গানেরই মানুষ তিনি, সুর, কথা আর কণ্ঠের জাদুতে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ভুলিয়ে রেখেছেন সংগীতানুরাগীদের। গানের জগতের জীবন্ত কিংবদন্তী বব ডিলানই কিনা পেলেন সাহিত্যের নোবেল! ভাবছেন, ভুল কারণে ভুল লোকের নোবেল পাওয়ার আরেকটা ঘটনা এটা?
Published : 14 Oct 2016, 05:28 PM
মোটেও তা নয়। কারণ, বব ডিলানের গান যে নিছক শ্রুতিমধুর সুরেলা পঙ্কতি নয়; গণমানুষের কথা বলা, যুদ্ধের পৃথিবীতে ভালবাসার কথা বলা, অন্যায়ের বিপরীতে সাম্যের কথা বলা এই গানগুলো যে কালের খাতায় স্থান পাবে বিপ্লবের মহাকাব্য রূপেই।
বব ডিলান ছিলেন একটি প্রজন্মের কণ্ঠ, তার যাদুকরী গলা আর অসাধারণ লেখনী সাক্ষী হয়ে আছে একটি সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব পরবর্তীতে বদলে দেয় পুরো দুনিয়া।
আর দশটা গড়পড়তা শিল্পীর মতো প্রচলিত মিষ্টিগলা বলতে যা বোঝায় তা ছিলোনা ডিলানের। কিন্তু তার গলায় ছিলো অন্যমাত্রার আবেদন; নিজের অসাধারণ লেখনীর শক্তিকে আশ্রয় করে সেই অনন্য আবেদনই তাকে করে তুলেছে ‘রক’ সংগীতের মায়েস্ত্রো।
সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি
অ্যালেন গিন্সবার্গ তাকে বলেছিলেন বিংশ শতাব্দীর সেরা কবি। আরেক কিংবদন্তী নোবেলজয়ী কবি স্যার অ্যান্ড্রিউ মোশন বলেছিলেন যে প্রায় প্রতিদিনই বব ডিলানের গান শোনেন তিনি। সর্বশেষ, বৃহস্পতিবার ‘নোবেল লিটারেচার কমিটি’র চেয়ারম্যান পার ওয়াস্টবার্গও সুর মেলান গিন্সবার্গের সাথে, কিন্তু তার মতে বব ডিলান ‘সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি’ ।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বব ডিলানের লেখা গানগুলোর কথার মতো করে বিশ্লেষণ করা হয়নি এযাবতকালের অন্য কোন ‘রক’ শিল্পীর গান কিংবা তার কথা।
পঞ্চাশের দশকের পরে, এলভিস প্রিসলি আর বাডি হলি রাজত্ব করছিলেন ‘পপ’ সঙ্গীতের রাজ্যে। যেখানে ডিলান এসেছিলেন এক মুক্ত আত্মার মতো, সে সময়কার রাজনীতিকে ধারণ করে নিয়েছিলেন তার গানের কথায় আর সুরে।
তার কথা, সুর উদ্বুদ্ধ করেছে একটি প্রজন্মকে। তার ভিন্নধর্মী গলা, নান্দনিক সুর আর প্রাণময় উপস্থিতি ছিলো নতুন সেই স্বাধীন প্রজন্মের আকর্ষনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু সেই আকর্ষণ, খ্যাতি কিংবা নতুন যুক্ত হওয়া নোবেল কি যথেষ্ঠ ডিলানকে বিচারের জন্য?
