আয়কর বিবরণি জমা দিয়ে ‘হাল্কা’ হয়ে ফেরা

এবার রিটার্ন জমার সংখ্যা বাড়ছে, জানালেন এনবিআর কর্মকর্তারা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2022, 07:19 PM
Updated : 27 Nov 2022, 07:19 PM

ঠিকাদার গোলাম মোস্তফা জীবনে প্রথম আয়কর বিবরণি জমা দিলেন। তা জমা দিতে এসেছিলেন ‘ভয়’ নিয়ে; কিন্তু তা কেটে গেছে।

ঢাকার নয়া পল্টনে কর অঞ্চল-১৫ তে দেখা মিলল মোস্তফার। তিনি বললেন, “অনেকের কাছে রিটার্ন দাখিলের জটিলতার কথা শুনে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এনবিআরের সেবায় আমার ভয় কেটে গেছে। বরং এখন গাঁটের টাকা সরকারকে দিয়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল করে নিজেকে হাল্কা লাগছে।”

মোস্তফা এত দিন আয়কর বিবরণি জমা দেনেনি। তবে চলতি অর্থবছরে সরকার দরপত্রে অংশ নিতে আয়কর বিবরণি দাখিলের প্রমাণপত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করায় এবার তাকেও এনবিআরমুখো হতে হয়েছে।

নভেম্বর আয়কর সেবা মাস হিসেবে পালিত হয়। ব্যক্তি শ্রেণির আয়করদাতারা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া নিজেদের আয়কর বিবরণি দাখিল করতে পারেন, যা জমা দিলে শাস্তির বিধান রয়েছে।

এনবিআরকর্মীরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিষেবায় বাধ্যতামূলক করায় আয়কর বিবরণি দাখিল ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।

কর অঞ্চল-১৫ এ রোববার গিয়ে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সবাইকে লাইনে দাঁড়িয়ে আয়কর বিবরণি জমা দিতে দেখা গেছে। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আর করমেলা আয়োজন না করলেও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে মেলার মতো পরিবেশ তৈরি করেই আয়কর জমা নিচ্ছেন।

সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা রতন ধর এনবিআরের সেবায় সন্তোষ জানিয়ে বলেন, “মাসের শুরুর দিকে নানা ব্যস্ততার কারণে আসতে পারিনি। আজকে এসে রিটার্ন দাখিল করে গেলাম। প্রাপ্তি স্বীকারপত্র সাথে সাথে পাওয়া যায় বলে সেবার মাসেই রিটার্ন দাখিল করি।”

এমন সেবা পেলে দেশের আরও অনেক মানুষ আয়কর দিতে আগ্রহী হবে বলে মনে করে ঠিকাদার মোস্তফা। সেই সঙ্গে প্রচার ও সময় বাড়ানোর পক্ষেও মত দেন তিনি।

“আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কর সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নয়। মানুষের আয় বাড়ছে বলে অনেকেই করের আওতায় আসছেন। কিন্তু সচেতনতার অভাবে অনেকে রিটার্ন দাখিল করেন না।”

এবার সেবার মাসে রিটার্ন দাখিল কেমন হচ্ছে- জানতে চাইলে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, “এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় রিটার্ন দাখিল নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি হবে।”

 তিনিও বলেন, এবছর থেকে সরকার পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা ও ঋণের আবেদন, ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ, কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হওয়াসহ অনেকগুলো পরিষেবায় রিটার্নে দাখিলপত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা এতে প্রভাব ফেলছে।

“গত বছর এই কর অঞ্চলে যেখানে দিনে রিটার্ন জমা পড়ত গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ মতো, সেখানে এবারে গড়ে প্রায় ১ হাজারের বেশি হতে পারে।”

সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়নি

প্রত্যক্ষ কর আহরণ বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল নিয়ে সরকার ২০১০ সাল থেকে নভেম্বর মাসকে কর সেবার মাস হিসেবে আয়কর মেলা পালন করে আসছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২০২০ সাল থেকে আয়কর সেবা মাস পালনে ছেদ পড়ে।

তবে মেলার সেবা দিয়ে কর অঞ্চলগুলোতে নভেম্বর মাসকে কর সেবার মাস পালন করে আসছে বিগত তিন বছর ধরে। গত বছরও শেষ দিনে এসে কর সেবা এক মাস বাড়ানো হয়েছিল।

এবারের কর সেবার মাস বা জরিমানা ছাড়া রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়ানো হবে কি না- জানতে চাইলে এনবিআরের কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সদস্য শাহীন আক্তার রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও আমরা সে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।”

আগে ব্যবসায়ী মহল থেকেও সময় বাড়ানোর দাবি জানানো হত। এবার তেমন কোনো দাবি আসেনি বলে জানান শাহীন।

কর সেবার সময় বাড়ানোর দাবি করেছেন কি না- জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, তারা তা করবেন না।

“কর বা রিটার্ণ দাখিল করার মতো যোগ্য মানুষগুলো জানে যে তার রিটার্ন দাখিল করতে হবে। সুতরাং তার উচিৎ সময় মতো কর এবং রিটার্ন দাখিল করা।”

তিনি বলেন, “প্রতিবছর সরকার কর মাস পালন করবে আর প্রতিবছর মেয়াদ বাড়াবে, এটা আমরা সমর্থন করি না। তাই সরকার এবার মেয়াদ না বাড়ালে জরিমানা দিতে হবে এবং এতে সচেতনতা বাড়বে বলে আমি মনে করি।”

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে আয়কর বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করায় চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই আয়কর বিবরণি দাখিল ৩ লাখ ৩৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে; যেখানে গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মাত্র এক লাখ জমা পড়েছিল।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ লাখ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করে। এনবিআর কর্মকর্তাদের ধারণা, চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সংখ্যাটি ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বর্তমানে নিবন্ধিত টিআইএনধারী সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ।

এর মধ্যে দেশে প্রথম বারের মতো অনলাইনে রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা এক লাখ অতিক্রম করেছে বলে এনবিআর জানিয়েছে। 

চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে আয়কর খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ শতাংশ বা ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার আয়কর আহরণের লক্ষ্য নিয়েছে।

গত অর্থবছর দেশে প্রথমবারের মতো ৩ লক্ষাধিক রাজস্ব আহরণ করে। তাতে আয়কর খাত থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা আহরণ করা সম্ভব হয়েছিল।