বাড়তে থাকা বৈষম্য কমাতে ‘কর কাঠামো’ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; বাজেটে এ বিষয়ে নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপ থাকা দরকার, বলেন সানেম এর এই গবেষণা পরিচালক।
Published : 30 May 2023, 01:13 AM
চতুর্মুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতির বিষয়টি ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’; পাশাপাশি পরোক্ষ করে স্বস্তি দিয়ে প্রত্যক্ষ করে বড় সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো গেলে তা বৈষম্য কমাতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন গবেষক ও অর্থনীতির শিক্ষক অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বর্তমান হালচালের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল আগামী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের যে বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন তাতে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির বিষয়গুলোতেও অগ্রাধিকার থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, একই সঙ্গে বাজেটের ব্যয় মেটাতে রাজস্ব আদায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতাধীন ও অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে।
বাজেটে নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি বাড়তে থাকা বৈষম্য কমাতে ‘কর কাঠামো’ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর গবেষণা পরিচালক সায়মা বিদিশা।
আগামী ১ জুন সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী, যেটির আকার প্রায় সাত লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা হতে যাচ্ছে বলে আভাস মিলেছে। অর্থনীতির নানামুখী চ্যালেঞ্জের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বাজেটও হতে যাচ্ছে এটি।
বাজেটের আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা এক প্রশ্নে বলেন, নির্বাচনের বছরে বাজেটে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়াটা চ্যালেঞ্জ হয়। কিন্তু কিছু কিছু সংস্কার আছে যেটা সাধারণ মানুষ ইতিবাচকভাবে দেখবে। সেই ধরনের সংস্কারের দিকে এগোলে সেটা সরকারের জন্য ইতিবাচক দিক হবে। সরকারেরও উপকার হবে।
“প্রগতিশীল কর কাঠামো যদি বাজেটের মাধ্যমে দেখানো যায় তাহলে সেটা মানুষকে খুশি করবে। মূল কথা সংস্কারগুলো যদি সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট করে সেটা সরকারের জন্য ভালো, রাজস্ব আহরণের জন্য ভালো এবং জনগণও খুশি।”
বাজেটে আয়-ব্যয়ের কোন দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে চান- এমন প্রশ্নে অর্থনীতির এই শিক্ষক বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যস্ফীতি। অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন মানেই হচ্ছে পিছিয়ে পড়া মানুষকে কিছু স্বস্তি দেওয়া। মূসক ও বিভিন্ন রকম নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কে হয়তো সরকার কিছু ছাড় দেবে। বিশেষ করে নিত্যপণ্য ও সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজন এমন পণ্যগুলোতে। এর বিপরীতে বিভিন্ন বিলাসদ্রব্য যেগুলোর মূল ভোক্তা সম্পদশালী মানুষজন সেগুলোর ওপর শুল্ক বাড়ানো। আবার কিছু বিলাস পণ্যে অনেক দাম বাড়লেও এর মূল ভোক্তারা কেনাকাটা বন্ধ করবেন না, সেগুলোর ওপর করের চাপ বাড়ানো যেতে পারে।
“পরোক্ষ করে স্বস্তি দিয়ে প্রত্যক্ষ কর বা ইনকাম ট্যাক্সের ওপর বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। এতে করে রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।“
বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা সার্বিক হিসাবে অনেক সময় গুরুত্ব পায় না- এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, কারণ পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ বাদ দিলে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খুব একটা থাকে না। এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
“যেহেতু রাজস্ব আহরণ হঠাৎ করে অনেক বেশি পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে পরিচালন ব্যয়ে কাটছাঁট করা জরুরি। যে ধরনের প্রকল্প এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় সেগুলো বন্ধ রাখা। যেসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
এর বাইরে এডিপি বাস্তবায়নে তিন মাস অন্তর পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন চালু রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সেই মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী প্রান্তিকের কাজ বাস্তবায়ন করা উচিত। কারণ এ মুহূর্তে কোনোভাবেই আমাদের প্রকল্পগুলোতে অপচয় বা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করার সুযোগ নেই।
সামাজিক নিরাপত্তাকে বেষ্টনীর আওতায় আরও বেশি মানুষকে সহায়তা দেওয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক বিদিশা বলেন, ২০১৫ সালের দিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও বেষ্টনী ডিজাইন করা হয়েছিল। এরপর ২০১৯-২০২০ সালের দিকে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঠিক করা হয়। সেটা যথেষ্ট কম্প্রিহেনসিভ কর্মসূচি ছিল। অল্প কয়েকটা প্রকল্পের মাধ্যমে সার্বিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর দ্রুত বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার।
“দ্বিতীয়ত সামাজিক নিরাপত্তার তালিকায় যাদের থাকার কথা নয় তারা থেকে যাচ্ছে। আবার যাদের থাকার কথা তারা কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে সুবিধাভোগীর ক্রাইটেরিয়া যেভাবে সাজানো হয় সেটা কিন্তু অনেক ব্যাক ডেটেড ইনফরমেশনের ওপর ভিত্তি করে। কারণ মানুষের সক্ষমতা কিন্তু কিছুদিন পর পর উঠানামা করতে পারে। এগুলোর জন্য একটা বড় ধরনের ডিজিটাল ডাটা ভাণ্ডার থাকা দরকার। তাহলে বিতরণ জনিত অপচয় দূর করা সম্ভব।”
এ ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলে বিশেষ করে শহরের বস্তিতে থাকা নতুন দরিদ্রদের গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সামাজিক বীমা চালু এবং আরও ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করার কথা বলেন তিনি।
বাজেটের মাধ্যমেই সারা বছর ভর্তুকির রূপরেখা কেমন হবে সেটির একটি দিক নির্দেশনা মেলে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এসময়ে এবং বিদেশি মুদ্রা নিয়ে চাপে থাকার মধ্যে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাটির দিক থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে ভুর্তকির প্রসঙ্গে সায়মা বিদিশা বলেন, ভর্তুকি কমানোর ক্ষেত্রে কৃষির ভর্তুকিটার ব্যাপারে সাবধানতার সঙ্গে কাজ করা দরকার। এখানে ভর্তুকির মধ্যে কিছু শ্রেণি বিন্যাস করা যেতে পারে। এখানে ভর্তুকি কমলেও প্রান্তিক ও ছোট কৃষি যেন কোনোভাবেই আক্রান্ত না হয়।
“গ্যাস বিদ্যুতে যেসব ভর্তুকি এখন আছে এখানেও শ্রেণিবিন্যাস আরোপ করা যেতে পারে। যেমন এত টাকার বেশি গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার করলে ইউনিট প্রাইস এরকম। আবার এর চেয়ে বেশি খরচ করতে থাকলে ইউনিট প্রাইসও একটা হারে বাড়তে থাকবে।“
জ্বালানির দামের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে সমন্বয় থাকা দরকার বলেও মনে করেন তিনি। উদাহারণ দিয়ে বলেন, “যেমন তিন মাস পর পর দাম সমন্বয় করা যেতে পারে। দাম বাড়লে বা কমার সম্ভাবনা থাকলে সেটা আগে থেকেই সাধারণ ঘোষণা আকারে জানিয়ে দেওয়া। এতে ব্যবসায়ীরা তাদের পরিকল্পনা সাজাতে পারবেন।“
পাশাপাশি তেল বিপিসি কিংবা অন্যান্য করপোরেশনের বিভিন্ন ধরনের অপচয় কমিয়ে এনে ভর্তুকির প্রভাব কমিয়ে আনার কথা বলেন এ গবেষক।
তিনি বলেন, ভর্তুকির একটা বড় খাত হচ্ছে প্রণোদনা। এগুলো আমরা কাদেরকে দিচ্ছি সেটা খেয়াল রাখা দরকার। যারা বছরের পর বছর পেয়ে আসছেন তারা সক্ষম হচ্ছেন কি না। শ্রমঘন শিল্পে বেশি প্রণোদনা যাচ্ছে কি না। প্রণোদনা, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান এভাবে যেন হয়।
পাশাপাশি যারা প্রণোদনা পাচ্ছে তাদের শর্ত দিতে হবে যে, ন্যূনতম মজুরি, নারী শ্রমিক, রেশন ব্যবস্থা, রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং শ্রমিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের অবস্থান কেমন ইত্যাদি দেখতে হবে, যোগ করেন তিনি।
বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্যে যে বরাদ্দ থাকে তা জিডিপির তুলনায় কম। অথচ মানবসম্পদ উন্নয়নে এ দিকে বেশি নজর দেওয়ার পরামর্শ। কী করা উচিত সরকারের। অপরদিকে কোভিড, মূল্যস্ফীতি আরও মানুষকে দরিদ্র করে দিয়েছে। বাজেটে দারিদ্র্য কমাতে কী কী উদ্যোগ থাকা দরকার। সাধারণের ওপর এই চাপ কমাতে কী করা উচিত? অন্যদিকে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। তা কমাতে কেমন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
এসব প্রসঙ্গে সানেমের গবেষকা পরিচালক সায়মা বিদিশা বলেন, বৈষম্য কমানোর খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ট্যাক্স স্ট্রাকচার। এখন যে কর কাঠামো প্রগতিশীল নয়, তা কিন্তু বলছি না। কিন্তু আরও কিছু সাজানো যায়। যেমন সম্পদ কর, উত্তরাধিকার কর এগুলো খুব সিস্টেমেটিকভাবে যেন আহরণ করা যায়। আরও প্রগতিশীল হারে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আহরণ যেন করা হয়; স্লাবগুলোকে সেভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
“ইনকাম ট্যাক্স সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। উপরের দিকগুলো আরও বেশি শক্তভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কিছু কিছু উপজেলায় অনেক ট্যাক্সেবল মানুষ আছে। তাদেরকে ট্যাক্সের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। জেলা উপজেলা, ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের কিছু দায়িত্ব দিতে হবে। তাদেরকে কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। ঢাকার বাইরে উপজেলা পর্যায়ে প্রান্তিক অঞ্চলে কর মেলা করতে হবে। শুরুর দিকে তাদেরকে কিছু ছাড় দেওয়া যেতে পারে।”
এনবিআর ও ট্যারিফ কমিশন এ দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের তাগিদ দিয়ে সায়মা হক বলেন, কোথায় কর বাড়বে- কোথায় কমবে এটা দুই পক্ষ মিলে ঠিক করতে হবে।
কর ফাঁকি দেওয়া কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, উপরের দিকে কর ফাঁকি দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। অনেক আয়কে তারা নিজের আয় না বলে কোম্পানির আয় বলে চালিয়ে দেন। এর মাধ্যমে নিজস্ব সম্পদ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ- এগুলোকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। তাহলে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমে যাবে।
“হাউজহোল্ড লেবেলেও কাজ করতে হবে। যারা দুই তিনটা গাড়ি ব্যবহার করেন তাদের সম্পদগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে জানতে হবে। কৃষির অনেক খাত আছে যেমন মৎস্য খামার। এ খাতে অনেকেই আছে যারা সৎ কৃষক নন। অনেক বড় কৃষক আছেন যাদের আয় অনেক বেশি। তারা বিভিন্নভাবে ট্যাক্স ফাঁকি দেন। এগুলোতে ফাঁকিগুলো রোধে মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে।”
অনেক পেশাদার ব্যক্তি সেবার ক্ষেত্রে লেনদেনের ক্ষেত্রে ‘রিসিট দেন না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাদের লেনদেন ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বা অন্য কোনো উপায়ে যেন লেনদেনটা করে।