গ্রুপ থিয়েটার চর্চার দিন ফুরিয়ে আসছে: মামুনুর রশীদ

“রেপার্টরি চর্চার মধ্য দিয়ে এক ধরনের যে পেশাদার থিয়েটার চর্চার স্বপ্ন দেখছে কেউ কেউ, আমি সেটাকে সাধুবাদ জানাই,” বলছেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমগ্লিটজ
Published : 27 Jan 2023, 06:32 AM
Updated : 27 Jan 2023, 06:32 AM

দেশের নাট্যআন্দোলনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে নাট্যদল আরণ্যক; তবে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার এই ধারা এভাবে আর কত দিন যাবে, তা নিয়ে সন্দিহান এ দলের কাণ্ডারি মামুনুর রশীদ।

তিনি বলছেন, “নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর যে দিন, সেটা তো আর নেই। আমাদেরকে এখন পেশাদার থিয়েটার চর্চার দিকে হাঁটতে হবে।”

৫০ বছর পূর্তি উদযাপনে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আট দিনের নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছে আরণ্যক। ‘থিয়েটারের নতুন বার্তা বিধ্বস্ত পৃথিবীর জন্য’ স্লোগানে শুক্রবার থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে এ উৎসব।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় আরণ্যকের পথচলা। ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটি দিয়ে প্রথম মঞ্চে আসে তারা; সেখানে অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত সুভাষ দত্ত, আলী যাকের ও ইনামুল হক।

নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছিলেন মামুনুর রশীদ, তার নেতৃত্বেই পাঁচ দশক এগিয়ে চলছে আরণ্যক। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন ঘিরে গ্লিটজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার কথায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার নানা দিক।

গ্লিটজ: আপনার হাতে গড়া নাট্যদল ‘আরণ্যক’ ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে, কেমন লাগছে?

মামুনুর রশীদ: এই যে আরণ্যকের ৫০ বছর উদযাপন দেখে যেতে পারছি, এটা আমার জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি। এই ৫০ বছর নিছক ৫০ বছর নয়; কর্মময় ৫০ বছর। এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের একটা ব্যাপার। সৃজনশীল কর্মযজ্ঞে আরণ্যক সক্রিয় আছে নাট্যকর্মে, এটা বিরাট আনন্দের এবং গৌরবেরও ব্যাপার।

‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণি সংগ্রামের সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার’ স্লোগান নিয়ে পথ চলছে আরণ্যক। এ মর্মবাণী কতটা ধারণ করতে পেরেছে বলে মনে করেন?

আমাদের নাটকগুলো এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড দেখলেই এটা বোঝা যাবে। আরণ্যক ৫০ বছরে এই মর্মবাণী থেকে বিচ্যুত হয়নি। নাটকের মধ্য দিয়ে আমরা শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলে চলেছি, শ্রমজীবী মানুষের কথা বলে চলেছি।

আমরা ১৯৮২ সাল থেকে প্রতি বছর মে দিবস উদযাপন করছি। স্বৈরাচারী শাষকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও আমরা মে দিবস উদযাপন করেছি। প্রতি বছর মে দিবসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান করি। সেখানে শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলি। আরণ্যকের মে দিবস উদযাপন এখন জাতীয়ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। 

পাঁচ দশকের নাট্যচর্চায় একটা বড় অর্জন তো ‘মুক্তনাটক’ আন্দোলন; উৎসবে মুক্তনাটক নিয়ে কোনো সেমিনার বা বিশেষ কিছু থাকছে কিনা।

এই উৎসবে মুক্তনাটক নিয়ে তেমন কিছু রাখা হয়নি। পরবর্তীতে মুক্তনাটক এবং পথনাটক নিয়ে আমরা আলাদাভাবে একটা উৎসব করব। এজন্য এই উৎসবে মুক্তনাটক নিয়ে তেমন কিছু হচ্ছে না।

মুক্তনাটকে সারাদেশের অসংখ্য নাট্যকর্মী যুক্ত হয়েছে, তাদের নিয়ে সেই উৎসবটি আরও বড় পরিসরে হবে। আমরা সেভাবেই পরিকল্পনা করছি। এবারের উৎসবটিতে আরণ্যক নিজেদের নয়টি নাটক মঞ্চস্থ করছে। একক কোনো নাট্যদলের নিজস্ব নয়টি প্রযোজনা নিয়ে উৎসব করা একটি বড় ব্যাপার। এরকম একটি বড় কর্মযজ্ঞের মাঝে মুক্তনাটক যুক্ত করলে বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। আমরা চাই না, সেটি গৌণ হোক। মুক্তনাটক এবং পথনাটককে মূল বিষয় ধরেই আমরা আলাদা উৎসবটি করব।

নাটকের মধ্য দিয়ে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলা, সমাজ পরিবর্তনের কথা বলা...। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারছে নাটক?

