শীতে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছু রক্ষণাবেক্ষণ কাজ শুরু হওয়ায় সরবরাহ কমেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা জ্বালানি সচিবের।
Published : 15 Jan 2024, 11:07 PM
শীত শুরুর পর থেকে দিনের বেলায় সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ যেত কমে। মিট মিট করে জ্বলা চুলায় রান্না হত না। সপ্তাহ খানেক ধরে পরিস্থিতি আরও খারাপের বর্ণনা দিচ্ছিলেন রাজধানী ঢাকার শান্তি নগরের বাসিন্দা আফরোজা রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন এক সপ্তাহ ধরে সকাল ৭টায় গ্যাস সম্পূর্ণ চলে যাচ্ছে, আসছে ঠিক রাতের ১১টার দিকে। ফলে দিনের বেলায় রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। রাত জেগে যা রান্না করি সেগুলো দিনের বেলায় ওভেনে গরম করে খেতে হয়। গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।”
সেখান থেকে কিছুটা দূরের উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা শাকিলা আফরোজ বলছিলেন, তিন দিন ধরে চুলায় গ্যাস আসছে না। বিকল্প উপায়ে রান্নার কাজ সারছেন তারা।
আর যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীর গৃহিণী সালেহা খাতুন গ্যাসের সংকট নিয়ে তার দুর্দশার বর্ণনা দিচ্ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে।
তিনি বলেন, ‘‘দিনে তো কোনো সোম গ্যাস থায়েই না। রাইত ১২টা/১টার দিকে আগে আইতো, গত এক সপ্তাহ ধরে আহে চাইট্টার দিকে। আইলেও টিমটিমাইয়া জ্বলে-রান্ধন যায় না।
“খাওন তো আর বন্ধ রাহা যাইবো না। দুই পোলা খাওন লইয়া কামে যায় সকালে। হেগো লাইগা তো রান্ধন লাগবো। তাই সিলিন্ডার কিইন্যা আনছি কাইল (রোববার)। চুলা জ্বলে না- মাস গ্যালে তো বাড়িওয়ালা ঠিকই বিল নিব।”
গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় শীতকালে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার যে সমস্যা দেখা দিত, এবার তা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযোগ আসছে, গত এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার আবাসিক এলাকায় দিনের অধিকাংশ সময় গ্যাস থাকছে না। গ্যাস না থাকার কারণে ঢাকার আশপাশের শিল্পাঞ্চলের জেনারেটর, বয়লার অচল রয়েছে, ফলে উৎপাদনও বন্ধ রাখার কথা জানাচ্ছেন শিল্প মালিকরা।
সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার কারণে গ্যাসের জন্য অপেক্ষামান গাড়ির প্রতীক্ষার সময়ও দীর্ঘতর হচ্ছে।
গ্যাসের সরবরাহ সংকটও মূলত এর কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন কর্মকর্তারা।
জ্বালানি সচিব নুরুল আলম জানান, শীত মওসুমে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় অনেক স্থানে গ্যাস লাইনে ফেনা জমে যায়। এতে লাইনে গ্যাসের চাপ বাধাগ্রস্ত হয়। এ সমস্যার পাশাপাশি জাতীয় সঞ্চালন লাইনের গ্যাসের সরবরাহের পরিমাণও কমে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর, বসুন্ধরা, শান্তিনগর, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মহাখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দারা গ্যাস সংকটের কারণে গত দুই দিন ধরে গ্যাসের চুলায় রান্না করতে পারছেন না। কাঠের চুলা, কেরোসিন স্টোভ ও অন্যান্য অস্থায়ী পদ্ধতি অবলম্বন করছেন কেউ কেউ।
ঢাকার সাত রাস্তার সিটি ফিলিং স্টেশন ও মহাখালীর ঈসা গার্ডেন ফিলিং স্টেশনে কথা বলে জানা যায়, সিএনজি গ্যাস রূপান্তর করার জন্য ২০০ বার চাপের গ্যাসের প্রয়োজন হলেও গত তিন দিন ধরে এসব ফিলিং স্টেশনে ১৩০ থেকে ১৪০ বার চাপের গ্যাস আসছে। ফলে নানা উপায়ে গ্যাসের চাপ বাড়াতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের জন্য অপেক্ষমান যানবাহনের লাইনও দীর্ঘ হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের বি.কে. নিটিং মিলসের প্রোপাইটর মোহাম্মদ কাশেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্বাচনের পর থেকে লাইনে কোনো গ্যাস আসছে না। দিনে রাতে কখনওই গ্যাস পাওয়া যায় না। গ্যাসের চাপ একেবারেই শূন্যের কোটায়।
