। প্রদর্শিত হয়েছে ইস্তাম্বুলসহ বেশ কিছু উৎসবে। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও সিনেমাটি দেখানো হয়।

সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সৌরভ শুভ্র দাশ। এছাড়া রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেতা ফ্রান্সিসকো রেমন্ড, রুশ অভিনেত্রী ডেরিয়া গভ্রুসেনকো, অভিনেতা নিকোলাই নভোমিনাস্কি, পশ্চিমবঙ্গের সব্যসাচী চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল প্রমুখ।

গত ৩ মার্চ বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় জেকে ১৯৭১। তার সপ্তাহ পরই বিতর্ক তৈরি হল অমিত মল্লিকের দাবি তুললে।

অমিতের দাবি, এই ঘটনা নিয়ে তিনিই প্রথম সিনেমার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। নাম ঠিক করেছিলেন ‘পশ্চিম থেকে পূর্ব’। চিত্রনাট্যের কপিরাইট নিবন্ধনও নেন তিনি।

তিনি বলছেন, চিত্রনাট্যটি ফাখরুল আরেফিন নকে তিনি মেইলে পাঠিয়েছিলেন পরামর্শ নেওয়ার জন্য। কিন্তু ফাখরুল আরেফীন সেই কাহিনী দিয়ে নিজেই সিনেমা বানিয়ে ফেলেন।

তবে ফাখরুল আরেফিন দাবি করছেন, অমিতের সেই মেইল তিনি খুলেও দেখেননি। আর এত দিন পর এই দাবি তোলার মধ্যে দুরভিসন্ধি দেখছেন তিনি।

Also Read: বাংলাভাষীদের জন্য নয়, জেকে ৭১ একটি আন্তর্জাতিক সিনেমা: ফাখরুল আরেফিন

বিতর্কের সূত্রপাত

অমিত মল্লিক রোববার ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন, তাতে তিনি জেকে ১৯৭১ সিনেমার গল্পটি তার বলে দাবি তোলেন।

তিনি লেখেন, “ধরেন আপনি আপনার মেধা, শ্রম আর সময় দিয়ে খুব ভাল একটা কাজ করার প্রস্তুতি নিলেন। সেই কাজকে বাস্তবে আনতে অভিজ্ঞ কারও কাছে গেলেন পরামর্শের জন্য। উনি বললেন মেইল করে দিতে। সময় করে দেখে পরামর্শ দেবেন। আপনি মেইল করলেন। ভাবলেন আপনার তো সরকারি কপিরাইট করা আছে, অসুবিধা কী? তারপর একদিন দেখলেন দীর্ঘ আদরে লালিত সন্তানসম সেই কাজ একটু ভিন্ন মোড়কে বাজারে প্রকাশিত। কেমন লাগবে?”

অমিত লিখেছেন, “আমরা গেছিলাম অগ্রজ হিসাবে টেকনিকাল বিষয়গুলোর বিষয়ে সাজেশন নিতে। ফলাফল, সিনেমা বানিয়ে রিলিজ অব্দি হয়ে গেল! ওহ, যারা বোঝেননি, আমি গত ৩ মার্চ রিলিজ হওয়া JK-71 সিনেমার কথা বলছি। তবে আমার বানানো নয়। আমার কষ্ট, আমার ভাবনা, আমার ব্রেইন চাইল্ড কেন এভাবে হারাতে হবে? পিছনের ইতিহাসটা জানার জন্য ছবিগুলো শুধু মন দিয়ে দেখার অনুরোধ রইলো। হোক, তবু বাংলাদেশে সিনেমা হোক।”

ফেইসবুক পোস্টে কয়েকটি ছবিও শেয়ার করেন অমিত মল্লিক। যেখানে কপিরাইট নিবন্ধনের সিল, গল্পের কাহিনি সংক্ষেপ রয়েছে। অমিতের পোস্টের নিচে অনেকে ফাখরুল আরেফিনকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন।

দুজনের দুরকম বক্তব্য

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় অমিত বলেন, “২০১৫ সাল থেকে ‘পশ্চিম থেকে পূর্ব’ নামে সিনেমাটি নির্মাণের পরিকল্পনা করি।”

