‘পোড়ামন’ চলচ্চিত্রটিকে একটি শব্দে মূল্যায়ন করলে বলতে হয়-- থোড়া থোড়া; সিনেমাটিতে সবকিছুই হয়েছে বা আছে থোড়া থোড়া বা কিছু কিছু।
Published : 13 Jul 2013, 11:19 AM
পোড়ামন চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে ১৪ জুন ২০১৩। সিনেমাটির পরিচালক জাকির হোসেন রাজু। কাহিনি রচনা করেছেন আবদুল্লাহ জহীর বাবু, চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক নিজেই। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন শফিউল্লাহ শাহীন, সম্পাদনা করেছেন তৌহিদ হোসেন চৌধুরী। স্থিরচিত্র গ্রহণ করেছেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী। শব্দগ্রহণের কাজ করেছেন মো. জাবেদ। শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন কালানধর। নৃত্য পরিচালনা করেছেন মাসুম বাবুল। সিনেমাটির গানগুলো লিখেছেন ও সুর করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও শফিক তুহিন। সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন শফিক তুহিন। কণ্ঠ দিয়েছেন ন্যান্সি, পুলক, খেয়া, মিমি ও শফিক তুহিন। সিনেমাটি প্রযোজনা করেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছে সাইমন সাদিক ও মাহিয়া মাহি। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন আনিসুর রহমান মিলন, আলীরাজ, বিপাশা, ডন, রতন, রেহেনা জলি, মনিরা মিঠু, গুলশান আরা এবং মিশা সওদাগর।
‘পোড়ামন’ চলচ্চিত্রটিকে একটি শব্দে মূল্যায়ন করলে বলতে হয়-- থোড়া থোড়া; সিনেমাটিতে সবকিছুই হয়েছে বা আছে থোড়া থোড়া বা কিছু কিছু। বিপরীতক্রমে বলা যায়, মোটা দাগে কোনো গুরুত্বপূর্ণ গুণ বা বৈশিষ্ট্যই বাদ পড়েনি পোড়ামন-এ। কাহিনি যেমন থোড়া থোড়া দাঁড়িয়েছে, পরিচালনাও হয়েছে থোড়া থোড়া। অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, নাচ-গান, স্পেশাল ইফেক্ট ইত্যাদি যেমন থোড়া থোড়া উৎরে গেছে, তেমনি মারদাঙ্গা অ্যাকশন, থ্রিলারের থ্রিল, স্থ‚ল কিন্তু কার্যকর হাস্যরস, গল্পে বাঁকবদল ও কাহিনিতে নতুনত্ব-ও আছে থোড়া থোড়া। সব মিলিয়ে তাই থোড়া থোড়া পোড়ামনের সার্থক বিশেষণ হতেই পারে।
বাংলা সিনেমায় দীর্ঘদিনের প্রথা-- নায়ক-নায়িকা হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে কিংবা ক্ষেতের আল ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে বড় হয়ে যায়। পোড়ামন-এ পরিচালক-কাহিনিকার এ প্রথা ভাঙতে একদমই আগ্রহ দেখাননি; নায়ক-নায়িকা দুজনে হাত ধরে ক্ষেতের আল ধরে দৌড়াতে দৌড়াতেই বড় হয়ে যায়। তবে পটভ‚মিটি নতুন; কাহিনিটিকে তারা নিয়ে গেছেন বান্দরবানে।
এই কাহিনি বান্দরবানে নিয়ে যাওয়াটা যে নিছকই পাহাড়ে দুই বাঙালি নরনারীর নাচ-গান দেখানোর বাসনায় নয়, বরং জরুরিই ছিল, চাইলে তার কিছু কারণ বের করা যেতে পারে। একটি কারণ এ রকম হতে পারে-- নায়কের বাবা নিয়মিত মদ খায় ও জুয়া খেলে। বাঙালি সমাজে রেখে নায়কের বাবাকে মদ খাওয়ানো ও জুয়া খেলানো রীতিমতো গর্হিত একটা কাজ হয়ে যেতে পারত। আদিবাসী-অধ্যূষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এদিক দিয়ে বেশ সুবিধাজনক। এমনি ছোটখাটো আরও বেশ কিছু কারণ চাইলেই নির্ণয় করা যেতে পারে। তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা হিসেবে বান্দরবান পছন্দ করার পর, শেষের দিকে ঝিকঝিক শব্দে হল কাঁপিয়ে পর্দায় ট্রেনটিকে না আনলেই বোধহয় ভালো হত।
সিনেমাটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক-- সিনেমাটির গল্পে আছে রোমান্স, কমেডি, থ্রিল, অ্যাকশন, ট্র্যাজেডি; সবগুলোই থোড়া থোড়া। কোনোটিই আমাদের মনকে দ্রবীভ‚ত করে না, কেবল একটু নাড়াচাড়া দিয়ে যায় মাত্র। বিরতির আগ পর্যন্ত গল্পে রোমান্সই মুখ্য; নায়ক-নায়িকা কেবল প্রেমই করে যাচ্ছে। নায়ক মদ্যপ বাবা আর নিষ্ক্রিয় মাকে উপেক্ষা করে নায়িকার পরিবারের ভরণ-পোষণ দিয়ে যাচ্ছে। আর মদ্যপ বাবা ছেলের কাছ থেকে ‘মাল’ খাওয়ার টাকা চেয়েও পাচ্ছে না। শেষে বাটিভর্তি মাংস সামনে রেখে বলে উঠছে, “মাংস দিয়া কী করুম, মালই তো নাই!”
