“এলসি খোলার সময়ে পণ্যর দাম সঠিকভাবে ব্যাংকাররা দেখাচ্ছেন না।”
Published : 20 Feb 2024, 11:43 PM
অর্থপাচারের ঘটনায় ব্যাংকারদের দায়ী করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলছেন, ব্যাংকাররা তাদের দায়িত্ব ‘সঠিকভাবে পালন করছেন না’।
অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সংস্থা বিএফআইইউ এর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ও সন্দেহজনক কার্যক্রম গত এক বছরে ‘উল্লেখযোগ্য হারে’ বেড়েছে বলে উঠে এসেছে বিএফআইইউ এর এবারের প্রতিবেদনে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম মিলনায়তনে এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন বিএফআইইউ প্রধান।
নানামুখী উদ্যোগের পরও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচারের পরিমাণ বাড়ছে। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমেও প্রায়ই বাংলাদেশিদের বিনিয়োগে নিয়ে খবর প্রচার হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগ করতে অনুমতি নিতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। কিন্তু যে পরিমাণ অনুমোদন নেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে অনেকগুন বেশি বিনিয়োগের তথ্য আসছে গণমাধ্যমে।
অর্থপাচারের পরিমাণ কত– এমন প্রশ্নের উত্তরে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, এ বিষয়ে কেনো গবেষণা নেই।
দিন দিন অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো বাড়ছে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অর্থপাচারের ৮০ শতাংশই বৈদেশিক বাণিজ্য তথা আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্রিক।
“অর্থপাচারের জন্য সবচেয়ে ভালনারেবল হচ্ছে ব্যাংক। ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। রেমিটেন্স আসে বেশি।“
বাণিজ্যকেন্দ্রিক মানিলন্ডারিং এখনো কমছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কমছে না আমাদের কারণে। ঋণ শ্রেণিকরণের দায়িত্ব তো ব্যাংকের, তারাই করে থাকে। তারা যদি না করে, তাহলে কীভাবে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো সব সময় গিয়ে দেখতে পারে না। অনেক শাখায় তো তিন বছর পরে পরিদর্শন হয়।”
‘আমরা’ বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, তিনি ব্যাংকারদের বুঝিয়েছেন।
“আমরা (ব্যাংকার) আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি না। এলসি (ঋণপত্র) খোলার সময়ে পণ্যর দাম সঠিকভাবে ব্যাংকাররা দেখাচ্ছেন না, বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখাচ্ছেন। এভাবে আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিং হয়ে যাচ্ছে।”
আমদানি-রপ্তানির আড়ালে পণ্য মূল্য বাড়িয়ে ও কমিয়ে দেখানোর সঙ্গে ‘ব্যাংকাররা জড়িত’- এমন তথ্যও পাওয়ার কথা জানান বিএফআইইউ প্রধান।
তিনি বলেন, “এর ফলে মানি লন্ডার (অর্থপাচার) হয়ে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেখেছে, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ মানিলন্ডারিং হয়েছে এলসিতে। তেমনি আন্ডার ইনভয়েসিংও হয়েছে।”
তবে এই প্রবণতা কমে আসছে দাবি করে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “যদি ওভার ইনভেয়েসিং-আন্ডার ইনভয়েসিং না হয়, এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস) এর অপব্যবহার না হয়, তাহলে এমনিতেই অর্থপাচার কমে যাবে।”
আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠানই আছে, যারা পণ্যর দাম প্রকাশ করে নিয়মিত। ব্যাংকাররা এখন চাইলেই পণ্যের দাম যাচাই করে দেখতে পারেন মন্তব্য করে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “ব্যাংকাররা যদি ঠিক মত এলসিগুলো খোলেন, তাহলে ওভার ইনভেয়েসিং-আন্ডার ইনভয়েসিং হবে না।”
ঋণপত্রে ভুল তথ্য দিয়ে অর্থপাচারে সহযোগিতাকারী ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না- এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের উত্তরে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “আমরা তাদের শাস্তির আওতায় আনতে ব্যাংকগুলোকে বলছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেনন্ট (বিআইবিএম) ট্রেড বেইজড মানিলন্ডারিংয়ের উপর গবেষণা করেছিল ২০১৯ সালে।
