‘হিট শকে’ ধান চিটা: কেন হয়, প্রতিকার কী

চৈত্রের গরমে কৃষকের মাথায় হাত বিস্তীর্ণ জনপদে। ধানের ফুল ফোটার সময়ে গরম হাওয়ায় পুড়েছে তাদের স্বপ্ন। চলতি মৌসুমে টানা তাপপ্রবাহে ক্ষতি হচ্ছে বোরো ফসলের।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2021, 02:25 AM
Updated : 8 April 2021, 07:44 AM

এবার প্রায় অর্ধ লাখ হেক্টর জমির ফসল কোনো না কোনোভাবে এ ‘হিট শকের’ মুখে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। এতে ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা হতে পারে।

কৃষিতে এক যুগের মধ্যে এমন বড় ধরনের ‘হিট শক’ ঘটেনি বলে জানান কৃষি বিশেষজ্ঞরা। কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে তাই উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।

কারণ বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহ

মার্চ মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে তাপদাহের এক দফা দাপট ছিল দেশে। এপ্রিলের শুরুতেও তা অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মার্চের শেষ সপ্তাহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। এখন ধানের জন্য ক্রিটিক্যাল টেম্পেরেচার ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর উপরে যদি তাপমাত্রা উঠে এবং এসময় যদি ফুল ফোটে সেগুলো শুকিয়ে যেতে পারে।

বোরো মৌসুম শীতে নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে শুরু হয়। আর শেষটা হয় চরম গরমের এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে। ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়। ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়।

ব্রি-এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ) ড. মুন্নুজান খানম বিডিনিউজ ডটকমকে বলেন, ২০০৭ সালের পরে এ ধরনের হিট শক আর ঘটেনি। তাপপ্রবাহের মধ্যে কালবৈশাখীও থাকে। কিন্তু যখনই তাপপ্রবাহ হয় এবং সে সময় বৃষ্টি থাকে না তখনই ধানের জন্য তা হিট শক ঘটে। অর্থাৎ বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়।

শাহজাহান কবীর বলেন, “হিট শক-এ পলিনেশনটা ঠিক মতো হবে না, বাধাগ্রস্ত হবে। এবার যেহেতু দীর্ঘমেয়াদে হট টেম্পারেচার ছিল, এরপর ৪ এপ্রিল দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে একটা হিট ওয়েব ছিল তাতে এটা পুড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে পোলেন (ধানের রেণু) শুকিয়ে গেছে, পাতা শুকিয়ে গেছে। যার জন্য ওই সময়ে যেগুলো ফ্লাওয়ারিং অবস্থায় ছিল সেগুলোতে ক্ষতি হয়েছে।”

প্রায় অর্ধ লাখ হেক্টর জমির ক্ষতিতে কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে বলে ধারণা দেন এ কর্মকর্তা।

দীর্ঘ চাকরি জীবনে কৃষিতে এমন  বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘হিট শক’ ঘটেনি উল্লেখ করে ব্রি মহাপরিচালক বলেন, “এখন পযন্ত ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে এফেক্টেড হয়েছে। এটা বিভিন্ন লেভেলে। কোনো কোনো জমি ৮০% পযন্ত, কোনো জমি ৫%-১০%; আবার পাশে ভালোও রয়েছে। যেখানে ফ্লাওয়ারিং পর্যায়ে ছিল না, সেখানে খুবই সুন্দর রয়েছে, যেখানে ফ্লাওয়ারিং ছিল সেটাতে ৭০-৮০% ক্ষতি হয়েছে।”

 

করণীয় কী

কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের শীর্ষ ব্যক্তিরা ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

তীব্র তাপদাহের এমন পরিস্থিতিতে ‘হিট শক’ থেকে ধানের ফুল বাঁচাতে জমিতে পানি ধরে রাখা এবং পরবর্তীতে পাতাপোড়া থেকে রক্ষায় বিশেষ স্প্রে ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ব্রি-এর মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর বলেন, “এ সময় বোরো ধানের যে সকল জাত ফুল ফোটার পর্যায়ে আছে বা এখন ফুল ফুটছে বা সামনে ফুল ফুটবে, সে সকল জমিতে পানি ধরে রেখে ধানের ফুল ফোটা পর্যায়ে হিট শক/ হিট ইনজুরি থেকে রক্ষা করতে হবে।

“যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে, বাকিটা বাঁচানোর জন্য এ উদ্যোগ। পানি ধরে রাখতে হবে- এটাই আমাদের সাজেশন।… এ টেম্পেচোর যদি আরও বাড়ে পরিচর্যা ঠিক মতো করতে না পারলে আরও ক্ষতি হতে পারে।  পানি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে হবে।”

তিনি বলেন, “এ মুহূর্তে জমিতে অন্তত ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখার জন্য বলছি। যাতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও পানি থাকলে তা কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যদি তাপমাত্রা রাখা যায়, তাহলে এ সমস্যা হবে না।”

যেখানে ঝড় হয়েছে, সেখানে পাতাপোড়া রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, সেখানে ৬০ গ্রাম এমওপি সার, ৬০ গ্রাম থিওভিট ও ২০ গ্রাম জিংক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকালে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।

বৈঠকে বসছে মন্ত্রণালয়

কৃষি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মেসবাহুল ইসলাম,  কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বুধবার নেত্রকোনা, মদন, খালিয়াজুড়ি, কেন্দুয়া, কিশোরগঞ্জের নিকলী, করিমগঞ্জ, সদর এলাকা ঘুরে দেখেছেন।

ব্রি মহাপরিচালক মাঠ পযায়ের করুণ অবস্থা তুলে ধরে বলেন, “জাতীয়ভাবে হয়ত তেমন ক্ষতি নয়। কিন্তু যার ক্ষতি হয়েছে তার পুরোটাই গেছে, বিশ্বাস করেন, চোখে পানি ধরে রাখা যায় না।

“ফসলের এত সুন্দর মাঠ। কৃষকের যেমন কষ্ট হয়েছে আমাদেরও কষ্ট বুক ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা। বর্গা চাষি এত কষ্ট করে তিন বিঘা জমি লাগিয়েছে, দেড় বিঘা নষ্ট হয়ে গেছে।”

এ অবস্থায় কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বৈঠক করা হচ্ছে।

ড. শাহজাহান বলেন, “ক্ষয় ক্ষতি নিরুপণের কাজ চলছে, কৃষকদের যেন পুষিয়ে দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; আমরা তো সচক্ষে দেখে এলাম। জ্যেষ্ঠ সচিব  ইতোমধ্যে অর্থ সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন কীভাবে টাকা স্বল্প সময়ে পাওয়া যায়। মন্ত্রী মহোদয় খোঁজ নিচ্ছেন। সার্বিক বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হবে।”