২০২১ সালের এপ্রিলে তপ্ত আবহাওয়ায় কয়েক ঘণ্টার ‘হিট শকে’ তিন লাখ কৃষকের ২১ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়।
Published : 18 Apr 2023, 01:11 AM
‘ব্লাস্ট’ ছত্রাকের সংক্রমণে হাওরের ব্রি-২৮ ধানে চিটা ধরে আগেই মাথায় উঠেছে কৃষকের হাত। এর মধ্যে টানা তাপপ্রবাহে নতুন বিপদের শঙ্কার কথা জানাল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিআরআরআই।
নিয়মিতভাবে দৈনিক তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়ায় বোরো ধানে ‘হিট শকে’র আশঙ্কা দেখছেন ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা।
ধানের পরিপক্ক হওয়ার পর্যায়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা দানা গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে অর্ধপুষ্ট দানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যা ধানের ফলন ও গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এই প্রভাব ঠেকাতে একটি বুলেটিনে আগাম সতর্কবার্তা প্রকাশ করেছে ইনস্টিটিউট। তারা কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে, ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্ষেতে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে।
চলতি মৌসুমে প্রায় মোট ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সেখান থেকে চাল উৎপাদনের লক্ষামাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২ কোটি ১০ লাখ টন।
এর মধ্যে হাওর অঞ্চলের সাত জেলা হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলায় বোরো আবাদ হয়েছে ৬ লাখ ৬১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে।
এপ্রিলের শুরুতেই খবর আসে, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় ব্রি-২৮ ধানের অধিকাংশ চিটা হয়ে গেছে, ফলে ‘খোরাকি’ নিয়ে দুঃশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন কৃষকরা।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) মো. আব্দুল লতিফ বলেন, “আগাম ফসল যা আছে সেগুলোতে ব্লাস্ট হয়ে গেছে। এর ফলে ধানে চিটা হয়েছে। আটাশ ধান একটা পুরনো জাত এটাতে ব্লাস্ট একটু বেশি হয়।
“এটা এত মারাত্মক যে এটা হলে খুব আগাম ব্যবস্থা নেওয়া লাগে। কিন্তু কৃষক রোগ হওয়ার আগে ব্যবস্থা নেন না। তখন যেটা হয় ফুল আসার আগে ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্লাস্ট হয়ে গেলে ধানটাকে আর বাঁচানো যায় না।”
এদিকে এর মধ্যেই টানা দুই সপ্তাহ ধরে দেশের বেশিরভাগ এলাকায় চলছে তাপপ্রবাহ। কয়েকটি জেলায় গত তিন দিন ধরে তাপমাত্রা থাকছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ফলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ‘হিট শক’ নিয়ে
আব্দুল লতিফ বলেন, “এখন প্রায় ৪০ ডিগ্রির উপরে যে তাপমাত্রা আছে তাতে পাকার পর্যায়ে যে ধান আছে সেটাতেও চিটা হতে পারে। আমরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলছি যেসব গাছে ফুল এসেছে, পরিপক্ব হওয়ার পর্যায়ে আছে, সেসব গাছে কৃষকরা যেন পানি ধরে রাখেন, যাতে ধানগাছ কোনোভাবেই পুড়ে না যায়।
“যখন অনেক বেশি হিট ওয়েভ হয়ে যায়, তখন হয়তো ধান নষ্ট হবে। তবে এখন যে পর্যায় চলছে সেখানে যেসব জমির ধান পরিপক্ব হয়নি সেখানে পানি ধরে রাখতে হবে, এতে চিটা হবে না।“
হিট শক কী, কী করণীয়
বোরো মৌসুম শীতে নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে শুরু হয়। আর শেষটা হয় চরম গরমের এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে।
ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়। ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়। একে বলে হিটশক।