তবে এরপরেই কাহিনিতে প্যাঁচ লেগে যায়। পাশের গাঁয়ের ধনাঢ্য ব্যক্তি তার ছেলের সঙ্গে অসাধারণ সুন্দরী নায়িকার বিয়ে দিতে চাইলে, স্বামীহীন ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়িকার মা অতীব আগ্রহ সহকারে তাতে সায় দেন। শুনে, এতদিন মা ডেকে আসা নায়িকার মাকে খুন করতে ছুটে আসে কিছুটা সাকিব আল হাসানের মতো চেহারার নায়ক। তারপর জেল, এবং ফ্ল্যাশব্যাক শেষ।
এরপর কাহিনি দ্রুত পাক খেতে থাকে। নায়ক জেল থেকে পালিয়ে ফিরে এসে নায়িকার বিয়ে ঠেকায়, পুলিশ অফিসার নায়ককে ধরতে ছুটে আসে নায়ক-নায়িকার গ্রাম ‘চাঁন্দের গাঁও’য়ে, ধরে ফেলে নায়ককে, যুগল অনুরোধে নায়িকাকে নিয়ে চলে তাদের সঙ্গে, পথে দুর্ঘটনায় নায়কের উপর তিতিবিরক্ত অফিসারের দিলখোশ হয়ে যায়, খুশির আতিশয্যে সে নায়িকাকে নিয়ে যায় নিজের বাসায় রাখবে বলে, ওদিকে কয়েকদিন ধরে প্রতীক্ষায় থাকা অফিসারের স্ত্রী সুন্দরী মেয়ে নিয়ে স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেখে শুরু করে দেয় তুলকালাম। এমনি করে কাহিনি এক বিশাল সামাজিক সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে পতিত হয়, যেখান থেকে উদ্ধার পাওয়াটা একরকম অসম্ভব বলেই বোধ হয়।
অবশ্য এই মুন্সিয়ানা পোড়ামন-এ জাকির হোসেন রাজু খুব একটা দেখাতে পারেননি। মানে কাহিনির যেটুকু সিনেমাটিক, সেটুকু তার মুন্সিয়ানায় দর্শকের কাছে তেমন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। একেবারেই যে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, তাও নয়; বরং থোড়া থোড়া বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে, ঘটনাটি অবশ্যম্ভাবী ফলাফল রূপে প্রতীতি জন্মায়নি। যেমন, নায়ক-নায়িকার প্রেমের কার্যকারণ বোঝা গেলেও, প্রেম গড়ে ওঠা পরিষ্কার নয়; বরং হঠাৎ করেই তারা পাহাড়ে-মেঘলায়-সাইকেলে প্রেম করতে শুরু করে দেয়। আবার শেষের দিকে কাহিনি যখন একের পর এক মোড় নিচ্ছে, তখনও ঘটনাগুলো প্রতিষ্ঠিত নয়। তবে, ঘটনাগুলো একেবারে অবান্তরভাবেও ঘটেনি; যাকে বলে, ঘটনাগুলো থোড়া থোড়া কার্যকারণে আবদ্ধ। এই কার্যকারণের দুর্বলতাগুলো পরিচালক তার মুন্সিয়ানায় পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারেননি; ফাঁক থেকে গেছে অনেকখানিই। তবু বিনোদনের আশা নিয়ে গেলে, যদি কিছুটা ছাড় দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে পোড়ামন থোড়া থোড়া উৎরে যেতেই পারে।
বাংলা সিনেমায় মন্তাজের ব্যবহারও বহু পুরনো, এবং প্রায়শই স্থূল। এই স্থূল মন্তাজের বৃত্ত পুরোপুরি ভাঙেনি পোড়ামন-এও। নায়ক-নায়িকার রোমান্সের এক পর্যায়ে নায়কের বন্ধুকে বনেবাদাড়ে প্রেম করতে দেখে নায়িকা যৌবনভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে নায়ক ছিল আশ্চর্যজনকভাবে নির্লিপ্ত। নায়িকার এই যৌবনভারাক্রান্ত হয়ে পড়ার সমাপ্তি কোনো ঘটনায় বা অঘটনে হয় না; বরং হয় এক স্থ‚ল মন্তাজে। রাতভর ঝড়-বৃষ্টি শেষে নায়িকার ঘরের চালে গাছ ভেঙে পড়ে!