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে নাট্যকর্মীরা। নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষকে অধিকার সচেতনতার কথা বলেছে। কিন্তু নব্বই দশকের পরবর্তী সময়ে পুরো পৃথিবীতে পুঁজির যে আগ্রাসন, অর্থনীতির যে সংস্কার পুরো পৃথিবীতে ঘটেছে- তার প্রভাব নাট্যচর্চায়ও পড়েছে।

পুঁজির যে আগ্রাসী রূপ, সেটি বারবার সংস্কৃতিকে আঘাত করে চলেছে। সেখানে নাটকও আক্রান্ত হয়েছে। সেই অভিঘাতে সংস্কৃতি, বিশেষ করে নাটক খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

উৎসবের স্লোগান ‘থিয়েটারের নতুন বার্তা বিধ্বস্ত পৃথিবীর জন্য’; কী বার্তা দিতে চায় আরণ্যক? 

বিধ্বস্ত পৃথিবী তো বটেই। ইউক্রেইনে যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে নানামুখী সংকট। সারা পৃথিবীতে যেভাবে মানুষ হত্যা চলছে। তার প্রভাব সারা পৃথিবীকেই বিধ্বস্ত করে চলেছে।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, মানুষের মাঝে অনাচার, অসততা বাড়ছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে তো পৃথিবীটা বিধ্বস্ত, তবে এটা ক্রান্তিকাল নয়।

বিধ্বস্ত পৃথিবীতে আরো ক্রান্তিকাল আসবে। তবুও মানুষকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা এই উৎসবের মধ্য দিয়ে সেই ডাক দিয়ে যাই। আমরা বলতে চাই, এখন শুধু প্রতিবাদ নয়- এখন সকলে মিলে রুখে দাঁড়াতে হবে।

সম্প্রতি ‘নীলদর্পণ’ আপনার নির্দেশনায় মঞ্চে এসেছে। নতুন কী নাটক লিখছেন বা ভাবছেন?

এখন কোনো নাটক লিখছি না। তবে নাটক লেখার পরিকল্পনা করছি। আর নীলদর্পণ সারা বছর মঞ্চায়িত হবে। এছাড়া আরণ্যকে তো আমার লেখা ও নির্দেশনার একাধিক নাটক নিয়মিত মঞ্চায়িত হচ্ছে। আরণ্যকের জন্য এখন নতুন কোনো নাটক লেখার কথা আপাতত ভাবছি না, তবে নির্দেশনা দেওয়ার ব্যাপারে ভাবছি।

বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের নাট্যচর্চা নিয়ে মূল্যয়ন শুনতে চাই।

আমি মনে করি, রেপার্টরি চর্চা আরও বাড়ানো উচিত, গ্রুপ থিয়েটার চর্চার দিন ফুরিয়ে আসছে। ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ যে দিন, সেটা তো আর নেই। আমাদেরকে এখন পেশাদার থিয়েটার চর্চার দিকে হাঁটতে হবে। এক সময় নিজের খেয়ে যে আবেগ উত্তেজনা নিয়ে আমরা গ্রুপ থিয়েটার চর্চা করেছি। এখনকার অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সেটা করা কঠিন। রেপার্টরি চর্চার মধ্য দিয়ে এক ধরনের যে পেশাদার থিয়েটার চর্চার স্বপ্ন দেখছে কেউ কেউ, আমি সেটাকে সাধুবাদ জানাই।

নাটকে টিকেটের দাম নিয়ে আলোচনা চলে, আপনার মতামত কী? 

আমরা তো সরকারের ভর্তুকি নিয়েই মিলনায়তন ভাড়া কম পাচ্ছি। সরকার ভর্তুকিটা দিচ্ছে যেন সব শ্রেণির মানুষ নাটক দেখার সুযোগ পায়। সেখানে ১ হাজার টাকার টিকেট নাটকে থাকা উচিত না। এতে করে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত দর্শকের নাটক দেখার আকাঙ্ক্ষা কমে যাবে।

Also Read: ৫০ বছর উদযাপনে আরণ্যকের ৮ দিনের নাট্যোৎসব

Also Read: আরণ্যকের ৫০ বছর: উৎসবের আট দিনে ৯ নাটক

আরণ্যকের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?

পাঁচ দশক তো পথ চলেছে আরণ্যক। সামনের দিনগুলোও সৃজনশীল কর্মযজ্ঞে সরব থাকবে আরণ্যক, এটাই প্রত্যাশা। আমরা নানামুখী চিন্তার মধ্য দিয়ে আমাদের পরিকল্পনা সাজাবো এবং সেই পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাব। ভবিষ্যতের কাজ নিয়ে আমরা ভাবছি, চিন্তা করছি।