বাংলাদেশি নির্মাতাদের ভাবনায় জঁ-লুক গদার

“গদারের চলচ্চিত্রের ভাষার সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করলেও তাকে গদার পাঠ করতে হবে। একমত না হলেও গদার তাকে সমৃদ্ধ করবেন।”

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2022, 06:36 AM
Updated : 14 Sept 2022, 06:36 AM

ফরাসি নবকল্লোল চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা জঁ-লুক গদারকে নানা আঙ্গিক থেকে স্মরণ করছে সিনেমা বিশ্ব, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

ফরাসি-সুইস এই নির্মাতা সিনেমাকে দিয়েছেন নতুন ভাষা। চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবেও তিনি সমান খ্যাতিমান।

৯১ বছর বয়সে মঙ্গলবার মৃত্যু হয় ফরাসি চলচ্চিত্রের এ গডফাদারের। বাংলাদেশের এই সময়ের কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে তাদের ‘গদার-ভাবনা’ জানতে চেয়েছিল গ্লিটজ।

Also Read: জঁ-লুক গদার: সিনেমাকে বদলে দেওয়ার নায়ক

Also Read: কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জঁ-লুক গদারের মৃত্যু

Also Read: গদারের কীর্তিগাথা

আবু সাইয়ীদ

কিত্তনখোলা, নিরন্তরের নির্মাতা

গদার একজন শিক্ষিত মাস্টার ফিল্ম ডিরেক্টর। এটা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নাই। চলচ্চিত্রে অ্যাসথেটিক্স, কন্টেন্ট ও বিভিন্ন আঙ্গিকের বিকাশে গদারের ভূমিকা অনেক বড়।

অনেক পরিচালকই আছেন, যারা তরুণ বয়সে বা এখনো গদারের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত; বা যাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত, গদার তাদের মধ্যে অন্যতম। গদারের চলচ্চিত্র প্রত্যেক নির্মাতার জন্যই প্রেরণার কারণ। 

তবে মানুষ তো মারা যাবেই। তিনি অনেক বয়সে মারা গেলেন। অনেক ছবি বানিয়েছেন। সবগুলো ছবিই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের এবং সাধারণ দর্শকদের বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এটা নিয়ে কারো ওই অর্থে দ্বিমত নেই। 

গদার এমন একজন ব্যক্তি, যাকে নিয়ে মনে হয় না কারো কন্ট্রোভার্সি আছে।  

শুধু আমাদের দেশের না, পৃথিবীরে যে কোনো দেশ থেকে কেউ যদি চলচ্চিত্রকে চর্চার মধ্যে নিয়ে আসে, সেটা নির্মাণচর্চাই হোক বা ক্রিটিকচর্চাই হোক, তার জন্যই গদার জরুরি। এমনকি যদি কেউ গদারের চলচ্চিত্রকে পছন্দ না করেন, তার জন্যও। 

গদারের চলচ্চিত্রের ভাষার সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করলেও তাকে গদার পাঠ করতে হবে। একমত না হলেও গদার তাকে সমৃদ্ধ করবেন।

অমিতাভ রেজা চৌধুরী

আয়নাবাজী, রিকশা গার্লের পরিচালক

প্রথম কথা হচ্ছে, এত বড় মানুষকে নিয়ে অনুভূতি বলা মুশকিল। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমরা যারা সিনেমাপ্রেমী বা সিনেমা দেখি কিংবা সিনেমাকে সিরিয়াস আর্টফর্ম হিসেবে চিন্তা করি- তাদের সবার জন্যই, সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্যই তিনি পিতার মত। তিনি একজন মাস্টার ফিল্মমেকার।

আমার জীবনে প্রথম জঁ-লুক গদারকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। আমি তখন পুনেতে থাকতাম, ইকোনমিক্সে পড়তাম। পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে গিয়ে থিয়েটারে ছবি দেখতাম।

একদিন গিয়ে জঁ-লুক গদারের ‘ব্রেথলেস’ ছবিটা দেখি। সত্যি কথা বলতে, সে সময় ছবিটার কিছুই বুঝতে পারিনি। কারণ আমার সিনেমা দেখার যে অভিজ্ঞতা, সে জায়গা থেকে ব্রেথলেস আমাকে পুরাই অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেয়।

 তারপর যখন ছবিটা নিয়ে পড়া শুরু করলাম। তখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম ব্রেথলেস আসলে কী?