‘অ্যাড্রেসিং ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিং ইন বাংলাদেশ: অ্যান অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক ওই গবেষণার উপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিল বিআইবিএমের পরিচালক শাহ মো. আহসান হাবীব।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সব ব্যাংকের কমপ্লায়েন্সের (নীতিমালা পরিপালন করা) সক্ষমতা একরকম নয়, কারো দুর্বল- কেউ সবল। অন্তত তিন চারটি শ্রেণিতে তাদের ভাগ করা যাবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের নীতিমালা যথেষ্ট রয়েছে। এখন দরকার তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না, তার সুপারভিশন (তদারকি) বাড়ানো। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে সুপারভিশনে জোর দিতে হবে।”
তবে অর্থপাচার প্রতিরোধে ব্যাংকগুলো নিজেদের উদ্যোগে এগিয়ে আসবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এর পেছনের কারণ হল, কমপ্লায়েন্স করলে তো তার (ব্যাংকের) ব্যবসা কমে যেতে পারে। সে (ব্যাংক) তো ব্যবসাও করবে। অর্থপাচার ইস্যুতে ব্যাংকারদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও সচেতন করা প্রয়োজন।”
২০১৮ সালে করা ‘নতুন পেমেন্ট সিস্টেমে (অনলাইন ও মোবাইল) অর্থপাচার’ শীর্ষক গবেষণায় অর্থপাচার রোধে লেনদেনে নগদ অর্থের ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনার সুপারিশ করেছিল বিআইবিএম।
বাড়ছে নগদ লেনদেন
লেনদেন ‘ক্যাশলেস’ করতে গত বছর উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বিকল্প হিসেবে কার্ড, কিউআর কোডে লেনদেনে উৎসাহিত করা হয়।
বতর্মানে সব ব্যাংকেই নগদ অর্থের বিকল্প লেনদেনের সুযোগ রয়েছে। তারপরও গত পাঁচ বছর ধরে নগদ অর্থে লেনদেন বৃদ্ধির তথ্য দিয়েছে বিএফআইইউ। শুধু মহামারীর সময় গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে নগদ অর্থের লেনদেন কমেছিল।
সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে নগদ লেনদেনের সংখ্যা ও পরিমাণ দুটোই বেড়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে নগদ লেনদেন হয় ২২ লাখ ৮৬ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এই অংক আগের বছরের চেয়ে এক লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা বা আট দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরে নগদ লেনদেন হয় ২১ লাখ ১১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। চার বছর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে নগদ লেনদেন ছিল ১১ লাখ ৭১ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা।
বিএফআইইউ প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুষ, দুর্নীতি, মুক্তিপণ, চাঁদাবাজি, মানব পাচার ও হুন্ডির মত অপরাধে নগদ অর্থের ব্যবহার হয়।
সারা দেশে নগদ অর্থ লেনদেনের ৫৭ শতাংশই হয় ঢাকা বিভাগে। আর লেনদেনের ৮০ শতাংশই করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ব্যাংকে
আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন বা এসটিআর ও সন্দেহজনক কার্যক্রম এক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে উঠে এসেছে বিএফআইইউ এর প্রতিবেদনে।
তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসটিআর রিপোর্টিং হয়েছে ১৪ হাজার ১০৬টি। আগের অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে ৬৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৫ হাজার ৫৩৫টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি।
সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) মানেই অপরাধ নয়। এ ধরনের তথ্য পেলে তা খতিয়ে দেখা হয়।
বিএফআইইউ প্রধান বলেন, “এসটিআর এর বিপরীতে প্রমাণ পেলে আমরা অপরাধ হিসেবে গণ্য করি।”
মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন বৃদ্ধির একটি কারণ হল, ব্যাংকগুলো এখন আগের চেয়ে বেশি প্রতিবেদন দিচ্ছে।
“আমরা ব্যাংকারদের বুঝিয়েছি, এখন তারা সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য রিপোর্টিং করছেন আগের চেয়ে বেশি। তারা জানিয়েছেন, ভয়ে আগে তারা কম রিপোটিং করতেন।”