পুলিশ অফিসার চরিত্রে আনিসুর রহমান মিলনও নামের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি। তবে দর্শকদের বিনোদিত করতে পেরেছেন কুতুব চরিত্রে রতন এবং মিলনের স্ত্রী চরিত্রে বিপাশা। নায়িকার মায়ের চরিত্রে মনিরা মিঠু খারাপ করেননি। আর মিশা সওদাগরের সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি ছিল মিশা সওদাগরের মতোই প্রাণবন্ত, খলনায়কোচিত।
সিনেমাটির সিনেমাটোগ্রাফির বর্ণনায়ও ওই ‘থোড়া থোড়া’ শব্দবন্ধ আসবে। কিছু কিছু জায়গায় ক্যামেরার কাজ প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে যেমন, তেমনি কিছু কিছু জায়গায় ক্যামেরার কাজ রীতিমতো চোখের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। এবং দুঃখজনকভাবে, পীড়াদায়ক অংশগুলোই সিনেমাতে বেশি সংখ্যায় চোখে পড়ে এবং চোখ পোড়ে।
সিনেমার গানগুলোও তেমন আহামরি নয়, থোড়া থোড়া চলে। টাইটেল সং হিসেবে ‘পোড়ামন’ গানটি একদম মন্দ নয়। ‘বিধাতা জানে’ ও ‘পরির মুখে খুশির হাসি’ গানদুটোও ভালো। আর ‘প্রেমের কলসি উছলায়’ গানটি খানিকটা আইটেম সংয়ের মতো, যদিও তাতে কোনো আইটেম গার্ল নেই; নায়িকা নিজেই সে দায়িত্ব পালন করেছেন। গানগুলোতে নায়কের নাচ তেমন আগ্রহোদ্দীপক না হলেও, নায়িকার নাচ বেশ আকর্ষণীয়। নায়িকা মাহী ধ্রুপদী নাচ না শিখলেও, তার অঙ্গসঞ্চালন বেশ জড়তাশূন্য, কাজেই উপভোগ্য। সমস্যা কেবল, সকল ভাবের গানেই তার মধ্যে ‘এরোটিক ফিল’ চলে আসে। অন্যদিকে নায়কের নৃত্যকুশলতাও তার অভিনয়ের মতো।
সিনেমাটির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক দুটো-- প্রথমত, কোপ দেওয়ার দৃশ্যগুলোর দৃশ্যায়ন। যেমন, নায়ক নায়িকার মাকে খুন করার চেষ্টা করার সময় এক কোপে একটি মরা পেঁপে গাছ যেভাবে কেটে ফেলে, তাতেই দর্শকরা খানিকটা শিহরিত হয়ে ওঠে। অন্যান্য কোপানোর দৃশ্যগুলো সঙ্গত কারণেই আরও প্রাণবন্ত।
দ্বিতীয়ত, স্পেশাল ইফেক্টে জোনাকি বোতলজাত করা, তা অবমুক্ত করার দৃশ্যায়ন। এর কার্যকারণ অবশ্য বেশ দুর্বল; তবে স্পেশাল ইফেক্টের ব্যবহারটিকে বাংলাদেশের সিনেমার প্রেক্ষিতে ভালোই বলতে হয়। এই দৃশ্যের জন্য আমেরিকান-ইউরোপিয়ান-এশিয়ান-ল্যাটিন সিনেমা দেখে অভ্যস্ত দর্শকদের জন্য পরামর্শ-- একটু ঘোলা চোখে দেখুন। আর বিশ্বাস রাখুন, আমাদের দেশে শীঘ্রই অসাধারণ স্পেশাল ইফেক্ট দেখতে পাওয়া যাবে।
আমাদের দেশে শুধুই যে অসাধারণ স্পেশাল ইফেক্টের কাজ হবে, তাই নয়; বিশ্বাস রাখুন, আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প একদিন ঘুরে দাঁড়াবে, অসাধারণ সব সিনেমা তৈরি হবে, মানুষ লাইন ধরেও টিকিট কাটতে পারবে না। হাউজফুল শো হবে হরহামেশা। হয়তো একদিন আমাদের কয়েকজন পরিচালককে হলিউড কিনেও নিয়ে যাবে। ততদিন পর্যন্ত চলুন, আমরা থোড়া থোড়া উৎরে যাওয়া পোড়ামন এবং এর সমগোত্রীয় চলচ্চিত্রসমূহ মহাউৎসাহে দেখতে থাকি এবং অবশ্যই সিনেমা হল গিয়ে।