“দেশের কোনোও পুরস্কারের জন্য অধ্যাপক নুরুল ইসলামের ক্ষোভ ছিল না। তবে তিনি চাইতেন দেশ যেন তাকে স্বীকৃতি দেয়।”
Published : 05 Jun 2023, 01:15 AM
সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক নুরুল ইসলামের স্মরণ সভায় বক্তারা এই অর্থনীতিবিদকে জাতীয়ভাবে কোনো সম্মান না দেওয়ায় খেদ প্রকাশ করেছেন।
তাকে বাংলাদেশের আধুনিক অর্থনীতি শিক্ষা ও গবেষণার ‘আদি গুরু’ অভিহিত করে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, জীবদ্দশায় স্বাধীনতা বা একুশে পদকের কোনোটাই না দেওয়ায় তার প্রাপ্য সম্মানটুকে থেকে তাকে ‘বঞ্চিত’ করা হয়েছে।
দেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করা নুরুল ইসলামকে ‘সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্থনৈতিক যৌক্তিক ভিত্তির মূল প্রণেতা’ হিসেবে বর্ণনা করেন ওয়াহিদউদ্দিন।
রোববার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস আয়োজিত ‘প্রফেসর নুরুল ইসলাম: নানা প্রজন্মের দৃষ্টিতে দেখা’ শীর্ষক স্মরণসভায় নানাভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন প্যানেল বক্তারা। এর মধ্যে তাকে জীবদ্দশায় কোনো ‘জাতীয়’ পদক না দেওয়ার বিষয়টি বার বার এসেছে।
স্বাধীনতাত্তোর দেশ গঠনে সরাসরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। তিনি গত ৮ মে যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান।
অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের জীবনাবসান
স্মরণসভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান বক্তব্য দেন।
এছাড়াও আইনজীবী কামাল হোসেন, ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির ও অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মেয়ে রুমিন ইসলাম আলোচনায় অংশ নেন।
ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ১৯৬০ এর দশক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে নুরুল ইসলামের অবদান আছে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা মূলত তার গবেষণার ফসল এবং স্বাধীনতা পরবর্তীতে সরাসরি সরকারের অংশ হয়ে দেশ গড়াসহ নানাভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
অধ্যাপক মাহমুদ যুক্তরাষ্ট্র ও দেশে বিভিন্ন সময়ে তার সঙ্গে আলোচনার বিভিন্ন সময়ের কথা তুলে ধরে স্মৃতিচারণ করেন।
তিনি বলেন, “অনেক সময় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলতেন, ‘স্বাধীনতায় তো আমারও কিছুটা অবদান আছে। কিন্তু আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়নি’।
“তবে দেশের কোনোও পুরস্কারের জন্য অধ্যাপক নুরুল ইসলামের ক্ষোভ ছিল না। তবে তিনি চাইতেন দেশ যেন তাকে স্বীকৃতি দেয়।”
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “তিনি একজন অর্থনীতির অধ্যাপক, আবার দেশের জন্য কাজ করেছেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি একজন সর্বাঙ্গীণ বা পূর্ণাঙ্গ অর্থনীতিবিদ।”
দুই কারণে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ অর্থনীতিবিদ মনে করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৫০ দশকের শুরু থেকে যখন উন্নয়ন অর্থনীতি শুরু হলো, এরপর থেকে উন্নয়নের যত ধরনের ধারণা, তত্ত্ব ও বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা এবং এসব অভিজ্ঞতার বিবর্তন হয়েছে, আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে এই সবগুলো বিষয়ে তার প্রকাশিত গবেষণাপত্র আছে।
“উন্নয়ন অর্থনীতির সকল দিক- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বিশ্ব অর্থনৈতিক ক্রাইসিস, এমনকি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সকল কিছুতেই তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। এসব বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেনও।”
ওয়াহিদ উদ্দিন বলেন, “অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ না পেয়েও তার মতো উপর থেকে পাখির দৃষ্টিতে পুরো উন্নয়ন অর্থনীতিকে দেখা আমি আর কাউকেই দেখিনি।
“কোনো আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তিনি যখন অন্যদের সঙ্গে ডিবেট করতেন বা কোনো প্রেজেন্টেশন দিতেন, সেখানে তিনি বহু নোবেল লরিয়েট অর্থনীতিবিদদেরকে ছাড়িয়ে যেতেন।”
অনুষ্ঠানে ফরাসউদ্দিন বলেন, “তিনি একজন পিওর অর্থনীতিবিদ ছিলেন। এদেশের মানুষের জন্য প্রথম কল্যাণ অর্থনীতির তত্ত্ব দেন।
“১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের বৈষম্যের অর্থনীতির গবেষণা তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু এটা গ্রহণ করে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এই বৈষম্য প্রচারের উদ্যোগ নিলে দেশদ্রোহী বানানোর শঙ্কার কথাও বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন।”
এরপর বঙ্গবন্ধু ও নুরুল ইসলাম মিলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কল্যান অর্থনীতির ছক তৈরি করেন; তবে রাজনৈতিকভাবে ছয় দফা একেবারেই বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি বলে জানান তার এক সময়ের সচিব ফরাসউদ্দিন।
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কামাল হোসেন বলেন, “১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোর অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম।
“পাকিস্তানের বৈষম্যের বিপরীতে এই দেশে বৈষম্যহীন অর্থনীতি কীভাবে করা যায়, তার জন্য প্রফেসর নুরুল ইসলামের অবদান অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার এই অবদান বাংলাদেশে স্মরণ করা হয়নি।”
অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তারা দেশের এই কৃতি সন্তানকে স্বাধীনতা, অর্থনীতি এবং কল্যাণ অর্থনীতিতে অবদান রাখায় মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়ার দাবি জানান।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান বলেন, “তিনি পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে যে শক্তি নিয়ে দেশের উন্নয়ন অর্থনীতি পরিচালনা শুরু করেছিলেন, বর্তমানে সেই অবস্থা নেই।
“তার পরিকল্পনায় ওই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি মধ্যবিত্ত শহুরে অর্থনীতি গড়ে তোলে একটি কল্যাণমূখী অর্থনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।”
১৯৭৪ সালে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া প্রশ্নের উদ্রেক করে মন্তব্য করে করে সাবেক আমলা মান্নান বলেন, “উনি কি ৭৫ এর বিষয়ে কিছু অনুমান বা কোনও খবর কি তার কাছে ছিল? আমি বলছি না যে তিনি জানতেন, তবে আমার মনে প্রশ্ন জাগে।”