গত বছর একটি পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে পুরষ্কার গ্রহণ করতে গিয়ে ডিলান বলেছিলেন, “আমার এই গানগুলো অনেকটা রহস্য গল্পের মতো, সেই গল্পগুলোর মতো যেগুলো শেক্সপিয়ার দেখেছিলেন তার বেড়ে ওঠার সময়। আমার মনে হয় আপনারা চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন সেই সময়ে কি করতাম।”
আর্তুর র্যাবো আর জন কিটস এর কবিতা প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিলো তরুণ ডিলানকে, যার কাব্যিক প্রভাবের কিছুটা এসে পড়েছে তার নামের উপরও। যেই প্রভাবে কফি হাউসে গান করা রবার্ট জিমারম্যান কবি ডিলান থমাস এর নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিলেন বব ডিলান হিসেবে।
সাধারন কোন প্রতিবাদী শিল্পী নন ডিলান
সরল কর্ড আর রুপক শব্দচয়ন, এই দুয়ের সমন্বয়ে একটি যুগের ভাবধারাকে গানে ধারণ করেছেন ডিলান; ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ আর ‘দ্য টাইমস দে আর চেঞ্জিং’-এর মতো গান দিয়ে মুছে ফেলেছিলেন ‘ফোক’ আর প্রচলিত ‘পপ’ সঙ্গীতের মধ্যকার পার্থক্য।
ষাটের দশক পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘লাইক অ্যা রোলিং স্টোন’, ‘জাস্ট লাইক অ্যা ওমেন’ এবং ‘লেই লেডি লেই’ এর মতো গানগুলো দিয়ে নিজেকে আবারও ভিন্ন রুপে হাজির করেন ডিলান। ‘প্রতিবাদী গায়ক’ এর তকমা থেকে বেরিয়ে এসে দেখালেন তার সামর্থ্য আর বৈচিত্র। ধীরে ধীরে গানগুলো রূপান্তর হলো গণমানুষের গানে।
১৯৬৫ সালের নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভ্যালে হঠাত করেই যেন ‘রকস্টার’ হয়ে উঠলেন ডিলান, উৎসবে উপস্থিত শ্রোতাদের বানিয়ে দিলেন সঙ্গীত ইতিহাসের এক ক্ষণজন্মা মুহূর্তের সাক্ষী। প্রতীকী কালো চশমা আর তার পেছনে লুকিয়ে থাকা মাতাল চোখের সঙ্গে মিষ্টি সুরের ফোক গাওয়া ডিলান হয়ে গেলেন আনন্দবাদী রকস্টার।
গণমানুষের মুক্তির কথা বলা ডিলান পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলঅদেশের মুক্তিকামী জনতার পাশেও। ১৯৭১ সালে ম্যাডিসন স্কয়ারে জর্জ হ্যারিসনের ঐতিহাসিক ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ গেয়েছিলেন তিনিও। সারথি হয়েছিলেন বাঙালির মুক্তির স্বপ্নের।
তারপর হঠাত করেই এক মোটর সাইকেল দূর্ঘটনার শিকার হন ডিলান, বেশ কিছুদিন পর্দার আড়ালে থেকে সত্তর- এর দশকের মধ্যের দিকে আবারও ফিরে আসেন তিনি। নিজের বিয়ে বিচ্ছেদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭৫ সালে মুক্তি দেন তার আরেক যুগান্তকারী অ্যালবাম ‘ব্লাড অন দ্য ট্র্যাকস’।
ক্যারিয়ারে ফেরা
তিন বছর পর, অ্যারিজোনা’র এক হোটেল রুমে স্বপ্নে যীশুর দেখা পান ডিলান আর তার পর থেকেই তার গানের কথায় উঠে আসে বাইবেলের নানান বানী। নৈতিকতা আর বিশ্বাস নিয়ে গান লেখা শুরু করেন তিনি।
জনপ্রিয়তায় হয়তো তখনও ভাটা পড়েনি তার, কিন্তু ধীরে ধীরে শ্রোতাদের কাছ কে আসতে শুরু করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ১৯৮৮ সালে যা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে, নিজের একই গান ডিলান ভিন্নভিন্ন ভাবে গাওয়া শুরু করলে। ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে শুরু করেন ডিলান।
কিন্তু ১৯৯৭ সালের অ্যালবাম ‘টাইম আউট অব মাইন্ড’ আবারো স্রোতে ফিরিয়ে আনে তাঁকে। ঐতিহাসিক এই অ্যালবামটি ‘বেস্ট অ্যালবাম’ সহ জয় করে তিনটি ‘গ্র্যামি’।
২০০৬ সালে ‘মডার্ন টাইমস’ অ্যালবাম এর মাধ্যমে বিলবোর্ডে প্রবেশ করেন ডিলান, যা হয়ে ওঠে আরেকটি ইতিহাস, ৬৫ বছর বয়সী বব ডিলান হয়ে উঠেন বিলবোর্ডে অবস্থান করা একমাত্র জীবিত শিল্পী।
যেই অর্জনগুলো আর জনপ্রিয়তা তাকে পরিণত করে কিংবদন্তীতে। বয়ে যায় সম্মান আর স্বীকৃতির জোয়ার, একে একে ডিলান জয় করেন, কেনেডি সেন্টার হনার, অস্কার, পুলিতজার, গোল্ডেন গ্লোব, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এর মতো সব পুরষ্কার। এই তালিকায় এবার নতুন করে যুক্ত হলো নোবেল পুরষ্কার।
গানের মানুষ হলেও শুধু গানের মধ্যেই আটকে থাকেননি ডিলান, লিখেছেন ‘নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ানস এক্সপেরিমেন্টাল টারান্টুলা’ নামের একটি বই আর ‘ক্রনিকলস’ নামে নিজের আত্মজীবনী। কিন্তু তারপরেও তার গানের কবিতা দিয়েই বব ডিলান জয় করে নিয়েছেন সাহিত্যজগতে দুনিয়ার সর্বোচ্চ সম্মাননা।