বিশাল এ সামাজিক সুরক্ষা উদ্যোগের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Published : 17 Aug 2023, 01:01 AM
চালুর অপেক্ষায় থাকা সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ‘শুভ উদ্যোগ’ যাতে পরিকল্পনা পর্যায়ের দুর্বলতা কাটিয়ে ধাপে ধাপে ভালো অবস্থানে যায়, মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে- এমন প্রত্যাশা দুই অর্থনীতিবিদের।
বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ পেনশন স্কিমের উদ্বোধন করবেন।
গত রোববার অর্থ বিভাগ বিশাল এ সামাজিক সুরক্ষা উদ্যোগ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটির বিধিমালা প্রকাশ করে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম-২০২৩ এর বিধিমালা প্রকাশের মাধ্যমে দীর্ঘদিন থেকে ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকা সবার জন্য পেনশনের বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের পথে আরেক ধাপ এগুলো।
নীতিমালায় দেশি বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, কর্মজীবীদের জন্য ‘সুরক্ষা’, সীমিত আয়ের নাগরিকদের জন্য ‘সমতা’ এবং প্রবাসী নাগরিকদের জন্য ‘প্রবাস’ নামে চারটি পেনশন স্কিম চালুর কথা বলা হয়।
বুধবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনুসর সর্বজনীন পেনশন স্কিমকে একটি মহৎ উদ্যোগ হিসেবে আখ্যা দেন। পর্যায়ক্রমে একটু একটু করে এগিয়ে এটি ভালো অবস্থানে যাবে বলেও আশা তার।
তবে বিশাল এ কার্যক্রম চালু করতে তাড়াহুড়ো করা হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। প্রথম কয়েকবছর তা ‘নাম সর্বস্ব’ হতে পারে মন্তব্য করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখনও কোনো প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো দেখা যাচ্ছে না। কারা কার্য পরিচালনা করবে, বোর্ডে কারা আছে, কারা পরিচালনা করবে এসব আমরা এখনও জানি না।
“তাড়াহুড়া করে নির্বাচনের আগেই একটা ঘোষণা হয়তো দেওয়া হচ্ছে। এখানে অনেক লুপ হোলস আছে। এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক করতে হবে। হয়তো তা করতে ৫ থেকে ১০ বছর লেগে যেতে পারে।”
একই সঙ্গে এ পেনশন স্কিমে অংশ নিতে মানুষের আস্থা তৈরি করতে প্রতিষ্ঠানিক অবকাঠামো তৈরিতে গুরুত্ব দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “বিনিয়োগের সুরক্ষার বিষয়েও সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। সেটা এখনও দেখা যাচ্ছে না। এই পেনশন স্কিমের বিনিয়োগ নীতি কী হবে, কোথায় বিনিয়োগ হবে- এসবের কিছুই এখনও জানা হয়নি। এটা কতখানি স্বায়ত্বশাসিত থাকবে সেটা পরিষ্কার করতে হবে।”
চারটি পৃথক স্কিম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটা কেন হবে? আমার মাসিক আয় যদি এখন ১০ লাখ টাকা হয় তাহলে আমি কেন মাত্র ১০ হাজার টাকার স্কিম পাব। আমি তো আরও বেশিও জমা করতে পারি। এটাকে আয়ের সাথে সম্পর্কিত করতে হবে। এ ধরনের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে ফিক্সড বা সুনির্দিষ্ট করে ফেলা হয়, এমনটি আমি কোথাও দেখিনি।”
পেনশন পাওয়ার জন্য ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত কিস্তি জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এখানে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে পেনশনের কিস্তি দেওয়ার সুযোগ রাখা উচিত। পেনশনকে জনপ্রিয় করতে হলে এ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
মানুষের কর্মক্ষমতা ও গড় আয়ুর বিবেচনায় বয়সসীমা ৬০ বছর থেকে বাড়ানোর পরামর্শ তার।
অন্য দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ৬০ বছরে বর্তমান বিশ্বে কোথাও পেনশন দেওয়া হয় না। বয়সসীমা ৬৫ বছর না করলে হবে না। সম্প্রতি ফ্রান্সে পেনশনের বয়সসীমা ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হচ্ছে। সেজন্য সেখানে ব্যাপক গণ্ডগোল লেগে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক আগ থেকেই ৬৭ বছর নির্ধারিত আছে। ওরা চিন্তা করছে এটা ৭০ বছরের দিকে নিয়ে যেতে।
আবার বিভিন্ন চাঁদার হার ও চাঁদার সময়কালের ওপর মাসিক পেনশনের যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে সেই উদাহরণও অন্য কোথাও নেই বলে দাবি করেন আহসান মনুসর।
তার ভাষ্য, “এভাবে ফিক্সড রিটার্ন কোথাও দেওয়া হয় না। আমার টাকা নিয়ে কর্তৃপক্ষ লগ্নি করবে। সেখান থেকে যে মুনাফা আসবে তার ভিত্তিতে আমি পেনশন পাব। মডেলটা হয় এই ধরনের। এত টাকা নিয়ে এত টাকা দিয়ে দেব- এমন ঘোষণা দিলেই হবে না। এত রিটার্ন কীভাবে দেওয়া হবে? টাকা কোত্থেকে আসবে। এটা বাস্তব সম্মত কি না?”
পেনশন স্কিম প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এটা একটা শুভ উদ্যোগ। কিন্তু এখানে চারটা স্কিমে যাদেরকে দেওয়া হবে তাদের ক্ষেত্রে ক্রাইটেরিয়া সিলেকশনের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
এসব স্কিম সবার জন্য সহজভাবে সুস্পষ্ট ও বোধগম্য করার পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কারা ‘সমতায়’ যাবে, কারা ‘সুরক্ষায়’ থাকবে সেই বিষয় সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এখন যেসব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আছে সেখানে উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নানারকম সমস্যা হচ্ছে। এখানে সময়ে সময়ে মানুষের চাহিদা পরিবর্তন হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের চাহিদা কীভাবে পূরণ করা হবে তার নির্দেশনা থাকা চাই।
স্কিমে যে ধরনের রিটার্ন সুবিধা রাখা হয়েছে সেটা যেন চলমান অন্যান্য প্রকল্পগুলোর চেয়ে লাভজনক রাখা প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি।
“কারণ কেউ এই দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে বিনিয়োগ করার পর যদি দেখতে পায় যে, সঞ্চয়পত্রে আরও বেশি মুনাফা আসছে তাহলে পরিস্থিতি কী হবে? মানুষ যেন হতাশ না হয়,” বলেন তিনি।
৪ ধরনের পেনশন স্কিম, যেভাবে যুক্ত হওয়া যাবে
৬০ বছরের সময়সীমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন শিক্ষক ৬০ বছরে অবসরে গেলেও অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা অবসরে যান আরও পরে। এছাড়া অনেক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা ৬০ বছরেও কর্মক্ষম থাকেন। এর মানে হচ্ছে সব স্কিমে একই ধরনের পেনশন বয়স নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। পেশাভেদে এখানে বিভিন্ন রকম বয়সসীমা থাকতে হবে।
তার মতে, বেসরকারি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা কেউ চাকরি পরিবর্তন করতে গেলে কীভাবে পেনশন চালিয়ে নেওয়া হবে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। কোন পরিস্থিতিতে কোন শর্ত প্রয়োগ করা হবে সেটা আগেই সুস্পষ্ট করতে হবে।
পেনশন স্কিমে ১০ বছরের সময়সীমার মধ্যে পেনশনার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৬০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ মারা গেলে তার পেনশন না পাওয়ার বিষয়টিও পরিষ্কার করা হয়েছে। এগুলোকে ‘অসম শর্ত’ হিসেবে স্কিমের দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেন অধ্যাপক বিদিশা।
তিনি বলেন, ১৮ বছর বয়সে শুরু করে বয়সসীমার শেষ পর্যায়ে এসে কেউ মৃত্যুবরণ করে পেনশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে হচ্ছে, এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এখানে পূর্ণ সুবিধা না পেলেও সমানুপাতিক সুবিধা মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার বা নমিনির পাওয়া উচিত।
এ দুই অর্থনীতিবিদের চিহ্নিত করা পেনশন স্কিমের দুর্বল দিকগুলো নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইয়াজদানি খানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হননি।
সংশ্লিষ্ট আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা বলেছেন, সব ধরনের সমালোচনাকে এখন পরামর্শ হিসেবে নেওয়া হবে। যত পরামর্শ আসবে সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। এমন একটি উদ্যোগ ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়েই পরিপূর্ণতা পাবে।