মৃত্যু অকালে হয়েছিল তার। ক্ষণজন্মা হলেও আকাশছোঁয়া সাফল্য ছিল তার হাতের মুঠোয়। তিনি সালমান শাহ। বেঁচে থাকলে এই ১৯ সেপ্টেম্বর তার বয়স হতো ৪৮। একসঙ্গে অনেকে মিলে কেক কাটতে পারতেন হৈ চৈ করে। আজও কেক কাটা হয়- কিন্তু সালমানকে ছাড়া। আজও তাকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানো হয়, অজানাকে উদ্দেশ্য করে। রিয়াজও একই কাজ করেন।
Published : 20 Sep 2019, 12:56 AM
সালমানের সাফল্য যাত্রার সময়েই চলচ্চিত্রে যুক্ত হয় যে নামগুলো তারমাঝে রিয়াজ অন্যতম। সেই যাত্রার শুরুটাতে কোনও না কোনও ভাবে সালমান ছিলেন জড়িয়ে। আছেন আজও। সালমানের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রিয়াজ তুলে ধরলেন সালমানকে কেন্দ্র করে জমে থাকা স্মৃতি, দিলেন কারও কারও উত্তর, করলেন নিজের বয়ানে সালমানের জন্য ভালোবাসার প্রকাশ।
প্রথম সাক্ষাতে আন্তরিকতার ছটা
সালমান শাহকে প্রথম আমি একটি শুটিংয়ে গিয়ে দেখি। সে মেকআপ নিয়ে বের হচ্ছিল। সাধারণত ছেলেদের দেখলে অন্য একটা ছেলে হয়তো এভাবে তাকাবে না, কিন্তু আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম । এমনভাবে মজা করছিল… খুবই লাইভলি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সালমান ভালোলাগার মানুষে পরিণত হয়। এই দেখার আগেই বড় পর্দাতে আমি তার ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিটি দেখেছিলাম। অসম্ভব ভালো লেগেছিল তখনই। সামনাসামনি মুগ্ধতা আরও বেড়ে যায়।
কক্সবাজারে প্রিয়জন ছবিটির শুটিং করছিলাম। একদিন হঠাৎ সালমান বলল, ভাই, আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি। বললাম, ঢাকা চলে যাচ্ছি মানে? বললেন, কালকে সকালে আবার শুটিং করতে ফিরে আসব। সারাক্ষণ ছোটাছুটি, মজার মধ্যে রাখত পুরো ইউনিটকে। বিল্ডিংয়ের একতলা থেকে লাফিয়ে নিজের স্টান্ট নিজের করত। সালমান যেখানে সেখানেই হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে যেতে। ওর কাছে একটি প্লাস্টিকের পিস্তল ছিল। ‘বিবিগান’ বলি আমরা। ছোট ছোট প্লাস্ট্রিকের বুলেটও ছিল। কার পেটে আর কার কপালে গুলি করতে এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকত।
সালমানের গাড়িতে বাড়ি ফেরা
গাজীপুরের হোতাপাড়ায় ইউনিটের বাসে গিয়েছি। সালমান গাড়ি নিয়ে গেছে। ওর শুটিং শেষ আমার শুটিংও শেষ। আমি সবার সঙ্গে বাসে করে আসব, হুট করে সালমান বলল, চলো যাই। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কারণ আমি একদম নতুন বলা যায়। আর সালমান তো তখন সুপারস্টার। সে ড্রাইভ করছিল, পাশে সামিরা। ইটস ওয়ান্ডারফুল জার্নি। সামিরাকে নিয়ে মজা করছিল, আমাকে নিয়েও। আমাকে টিপস দিচ্ছিল। কার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা উচিত, কীভাবে কাজ করা উচিত। আমার কাছে মনে হয় দ্যাট ওয়াজ অ্যা ওয়ান্ডারফুল জার্নি।
কিছুক্ষণ আরও নাহয় রহিতে কাছে
আমার এখনও মনে হয়, এখনও যদি সালমানের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করতে পারতাম। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে পারতাম, তাহলে আমার চাওয়ার পূর্ণ হত। কারণ আমি যখন সালমানের সঙ্গে কাজ করেছি তখন একদম নতুন ছিল। কিছুই জানি না, এখনও খুব বেশি জানি না। তারপরও কিছুটা ম্যাচিউরিটি এসেছে বলে মনে হয়। ভালো করার চেষ্টা করি। এখন যদি সালমানের মতো চমৎকার পারফর্মারের সঙ্গে অভিনয় করতে পারতাম। কিন্তু সেটা আর কখনও হবে না।