 গদারকে নিয়ে একটা কথাই বলতে পারি, ৯২ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন; কিন্তু সারাজীবন তিনি আনকম্প্রমাইজড ছিলেন। কোনো ধরনের আপস ছাড়া, তিনি যা বিশ্বাস করেন, সেটাই সারাজীবন বলে গেছেন। তার মূল স্ট্রাগলটা ছিল ‘ক্রিটিক অব সিনেমা’।

তিনি মনে করতেন, সিনেমা নির্মাণের মাধ্যমেই সিনেমাকে ক্রিটিক করতে হবে। সমাজকে ক্রিটিক করতে হবে। ‘আই মেক ফিল্ম লাইক আ ক্রিটিক্যাল অ্যাসেট’। মানে প্রবন্ধ যেভাবে লেখে সেরকম করে সিনেমা দেখা। সিনেমার স্টোরি ‘ইজ নট ইম্পরট্যান্ট’।

হলিউড ন্যারেটিভ স্ট্র্যাকচার বা হলিউড জনরাঁর ফিল্ম থেকে তিনি বের হয়ে ছবি বানিয়েছেন। এখান থেকে তিনি একচুলও নড়েননি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তার জন্য। একজন চলচ্চিত্রকার, তার যে দর্শন, সিনেমার বিশ্বাস সেটা আজীবন রেখে গেছেন তার সিনেমায়।

 সবশেষে বলি, সারা জীবন পড়াশোনা করেও গদারকে বুঝতে পারার ক্ষমতা মনে হয় না আমার আছে।

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল

ঊনপঞ্চাশ বাতাসের নির্মাতা

 গদার অনাবিষ্কৃত কেউ নন। বহুল চর্চিত একজন চলচ্চিত্রকার। তিনি ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের জনক। আমি মনে করি গদার এতই চর্চিত; তাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই।

 চলচ্চিত্রে যারা আছেন, সবাই দুই লাইন গদার নিয়ে পড়াশোনা করেন। তাকে নিয়ে যাই বলি, তা হবে পুরান কাসুন্দি ঘাঁটা। তার দার্শনিকতা, চলচ্চিত্রের গভীরতা এবং কনভেনশনাল ফরমেটকে চ্যালেঞ্জ করার যে সাহস, এগুলোকে ফিল্মমেকারদের ইন্সপায়ার করে।  

আশফাক নিপুন

মহানগরের নির্মাতা

এরকম একজন প্রতিবাদী পরিচালকের মৃত্যু কাম্য নয়; যদিও তার অনেক বয়স হয়েছিল। তার কনটেম্পোরারি যারা ছিলেন... সবার চেয়ে উনি বরং বেশি বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি শেষ বয়স পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন ছবি বানাতে। তার ছবির সংখ্যাও প্রচুর।

এমন না যে তিনি অনেক সময় নিয়ে ছবি বানাতেন। তার একটা তাড়না ছিল সবসময় গল্প বলার। তিনি ছিলেন একেবারে আপাদমস্তক ফিল্মমেকার। ফিল্মের বাইরে তিনি কোনো কিছুই করেন নাই।

তিনি ভীষণরকম পলিটিক্যাল ফিল্ম মেকার ছিলেন। তার ছবিতে সেই সময়কার ইউরোপের যে সোশাল-পলিটিক্যাল কিংবা শুধু পলিটিক্যাল অবস্থা, সেটার ব্যাপারে তার জোরদার বক্তব্য ছিল। তার ছবিতে প্রতিবাদের জায়গা ছিল। নর-নারীর সম্পর্ক থেকে শুরু করে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে আনায় তিনি আলোর দিশারীর মত ছিলেন। এর আগে ফ্রান্সে সবসময় হলিউড ছবি চলত; কিংবা ফ্রান্সের কিছু কমার্শিয়াল ছবি চলত।

কিন্তু গদার, তার সাথে ফ্রঁসোয়া ত্রুফো, জঁ ককতো... এরা সিদ্ধান্ত নিল যে, এই ধরনের ছবি আসলে উনাদের গল্প বলে না। ফ্রান্সের মানুষের গল্প বলে না, তখন উনারা যে বিপ্লবটা নিয়ে আসছেন, এটা অসম্ভব রকম একটা সাহসী ব্যাপার। তারা যখন বিপ্লব নিয়ে আসছেন, তখন তারা তো জানতেন না একদিন এত বড় কিছু হবে।

গদারের বক্তব্য, চিত্রভাষা, তার সিনেমা, সবকিছুর মধ্যেই ঠোঁটকাটা ব্যাপারটা ছিল। যেটা খারিজ করার, তা যত বড়ই হোক, খারিজ করে দিতেন।

তার মৃত্যু বিশ্ব সিনেমার জন্য বড় ক্ষতি। আবার একদিক থেকে দেখলে, প্রত্যেক নির্মাতার যে স্বপ্নটা থাকে, অনেকদিন পর্যন্ত ছবি বানিয়ে যাওয়া, তিনি তা পেরেছেন।

তার শেষ ছবিটাও কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম ডি’অর নমিনেশন পেয়েছিল। এটা বিশাল ব্যাপার। তিনি চলে গেছেন ঠিকই; তবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে যাবেন।