ব্রি কর্মকর্তারা বলছেন, এমনিতে তাপপ্রবাহের মধ্যে কালবৈশাখীও হয়। বৃষ্টি হলে ধাক্কাটা বড় হতে পারে না। কিন্তু যখন তাপপ্রবাহ হয় এবং বৃষ্টি না থাকে, তখন ধানের জন্য ‘হিট শক’ হয়। বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়।
বাংলাদেশে ২০০৭ সালে তাপপ্রবাহের মধ্যে হিট শক দেখা দিয়েছিল। এরপর ২০২১ সালের এপ্রিলে তপ্ত আবহাওয়ায় কয়েক ঘণ্টার ‘হিট শকে’ তিন লাখ কৃষকের ২১ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়।
ব্রির আগাম সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, ধানের ফুল ফোটা ও পরাগায়নের সময় ধানের যে শীষগুলোয় ফুল ফুটতে থাকে, তা খুবই সক্রিয় অবস্থায় থাকে। এ অবস্থায় ধানের শীষকে তপ্ত হাওয়ার (লু হাওয়া) ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য গাছ প্রচুর পরিমাণে পানি প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বের করে দেয়।
এ প্রস্বেদন অনেকটা গাছের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ‘কুলিং সিস্টেমে’র (শীতলীকরণ ব্যবস্থা) মত কাজ করে। কাজেই এ সময় তীব্র তাপদাহের ‘হিট শকে’র ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার উপায় হচ্ছে বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে হবে এবং ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি রাখতে হবে।
চিটায় নষ্ট বছরের খোরাক
এরই মাঝে হাওরের জেলাগুলোতে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। এসব অঞ্চলের যেসব জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ হয়েছে সেগুলো পরিপক্ব হওয়ায় কাটার প্রক্রিয়া চলছে। তবে ব্রি-২৯ জাতের ধান এখনো মাঠে আছে।
হাওরের উপজেলাগুলোর কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এতদিন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূল থাকায় হাওরাঞ্চলে ব্যাপক বোরো ধান চাষ হয়েছে। ধানের শীষে সোনালি রঙ এসেছে, আশা আছে ব্যাপক ফলনের।
কৃষি বিভাগের আশা থাকলেও ‘ব্লাস্ট’ রোগে এরই মাঝে ব্রি-২৮ চাষ হয়ে এমন অনেক জমির ধানে চিটা দেখা দেওয়া কপাল পুড়েছে কৃষকের।
নেত্রকোণার মদন উপজেলার কৃষক সনি আহম্মেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার আটাইশের (ব্রি-২৮) সব ধান চিটা হয়ে গেছে। একটা ধানও আর উঠানোর অবস্থায় নাই। সব লস, ৪৫ হাজার ট্যাকা খরচ হইছিল, এক ট্যাকাও উইডা আইতো না।”
একই পরিস্থিতি হয়েছে পাশের উপজেলা মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুড়ি উপজেলায়। প্রতিবেশী জেলা কিশোরগঞ্জের হাওরগুলোতেও একই ঘটনা ঘটেছে।
মুন্সীগঞ্জে আধা-পাকা ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ, দিশেহারা কৃষক
ব্রি-২৮ ধানে ব্লাস্ট, চাষ করে বিপাকে কৃষক
কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার বাঙালপাড়া ইউনিয়নের কৃষক হাতিম মিয়া বলেন, “এই বছরে অবস্থা খুবই খারাপ। আটাইশ ধান সব খেতেই চিটা হইয়া গেছে। কৃষি অফিস কিছু ওষুধের কথা কইছিল। এইগুলাতে কোনো কাম হইছে না। আমি দুই হাজার মণ ধান পাই। এইবার অর্ধেকও পামু না।”
একই এলাকার আরেক কৃষক শহিদ উল্লাহ বলেন, “আগে পাইজং নামে একটা ধান ছিল এইটা ১০-১২ বছর ভাল ফলন দিলেও পরে নষ্ট হইয়া গেছে। আটাইশ ধানটা গতবছরি সিগন্যাল দিছিল ভাল হইব না। এইবার তো একেবারেই নষ্ট। কৃষি অফিসারেরা মাঠে আইসা দেখেও না।”