সালমানের মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে পরিচালকের একটাই কথা ছিল, যদি আমাকে ‘মন মানে না’ ছবিটি করতে হয় তাহলে সালমান যতটুকু করেছে ততটুকু রাখা যাবে না। আমার মতো করে নতুন করে শুট করতে হবে। সালমান যতটুকু করেছে, সেটা সালমানের মতো করে করা সম্ভব না। দর্শকরা যদি ওইটুকু অংশ দেখে তাহলে আমাকে আর কখনোই গ্রহণ করতে পারবে না। বেশ অনেকগুলো অংশ মতিন ভাই (মতিন রহমান) ফেলে দিয়েছিলেন। আমি যখন শাবনূরের সঙ্গে যখন শুটিং করতাম তখন বুঝতাম, মতিন ভাইয়ের মত মতো হচ্ছে না তারপরও নতুন হিসেবে মেনে নিচ্ছিলেন। সালমান যে এক্সপ্রেশন দিয়ে গেছে, সেটা তার মনের ভেতরে গেঁথে ছিল। পুরো ইউনিট আমার মধ্যে সালমানকে খোঁজার চেষ্টা করেছিল। সে এক ভীষণ অস্বস্তিকর অবস্থা এবং অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমি সবাইকে বলেছি, আমি সালমান নই। আমি ওর মতো হতেও পারব না। আমি আমার মতো করছি। আমাকে সেভাবেই বিচার করুন। পরের দিকে বিষয়টি ইউজড টু হয়ে গিয়েছিল। শুটিংয়ে আমি অসুস্থও হয়ে গিয়েছিলাম। মহাখালীর একটি হাসপাতালে ভর্তিও ছিলাম।
ট্রেন্ডসেটার সালমান আসলেই অদ্বিতীয়
আমাদের এখানে কিন্তু একটা সময় হিরোরা লাল-সাদা ট্রাউজার পড়ত, সাদা জুতা পড়ত; হয়ত এখনও অনেকেই পরে। সালমান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, তরুনরা আসলে কি চায়। ঠিক সে সময়ের স্টাইলটাকে সে তুলে এনেছিল পর্দায়। তখন কিন্তু ঐ ট্রেন্ডটা আমরা সবাই চাচ্ছিলামও। পরিবর্তন মনে মনে চেয়েছি, সালমান তা করে দেখিয়েছে। শুধু তাই নয়, সালমান আরেকটি ট্রেন্ড চালু করে দিয়েছিল। তখন পরিচালকদের ধারণা ছিল সিনিয়র শিল্পীরাই সিনেমা দর্শক টানতে পারেন। সেই জায়গায় পরিবর্তনের হাওয়া নিয়ে এসেছিল সালমান। আমার মনে হয়, দর্শকদের সে এডুকেট করেছে।
সালমানের মৃত্যুর পর অনেকে সুযোগ পেয়েছি কিংবা বেঁচে থাকলে আসতে পারতাম না- এটা ঠিক না। সালমান থাকা অবস্থাতেই আমি, ফেরদৌস পাশাপাশি ছবি করছিলাম। ওই সময় আমাদের হাতে ভালো ছবিও ছিল। তার অকালপ্রয়াণ ইন্ডাস্ট্রি অনেক কিছু হারিয়েছে, দর্শকরা অনেক কিছু হারিয়েছে। কিন্তু সালমান মারা যাওয়ার পর নতুন শিল্পীর জন্ম হয়েছে-আমি এটা পক্ষে না। নতুন শিল্পী তো এখনও হচ্ছে না। এটা নির্ভর করে পরিচালকদের উপর। আট-দশ বছর ধরে অনেক শিল্পীই তো আসছে কিন্তু কেউই সেভাবে ইম্প্যাক্ট তৈরি করতে পারছে না। দু-একজন হয়তো পারছে। কিন্তু দুই-একজনকে দিয়ে তো পুরো ইন্ডাস্ট্রি চলবে না। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চালানোর জন্য অনেকগুলো হিরো-হিরোইন প্রয়োজন।
যখন সময় থমকে দাঁড়ায়
শুটিংয়ে হঠাৎ করে খবর এলো, সালমান শাহ নেই! আমরা কেউই বিশ্বাস করিনি। বাইরে বের হওয়ার পর দেখলাম, থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এফডিসিতে কান্নার রোল উঠল। মনে হচ্ছে, খুবই আপনজনকে হারিয়ে ফেলেছি। মানুষজন এতোটাই আপসেট ছিল যে তারা কী করছে আর কী করছে না , ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মানুষজন পাগল হয়ে গিয়েছিল। চাক্ষুষ সাক্ষী আমি ছিলাম। এর মধ্যে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
নিজেও যখন সালমানের ভক্ত
অসংখ্য সালমানের ভক্তদের মধ্যে আমিও একজন। সালমান আমাদের অকালে কাঁদিয়ে চলে গেছেন। এরকম একটি প্রতিভা আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিল-এটি আমাদের জন্য অনেক গর্বের একটি বিষয়। এখন সিলেটে গেলে চেষ্টা করি ওর সমাধিস্থলে ওর জন্য কিছুসময় প্রার্থনা করি। কিন্তু যে ইচ্ছাটা পূরণ হওয়ার নয়, তা হলো, কর্মে, ক্লান্তিতে, শান্তি, আনন্দে সালমান শাহ’র সঙ্গ উপভোগের আকাঙ্ক্ষা।