জ্বালানি তেল: দাম বৃদ্ধি এড়ানো যেত, কমানোর দাবি সিপিডির

“অব্যবস্থাপনা, দুর্বলতা ও অপচয় চিহ্নিত করে বাড়তি অর্থ সেখান থেকেও বের করা সম্ভব ছিল,” দাবি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2022, 01:02 PM
Updated : 10 August 2022, 01:02 PM

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের ‘চরম চাপে’ থাকার মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো ‘সম্পূর্ণ অযৌক্তিক’ মন্তব্য করে সাধারণের স্বার্থে মূল্য সমন্বয় করে তা কমানোর দাবি জানিয়েছে সিপিডি।

এ সময়ে মূল্য বাড়ানোর পদক্ষেপ ‘এড়ানো যেত’ মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, জ্বালানি তেলের ওপর নানা ধরনের কর জনগণের ওপর চাপিয়েও সরকার আয় করছে। এতে শুধু ডিজেল এবং করোসিনের ওপর থেকে প্রায় ৩৪ শতাংশ কর নিচ্ছে সরকার।

বুধবার ঢাকায় ধানমণ্ডিতে নিজস্ব কার্যালয়ে ‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি; এখন এড়ানো যেত কি?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, এ খাতের অব্যবস্থাপনা, দুর্বলতা ও অপচয় চিহ্নিত করে বাড়তি অর্থ সেখান থেকেও বের করা সম্ভব ছিল।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই অসময়ে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে ‘চরম বিপদে’ ফেলে দেওয়া এবং রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সিপিডির মতে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসানের মুখে পড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া কিংবা প্রতিবেশী দেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোর ‘কোনটারই ভিত্তি নেই’।

একইসঙ্গে গত ছয় বছরে বিপিসি যে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে সেই টাকার হিসাবেও ‘কোনো স্বচ্ছতা নেই’ বলে অভিযোগ এনেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।

আলোচনায় স্বাগত বক্তব্যে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, জ্বালানি তেলে বিপিসির লোকসান হওয়ায় মূল্য বাড়াতে হয়েছে বলে দাবি করা হলেও এর কোনও ‘ভিত্তি নেই’।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসি ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে লাভ করেছে আরও ১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

এর বাইরেও জ্বালানি তেল আমদানি থেকে বিপুল আয়ের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “জ্বালানি তেলের ওপর থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম কর, দুই ধরনের আয়করসহ নানা ধরনের কর জনগণের ওপর চাপিয়েও সরকার আয় করছে। এতে শুধুমাত্র ডিজেল এবং কেরোসিনের ওপর থেকে প্রায় ৩৪ শতাংশ কর নিচ্ছে সরকার।

“উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই জ্বালানির মাধ্যমে ভোক্তারা করের বোঝা বহন করে থাকেন।”

ফাহমিদা বলেন, সরকার আরেকটি যুক্তি দিচ্ছে যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। কিন্তু হিসাব করে দেখা যাচ্ছে কোভিড ১৯ ও রাশিয়া –ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য কিছুটা বাড়লেও সেগুলো কিন্তু ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী হচ্ছে।

এমন প্রবণতার মধ্যে মূল্য বাড়ানোর কোনও যুক্তি নেই বলে মনে করেন তিনি।

অন্য কোনো দেশেও ‘এত বেশি দাম নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশে তেল চোরাচালান হতে পারে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটির জন্য মূল্য বাড়ানো নয় বরং মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

আলোচনায় সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের অভিযোগ, “যে সার্কুলার দিয়ে এই দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে যে সমস্ত তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের কাছে এসমস্ত তথ্য উপাত্ত ভ্রমাত্মক মনে হচ্ছে। এসব তথ্য উপাত্ত অনেক ক্ষেত্রেই ত্রুটিপূর্ণ।“

এগুলোর পরিষ্কার চিত্র আসা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, “বিপিসির পূর্ণ হিসাবের একটি খতিয়ান আমাদের জানা দরকার।“

তিনি বলেন, “গত ছয় বছরে বিপিসি যে ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে সেখান থেকে সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। তাহলে বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়।

“বলা হয়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।“

বিপিসির বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরে বিনিয়োগের অর্থের সঙ্গে এর বিশাল ফারাকের তথ্য দিয়ে তিনি প্রশ্ন রাখেন, বাকি টাকাগুলো কোথায় গেল?

অর্থনীতির এই গবেষক বলেন, “তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে বিপিসির কাছে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকার পরও সরকার কেন লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে তেলের মূল্য বৃদ্ধির ঘটনাটিতে গেল?

“এটি মোটেই আমাদের কাছে বোধগম্য না।”

বিপিসি কিভাবে অর্থের হিসাব রাখছে- সেই প্রশ্ন তুলে তিনি ‘পরিষ্কার হিসাব জনগণের কাছে আসা দরকার’ বলে মন্তব্য করেন।

“তার ভিত্তিতেই বোঝা উচিত ভোক্তা বা জনগণের ওপর যে অন্যায্য চাপ আসছে সেটা কতটুকু যৌক্তিক,” যোগ করেন তিনি।

বিপিসি পূর্ণাঙ্গ হিসাব করলে সম্প্রতি কিছু লোকসান হলেও সেটি সমন্বয় করার সক্ষমতা ছিল বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, “ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা মানে শুধু মূল্য বৃদ্ধি নয়। অব্যবস্থাপনা, দুর্বলতা ও অপচয় চিহ্নিত করে বাড়তি অর্থ সেখান থেকে বের করা সম্ভব ছিল।“

আলোচনায় সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, “জ্বালানি তেলের এই মূল্য বৃদ্ধি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় চরম আঘাত করতে পারে। এমনিতেই এবার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে আমন ও আউশ চাষে কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

“তারওপর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বোরো মৌসুমে কৃষকরা অনীহা দেখালে দেশে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।“

আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, বিকেএমইএ সহ সভাপতি ফজলে শামীন এহসান, যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে পুনর্বিবেচনা করে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়।

>> প্রান্তিক মানুষের জন্য খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির পরিমাণ বাড়ানো।

>> রেশন কার্ডের সংখ্যা বাড়ানো।

>> সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো।

>> ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি রোধে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা।

>> ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া।

>> বাজার মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের মূল্য নির্ধারণ।

>> অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে তেলের মূল্য নির্ধারণ করা।