প্রকল্প পরিচালকের পুল গঠনের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

চলমান প্রকল্প দ্রুত শেষ করে নতুন প্রকল্প নেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছেন সরকারপ্রধান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2024, 01:47 PM
Updated : 24 Jan 2024, 01:47 PM

মানসম্মত উন্নয়ন কার্যক্রম নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার প্রবণতা ও ব্যয়বৃদ্ধি এড়াতে দক্ষ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে প্রকল্প পরিচালকদের একটি পুল গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

একই সঙ্গে ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনাও এসেছে সরকারপ্রধানের কাছ থেকে। 

বুধবার ঢাকার শেরে বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকে এসব নির্দেশনা আসে। নয় বছর পর কমিশনের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিশনের চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করেন। 

বৈঠক শেষে নতুন পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম সাংবাদিকদের কাছে সরকারপ্রধানের নির্দেশনার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বৈঠকে বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পে বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি মনিটরিং কমিটি গঠনে নির্দেশনাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। 

নতুন সরকারে পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর পরিকল্পনা কমিশনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে আব্দুস সালাম বলেন, “বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মানসম্পন্ন করতে হলে প্রকল্পগুলোও মানসম্পন্ন উপায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।” 

বৈঠকে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে এ দুই খাতকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশও সরকারপ্রধান দিয়েছেন বলে জানান আব্দুস সালাম। 

তিনি বলেন, “বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যাতে আমরা আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারি সেজন্য আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।” 

টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের শুরুর দিকেই অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সরকারপ্রধান চলমান প্রকল্প দ্রুত শেষ করে নতুন প্রকল্প নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে বাসসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। 

৯ বছর পর অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিশনের এ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেগুলোর খরচ কম হবে সেগুলো আমাদের দ্রুত শেষ করতে হবে, কারণ, আমি মনে করি, যত তাড়াতাড়ি আমরা সেগুলো শেষ করতে পারবো তত বেশি সুবিধা পাব।” 

তিনি বলেন, “আমরা একটা প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর এর ফলাফল পাই, তারপর আরেকটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করি। 

“আপনাদের অনুরোধ করবো, এখন সব থেকে বেশি যেটা দরকার, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেটা আমাদের বেছে নিতে হবে। এগুলো চিহ্নিত করতে হবে, কোন প্রকল্পগুলো সামান্য কিছু টাকা দিলেই আমরা শেষ করে ফেলতে পারব। প্রকল্পগুলো যত দ্রুত শেষ করে ফেলা যায় ততই ভালো। কারণ, একটি প্রকল্প শেষ হলে তার ফলাফল আসে। আমরা লাভবান হই এবং নতুন প্রকল্প নিতে পারি।” 

তিনি বলেন, “কাজেই এখানে দীর্ঘসূত্রিতা যেন না হয়, বার বার যেন প্রকল্প সম্পন্ন দেরি না হয়- সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লক্ষ্য রাখতে হবে।” 

বৈঠকের পর বিফ্রিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশন দক্ষ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে অভিজ্ঞ, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি ‘প্রকল্প পরিচালক পুল’ গঠনের প্রস্তাব বৈঠকে তুলে ধরা হয়। এটি গঠন করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। 

“এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প পরিচালক পুল গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।” 

আব্দুস সালাম বলেন, “আমাদের বিভিন্ন সেক্টরে প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত অনেক বিশেষজ্ঞ রয়েছে। তাদের সমন্বয়ে এই পুল গঠন করা যায় কি না আমরা চিন্তা করে দেখছি।” 

এছাড়া বৈঠকে প্রকল্প পরিচালকদের জন্য আলাদা পদ সৃষ্টি করা যায় কি না সেটিও চিন্তাভাবনা করার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী। 

বাসস জানায়, এ প্রসঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেছেন, “প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেকগুলো প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে কিন্তু সেটা করার কোনো সুযোগ নেই। সেটা কিন্তু হতে দেওয়া যাবে না। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়কে সেভাবে নির্দেশ দেওয়া হবে।” 

তিনি প্রকল্প পরিচালকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। কারণ, অনেক সময় দেখা যায় অনেককে প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় যারা কাজটা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেন না বা মনযোগী হন না। 

সংবাদ সম্মেলনে আব্দুস সালাম বলেন, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শনের জন্য দুই মাস পর পর বৈঠক করবে। 

এতে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের অগ্রগতি বাড়বে এবং যথাসময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। 

ঋণ নেওয়ার আগে পরিশোধের পরিমাণ হিসাব করতে হবে 

বাসস জানায়, বৈঠকে বিদেশি ঋণ নেওয়ার প্রসঙ্গে সতর্ক থাকার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। 

তিনি বলেন, “নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে আমি আবারও বলব অহেতুক একটা প্রস্তাব আসল বড় আকারের, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ না করে প্রতিটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে এটাই মাথায় রাখতে হবে-সেখানে আমাদের কী পরিমাণ টাকা ব্যয় হবে, আমরা কী পরিমাণ ঋণ নিচ্ছি এবং সুদসহ কী পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হবে এবং সেটা করার মতো আমাদের সক্ষমতা আছে কি না এসব যাচাই বাছাই করা একান্তভাবে দরকার।”

শেখ হাসিনা বলেন, “আমি যখন তখন যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ করি না। আগে চিন্তা করে দেখি কোনটা দেশের কাজে লাগবে আর কোনটা লাগবে না। এর থেকে মানুষ কতটুকু পাবে।” 

তিনি বলেন, “অযথা টাকা ধার করা নয়, কারণ, যা সুদসহ আমাকেই পরিশোধ করতে হয়। তাই এই বোঝা যাতে আমাদের কাঁধে না পড়ে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। পাশাপাশি যে প্রকল্প আমরা নেব সেটা আমরা ওই কাজের বা ওই এলাকার জন্য কার্যকর কি না এবং এর থেকে সাধারণ মানুষ কী পরিমাণ লাভবান হবে সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এছাড়া অর্থনীতিতেও কেমন গতি সঞ্চার হবে তাও দেখতে হবে।” 

‘পাঁচ বছর টাইম ইজ টু শর্ট’ মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, “কাজেই পাঁচ বছর আমি কাজ করে যাব দেশের জন্য। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছি। সেটা মাথায় রেখেই আমাদের কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করতে হবে। সরকার গঠন করার পরে দ্রুত আমরা বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছি কারণ, নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।” 

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিত কর্মকার বলেন, বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে দেশে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চলমান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে পরিকল্পনা অনুযায়ী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয় না। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। 

ওই প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলনে, চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে এডিপির মোট বরাদ্দের ১১ দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব থাকলেও এ বছর দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ। শিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি খাতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনায় থাকলেও বাস্তবে দেওয়া হয়েছে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব থাকলেও এডিপিতে প্রকৃত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। 

বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের বিকল্প চেয়ারপারসন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ সংশ্লিষ্ট সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন।