ধৈর্য ধরার আহ্বান জ্বালানি উপদেষ্টার

“শিল্প ও কৃষিকে সহায়তা করতে গিয়ে আমাদের কিছুটা কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে,” বলছিলেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 August 2022, 02:41 PM
Updated : 4 August 2022, 02:41 PM

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বর্তমান সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি মেনে নিয়ে সবাইকে ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে তা মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সরকার গত ১০ বছরে সম্ভাব্য সবকিছু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত ভূ-রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। সেকারণে অনেক সময় জ্বালানি খাত নিয়ে দেশের বাইরে থেকে ভুল নির্দেশনা ও বিশ্লেষণ আসছে। দেশের স্বার্থে এবিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার তাগিদ দেন তিনি।

বৃহস্পতিবার ঢাকায় মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা’ বিষয়ক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে বীর মুক্তিযোদ্ধা এই উপদেষ্টা বলেন, সেই সময় জনগণ যেভাবে নয় মাস ত্যাগ শিকার করেছে, এখনও দেশের স্বার্থে ত্যাগ শিকার করে যেতে হবে। কারণ, যেই পরিস্থিতি হয়েছে তার জন্য সরকার বা দেশের কোনো ঘটনা দায়ী নয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে, ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে এটা সৃষ্টি হয়েছে।

যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্য বেড়ে যাওয়ার ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশেও। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রাখায় দেশে একই সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় ডলার সাশ্রয়ে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে একদিকে গ্যাসের সঙ্কট, অন্যদিকে ঘনঘন লোডশেডিং হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে ধরে তৌফিক ইলাহী বলেন, যাই হোক সরকার অনেক চেষ্টা করেছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়াতে। এখনও নতুন গ্যাস পাওয়ার কিছু সম্ভাবনা আছে। কিন্তু দেশ ও শিল্প তো থেমে থাকতে পারে না।

বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দেশের মধ্যে বড় সড় কোনো মজুদ পাওয়া না গেলে আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না। কিন্তু যেটুকুন আছে চেষ্টা করে যেতে পারি। সেজন্য আমাদের মেনে নিতে হবে যে, গ্যাসের উৎপাদন খুব একটা বাড়বে না। শিল্প এবং কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা এগিয়ে যাব।“

“শিল্প ও কৃষিকে সহায়তা করতে গিয়ে আমাদের কিছুটা কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নিয়ে অনেক সময় ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়ে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, "দেশের বাইরে থেকে কিছু কিছু ননসেন্স আইডিয়া অনেক সময় চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটা আমাদের সচেতন থাকতে হবে।

“কয়েকদিন আগে দেশীয় একটা বুকলেটে দাবি তোলা হয়েছে সবগুলো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে, আদানি থেকে বিদ্যুৎ না আনতে। এরকম কথা যারা বলে তাদেরকে আপনারা চিহ্নিত করেন। ওরা দেশকে পঙ্গু করে বিদেশিদের তাবেদার থাকতে চায়।“


পোল্যান্ড-জার্মানি পুরোনো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটা আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ। আমাদের মোট উৎপাদন সক্ষমতার তিনগুণেরও বেশি বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে উৎপাদন করছে জার্মানি। অথচ জার্মানরা এখানে এসে এসব দিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়।


জ্বালানির সঙ্গে ‘ভূ-রাজনীতির সম্পর্ক’ আছে উল্লেখ করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, ইউএসজিএস একসময় বাংলাদেশে ৩০ টিসিএফ গ্যাসের মজুদের সম্ভাবনার কথা বলেছিল। তারা ফিল্ডে কোনো কাজ করেনি। তারা মডেলিং করেছে। তখন বলা হল, বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। তারা বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রপ্তানির পরামর্শ দিয়েছিল।

“আমাদের প্রধানমন্ত্রী তখন বলেছিলেন যে, না- নিজেদের জন্য ৫০ বছরের মজুদ না রেখে আমি এক্সপোর্ট করব না।“