অমিতের ভাষ্য, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি চিত্রনাট্যটি কপিরাইট নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হলে ১১ ফেব্রুয়ারি সেটি কপিরাইট অফিস থেকে নিবন্ধন সম্পন্ন হয়। এর আগে ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ফাখরুল আরেফিনকে মেইলে চিত্রনাট্যটি পাঠিয়েছিলেন তিনি।

তার এই দাবি নিয়ে ফাখরুল আরেফিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি সেই মেইলটি খুলেও দেখিনি। এখন অমিত মল্লিকের ফেইসবুক পোস্টে দেখেছি, তিনি আমাকে মেইল করেছিলেন।

“উনি তো এত পরিচিত কোনো নির্মাতা বা ব্যক্তি নন। হয়ত তিনি আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন, আমি তাকে বলেছিলাম মেইলে পাঠাতে। তবে সেই মেইলটি আমি দেখিনি।”

প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই শুটিংয় শেষে এখন মুক্তির পর এই অভিযোগ তোলার জবাবে অমিত মল্লিক বলেন, “আমি আসলে এই বিষয়টি নিয়ে চুপ থাকতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার টিমের লোকজন, আমাকে বলছেন কথা বলা উচিৎ। নৈতিকভাবে আমরা কতটা অবক্ষয়ের মধ্যে থাকি, সেটি জানানো দরকার।”

ফাখরুল বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, সেই কাহিনি নিয়ে যে কেউ সিনেমা নির্মাণ করতে পারে। আমার সিনেমা দেখেন, তারপর অমিত মল্লিকের কাহিনীর সাথে মিলিয়ে নিন। আর অমিত মল্লিক যদি মনে করেন, তার গল্প থেকে বানিয়েছি। তাহলে তিনি কপিরাইট আইনে মামলা করতে পারেন। আমি সেটা ফেস করব।”

মামলার পরিকল্পনা আছে কি না- জানতে চাইলে অমিত মল্লিক বলেন, “আমি কেবল একটা নৈতিক অবক্ষয়ের দিক সামনে আনতে চেয়েছি। মামলা করার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।”

‘পশ্চিম থেকে পূর্ব’ নামের সেই চিত্রনাট্যটি নিয়ে এখন সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে অমিত বলেন, “আপাতত সিদ্ধান্ত জানাতে পারছি না। আমার টিম মেম্বারদের সাথে আলাপ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”

অমিতের অভিযোগ ধরে ‘গল্প চুরি’র যে সমালোচনা হচ্ছে, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফাখরুল আরেফিন ।

তিনি বলেন, “কেউ একজন অভিযোগ করল, আর কোনো রকম যাচাই না করে আমাদের গণমাধ্যমও অনায়াসে চোর লিখে দেয়। অথচ সত্যটা জানতেও চায় না। এটি ৩ বছরে প্রকাশ্যেই তো বানিয়েছি, গোপনে তো কিছু করিনি। ২০২০ সাল থেকে গণমাধ্যমের সবাই তো জানছেন। সিনেমাটির সেন্সর ছাড়পত্র নিয়েছি। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারও পেয়েছে।

“এখন কে না কে অভিযোগ তুলছে, তার প্রেক্ষিতে কোনো কোনো গণমাধ্যম বলে দিচ্ছে- গল্প চুরি করেছি। এটা কেমন কথা?”

যা বলছে কপিরাইট অফিস

জেকে ১৯৭১ নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার মো. দাউদ মিয়া বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন ভিন্ন চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমা হতে পারে বলে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো কাহিনীকার থেকে যদি গল্প বা চিত্রনাট্য নিয়ে সেই গল্পটি বা চিত্রনাট্য থেকে যদি সিনেমা নির্মাণ করা হয়, তবে সেই কাহিনীকার বা চিত্রনাট্যকারের নাম উল্লেখ থাকতে হবে।

“কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং ঘটনার পটভূমিতে বা আলোকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে আরও অনেক সিনেমা হতে পারে।”

সেক্ষেত্রে প্রতিটি চিত্রনাট্যের আলাদাভাবে কপিরাইট নিবন্ধন নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানান দাউদ মিয়া।