“আমরা এক সপ্তাহ ধরে কাজ বন্ধ করে বসে আছি। আগে শুক্রবার কিছুটা গ্যাসের চাপ থাকত। গত শুক্রবারেও গ্যাস আসেনি।”
এ পরিস্থিতিতে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে কি না প্রশ্ন করা হলে এই উদ্যোক্তা বলেন, “কথা বলেছি। তারা কোনো আশ্বাস দিতে পারছেন না। কবে যে এই সমস্যার সমাধান হবে তারা কিছুই জানাতে পারছেন না।”
নারায়ণগঞ্জের মতই গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ আরও অন্যান্য শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের স্বল্পতার কারণে একই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ার কথা জানিয়েছেন পোশাক কারখানা মালিকরা।
কমেছে সরবরাহ
দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট করে গত কয়েক মাস ধরে সরবরাহ করা যাচ্ছিল বলেই পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে দেখানো হচ্ছে। তবে চলতি জানুয়ারিতে গ্যাসের সরবরাহ দৈনিক প্রায় ৫০০ মিলিয়ন কমে ২৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমেছে।
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন বলছে, একদিকে আমদানি করা এলএনজির সরবরাহ কমেছে। অন্যদিকে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদনের পরিমাণও কিছুটা কমেছে।
জ্বালানি সচিব নুরুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শীত মওমুমে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছু রক্ষণাবেক্ষণ কাজ শুরু হওয়ায় দৈনিক সরবরাহ কিছুটা কমে গেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
আমদানি করা এলএনজি দিয়ে এতদিন দৈনিক ৭০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলেও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের কারণে তা দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। পাশাপাশি পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন বলছে, দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলনও দৈনিক ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট কমে গেছে।
জ্বালানি সচিব বলেন, দুটি এফএসআরইউর মধ্যে একটিকে ড্রাই ডকে পাঠানো হয়েছে। সাধারণ পাঁচ বছর পর পর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বা এফএসআরইউকে রক্ষণাবেক্ষণে পাঠানো হয়। সেই হিসাবে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ চলছে। এই রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে একটি টার্মিনাল বন্ধ রাখতে হয়েছে। আবার একটি রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে কাজে যোগ দিলে আরেকটি পাঠানো হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক্সিলারেট এনার্জির এফএসআরইউ ইতোমধ্যেই সাগরে তার অবস্থানে চলে এসেছে। নতুন করে একটি এলএনজির কার্গো আগামী তিন দিনের মধ্যে বাংলাদেশ প্রান্তে পৌঁছানোর পর সেটা এটির টার্মিনালে যুক্ত করা হবে। এরপরই সামিটের টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণে পাঠানো হবে।
একটি এফএসআরইউ ড্রাইডকে নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণে অন্তত ৪৫ দিন সময় লেগে যায়।
জ্বালানি সচিব বলেন, যেটি রক্ষণাবেক্ষণ শেষে ফেরত এসেছে এর সক্ষমতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ এমএমসিএফডি করা হয়েছে। ফলে সামনে আরেকটি এফএসআরইউ রক্ষণাবেক্ষণে গেলেও সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হবে।