গত ১০ বছরে ভূমি ও সমুদ্রে কূপ খননের অনেক প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, ১০ বছর আগে কনোকো ফিলিপসকে দুইটা ব্লক দিয়েছিলাম। তারা কিছু গ্যাস পেয়েছিল। তারা বলল বর্তমান চুক্তিতে আমরা এটা করব না। তোমরা চুক্তি বদলাও। তখন শেভরনও এসে হাজির হয়ে বলল যে আমাদেরও চুক্তি বদলাতে হবে। সেই বার্গেইনিংয়ের পর কনোকো ফিলিপস চলে গেল।


“মিয়ানমারের ওখানে কাজ করছে ফসকো দায়ু নামের একটি কোম্পানি। তাদেরকে আমরা দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তারা এখানে আসছিল। কিন্তু চুক্তি না করে চলে গেল। এভাবে অনেক কোম্পানি এসেই দর কষাকষি করে চলে গেল।”


তিনি বলেন, “আমি যেটা বলতে চাচ্ছি যখন তেলের দাম কম ছিল তখন তারা বললো এ অংশীদারিত্বে আমরা লাভ করতে পারব না। তখন বড় বড় কোম্পানিগুলো বিশ্বে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বড় বড় চুক্তি বাতিল করেছিল। এখন গ্যাসের দাম বেড়েছে বিধায় এখন চুক্তি হতে পারে। কিন্তু এখন আবার নতুন সমস্যা হয়েছে কোপ-২৬ চুক্তির কারণে নতুন করে জীবাশ্ম জালানি উত্তলন কঠিন হয়ে পড়েছে।

উপদেষ্টা দেশের গ্যাস উত্তোলনে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও এসময় তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার শিল্প ও কৃষিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুৎ দেওয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা সাজিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু কারাখানা আবাসিক এলাকার মধ্যে পড়ে যাওয়ায় সেখানে সমস্যা হচ্ছে।

“তারপরও কেউ যদি এরকম সমস্যায় পড়ে, আমাদেরকে জানালে আমরা সমাধানের উদ্যোগ নেব।“

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, বাংলাদেশের এখন দেশি প্রাকৃতিক গ্যাসের খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে; কিন্তু সেটার যোগান নেই। এটাই হল সমস্যার মূল বিষয়।

দেশে গ্যাসের অনুসন্ধান ও কূপ খনন কম হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে তিনটা কূপ খনন করলে একটায় গ্যাস পাওয়া যায়। আর বিশ্বে পাঁচটা খনন করলে একটায় পাওয়া যায়। অনেক দেশে ১০টা কূপ খনন করেও একটা গ্যাস পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কূপ খননের হারটা খুব কম হয়েছে।

“অথচ গত ২২ বছরে ২৫টা কূপ খনন করা হয়েছে। এটা কোনো অনুসন্ধানের ভালো সজ্ঞায় পড়ে না। একারণে বাংলাদেশকে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে কম কূপ খননকারী দেশ।“

মিনায়মানের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “২০১৩ সালে আমরা সমুদ্র বিজয় করলাম। গত ১০ বছরে রাখাইনে গ্যাস আবিষ্কার করে এখন চীনে রপ্তানি করছে। শেভরন, বিপি, টোটাল সবার তৎপরতা আছে এখানে। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।

“আট বছরে একটা কূপ খনন করা হয়েছে। সুতরাং আমাদের গ্যাস ক্রাইসিস হবে না কেন? যদি আমরা সঠিকভাবে মনোযোগ দিতাম আমাদের সঙ্কট হতই না।“

বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “গ্যাস নিয়ে এভাবে পেনিক করতে থাকলে রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়বে। এখন যে ডলার ক্রাইসিস সেখানে দেশ আমদানি নির্ভর হয়ে পড়লে কী পরিস্থিতি হবে।“

গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় গণশুনানি হলেও সেটির গুরুত্ব বাস্তবে থাকে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তার মতো এমসিসিআই সভাপতি সাইফুল ইসলামও দেশের এখনকার পরিস্থিতিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের দিকে বেশি নজর দিতে বলেন।

কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি চুক্তি আরও বাড়ানো উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন সাইফুল।

প্রকৌশলী এজাজ হোসাইন সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বক্তব্য রাখেন।