এ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোহা. আব্দুল মতিন বলেন, “ধানের চিটাটা হয়েছে আবহাওয়ার জন্য। আমাদের এখানে কিছুদিন আগে অনেক বেলা পর্যন্ত কুয়াশা থেকেছে, দিন ও রাতের তাপমাত্রায় অনেক পার্থক্য ছিল। এটা ব্লাস্ট ছত্রাক আক্রমণের জন্য আদর্শ। এর প্রতিকারে কী ওষুধ স্প্রে করতে হবে তা আমরা কৃষকদের জানিয়েছি। তারা ছিটানোর চেষ্টা করেছেন। তবে মাঝে আবার বৃষ্টির সময় অনেকেই সেটা ছিটাতে না পারায় এই সমস্যাটা দেখা দিয়েছে।”
মাঠ পরিদর্শন ও কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর প্রশ্নে ‘লোকবল সংকটের’ কথা জানান এই কর্মকর্তা।
হিট শকের আপদ
ব্রি হিট শকের ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা দিলেও এ ব্যাপারে কৃষি অফিস থেকে তথ্য না পাওয়ার কথা জানালেন কৃষকরা। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কথা বলছেন তারা।
মদন উপজেলার কাইটাইল ইউনিয়নের বাঁশরী গ্রামের কৃষক আলী হায়দার বলেন, “আমি ৬০ থেকে ৭০ কাডা জমিনও পাঁচ জাতের ধান লাগাইছলাম। ঊনত্রিশ (ব্রি ২৯) ছাড়া বাকি জাতের ধান বেকতা (সব) পাইক্কা গেছেগা। ঊনত্রিশের জমিনডিত পানি দিয়া রাখতাছি। আমার জমিনও গরমে অহনও কোনো ক্ষতি হইছে না।”
আলী হায়দার নিজের জমিতে এই তাপদাহে পানি ধরে রাখছেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই। কৃষি অফিস থেকে পাননি কোনো নির্দেশনা। তবে তার ছেলে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া আনাস জানায়, “আমাদের যে খবরাখবর পাওয়ার এইগুলা আমরা নিজেরাই ফেসবুকে, খবর থেকে নানাভাবে জানি। অফিস থেকে কিছু জানায় না।
“টানের মধ্যে (উজানে) যে জমিগুলাতে ঊনত্রিশ ধান আছে, এইগুলাতে পানি দেওয়া দরকার, কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকার কারণে দেওয়া যাচ্ছে না।“
‘হিট শকে’ ধান চিটা: কেন হয়, প্রতিকার কী
‘হিট শকে’ এক লাখ টন চাল কম উৎপাদনের শঙ্কা
কৃষি অফিস থেকে নির্দেশনা না পাওয়ার কথা জানালেন একই উপজেলার কুলিয়াটি গ্রামের আরেক কৃষক আমিনুল ইসলাম। তিনি বললেন, “আমার জমিনের ধানে রঙ চইলা আসছে। এই কারণে জমিনে আর পানি ধইরা রাখতেছি না। তবে পানি দিতেছি। রইদ তো, পানি দিলেও থাকে না। কৃষি অফিস থাইক্কা আমরারে কোনো কিছু জানানো হয় নাই।”
কৃষি অফিসের তরফ থেকে নির্দেশনা না পাওয়ার কথা কৃষকদের মুখ থেকে শোনা গেলাও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা নানাভাবে কৃষকদের সেগুলো জানানোর চেষ্টা করছেন।
মদন উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “কিছুদিন আগে যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে জমিতে অনেক পানি ধরা আছে, এটা এখন কাজে দিচ্ছে। পাশাপাশি পল্লী বিদ্যুৎকে বলছি। যেসব এলাকা উঁচু সেখানে সেচের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য নিয়মিতভাবে বলছি। কৃষকদের সাথেও আমাদের কথাবার্তা হচ্ছে, আমরা মাঠে যাচ্ছি, আজকেও আমি মাঠে গিয়েছি। তাদের বলেছি যেন দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার পানি তারা ধরে রাখেন।“
হাওরের ধানে ছত্রাক ও হিট শকের ধাক্কা কতটা হতে পারে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (ক্রপস) স্বপন কুমার খাঁ বলেন, “হাওরের ধানে ছত্রাক বা এখন যে তাপদাহ চলছে তার জন্য হিট শক এগুলো অনেক ব্যাপার ঘটতে পারে, তবে এর সঠিক তথ্য আমাদের স্থানীয় কৃষি অফিসারেরা মাঠ ভিজিট করে রাখেন। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে আমাদের নির্দেশনা ছিল ধানের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”
কর্মকর্তাদের মাঠে না যাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, “এটা ঠিক নয়। প্রত্যেক ইউনিয়নে আমাদের তিনজন করে কর্মকর্তা আছেন। তবে অনেক জায়গায় লোক সংকট আছে, নিয়োগ চলছে।“