সঙ্কটে পড়ে জ্বালানি তেলের দাম যতটা সরকার বাড়িয়েছে, তাতে অর্থনীতিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে মূল্য স্থিতিশীল রাখার একটি পদ্ধতি ঠিক করার সুপারিশ এসেছে এক আলোচনা সভায়।
বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানোর পর ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও আলোচনার মধ্যে রোববার ওই সভায় এ সুপারিশ করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম।
বাংলাদেশ এনার্জি সোসাইটি আয়োজিত ভার্চুয়াল এই আলোচনায় তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মূল্য কাঠামোর এমন একটি নীতিমালা করা উচিৎ যাতে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামার সময়ও দেশের বাজারের জ্বালানির দাম অপরিবর্তিত থাকে।
বুয়েটের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক তামিম ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তখনকার অবস্থা তুলে ধরে তামিম বলেন, “২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় তেলের মূল্য (বিশ্ববাজারে) ১৪৮ ডলারে উঠে গিয়েছিল। তবে সেই সময়ের পরিস্থিতি আর আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেই সময় আমরা মূলত ভর্তুকি দিতাম তেলে। গ্যাস বা বিদ্যুতে ভর্তুকি ছিল না বললেই চলে। এখন সেটা বদলে গেছে।”
জ্বালানি তেলের জন্য বাংলাদেশ আমদানির উপরেই নির্ভরশীল। এই খাতে ভর্তুকি দিয়ে দাম দেশের বাজারে কমিয়ে রাখে সরকার। ইউক্রেইন যুদ্ধের পর জ্বালানির বাজার চড়ে যাওয়ায় কারণে ভর্তুকির চাপ এড়াতে এবার দাম বাড়ানো হয়েছে বলে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে।
এবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রোলের দাম ৫১.১৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটারের দাম হয়েছে ১৩০ টাকা। আর অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১.৬৮ শতাংশ, প্রতি লিটার কিনতে গুনতে হবে ১৩৫ টাকা।
এই দাম বৃদ্ধির পর গণপরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে বলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জ্বালানি তেলের উপর অর্থনীতির অনেকটা নির্ভর করে বলে বিশ্ব বাজারে দাম বাড়া-কমার সঙ্গে স্থানীয় বাজারে দাম সমন্বয়ের মতো অবস্থায় বাংলাদেশ এখনও পৌঁছেনি বলে মনে করেন তামিম।
তিনি বলেন, “জ্বালানিতে ভর্তুকি দিয়েই এখন পযন্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামোটা বাংলাদেশে চলছে। সেখানে যদি আমরা ভ্যারিয়েবল মূল্যের দিকে যেতে চাই.. তাই এই ট্রানজিশনটা ধীরে ধীরে করতে হবে। এত দ্রুততার সাথে করলে সমস্যা।”
তাই দেশের মধ্যে দাম স্থিতিশীল রাখার একটা নীতিমালা প্রস্তুত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যদি মূল্যটাকে স্থিতিশীল অবস্থায় রাখতে চাই, এ্কটা মূল্য ঠিক করে এবং পুরো অর্থনীতিকে যদি স্থিতি অবস্থায় রাখতে চাই, তাহলে এই জ্বালানির ওঠানামার সময় সরকারের দাম কমানো বাড়ানোর কথাটা আর আসবে না।
“যখন দাম কমবে সরকার তখন মুনাফা করবে, গত পাঁচ/সাত বছরে যেটা করেছে। সেই টাকা যদি ইয়ারমার্ক করে রাখা হয় যে, সামনের উচ্চমূল্যের সময় এই টাকাটা দিয়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখা হবে। তাহলে কিন্তু আজকে আমাদের সমস্যাটা হত না, সেই নীতিটা যদি গ্রহণ করা হয়।”
কোভিড মহামারীর সময় জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে নেমে আসায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন দেশের বাজারে দাম তেমন না কমিয়ে বেশ লাভের মুখ দেখেছিল। তার আগ থেকেই তেল বিক্রি করে লাভ করছিল বিপিসি।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত সাত অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে মুনাফা করে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর দ্রুতই চিত্র পাল্টে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে ডিসেম্বরে যেখানে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি দর ছিল ৬৫ ডলার, তা বাড়তে বাড়তে মার্চে ১২৪ ডলারে উঠে যায়। এখন তা ১০০ ডলারের নিচে নামলেও বিপিসি আবার ফিরেছে লোকসানে।
তামিম বলেন, “তেলের দামটা সাইক্লিক। যখন উচ্চমূল্য হয় তখন ‘ডিমান্ড ডেসট্রাকশন’ হয়। মুনাফার জন্য সরবরাহ বেড়ে যায়। তখনই আবার বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ চলে আসে। তার প্রেক্ষিতে দামও কমতে থাকে। কমে গিয়ে আবার একটা স্থবিরতায় এসে অনেকদিন কম মূল্যে চলতে থাকে।
“আমার মনে হয়, ভালো নীতিমালার মাধ্যমে যদি আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করি, অর্থনীতির যে স্ট্রাকচার, সেখানে তেলের দাম ওঠানামা করবে, তার প্রেক্ষিতে অন্যান্য মূল্য কীভাবে হবে, সেটা আমাদের স্থির করতে হবে। আমি মনে করি, এখনকার পরিস্থিতিতে একটি স্থিতি অবস্থায় জ্বালানি রাখার যে নীতি, সেটা রাখাই ভালো। এখন যেমন দামটা বাড়ানো হয়েছে এটা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আরেকটু নিচে নামিয়ে ভবিষ্যতে যদি আমরা মুনাফা করি, তাহলে সেই টাকা দিয়ে ভবিষ্যতের উচ্চমূল্য সমন্বয় করব।”
“এটা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের মতো দেশে। যেখানে পরিবহনখাতে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। সেখানে জ্বালানি মূল্য ওঠানামা করলে সেটা কীভাবে প্রভাবিত করবে দেখতে হবে,” বলেন তিনি।
এই আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিস সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বক্তব্য রাখেন। সঞ্চালনায় ছিলেন এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের সম্পাদক মোল্লাহ এম আমজাদ।
সভায় তেল, গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ খন্দকার সালেক সুফি দেশের অভ্যন্তরের তেল, গ্যাস অনুসন্ধান করাসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দেন।
তিনি মনে করেন, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।
দেশের মোট গ্যাসের ৪৬ শতাংশ বিদ্যুতে, ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিল্পে, ১৫ দশমিক ২ শত্ংশ ক্যাপটিভে এবং ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত হয়।
সালেক সুফি বলেন, “ক্যাপটিভে ও ডোমেস্টিকে গ্যাস সরবরাহ একটা পরিকল্পনা করে বন্ধ করার সুযোগ আছে। তাহলে এখানে যে সাশ্রয়টা হবে পুরোটাই যেন আমরা শিল্পে ব্যবহার করতে পারি।”
বাংলাদেশে মোট ২৮টি গ্যাস ফিল্ড রয়েছে। এরমধ্যে ২০টিতে গ্যাস উত্তোলন করা হয়। আর ভুমি ও সাগরে মোট অনুসন্ধান ব্লক রয়েছে ৪৮টি। এর মধ্যে ভুমিতে ২২টি, ২৬টি সাগরে।
সালেক সুফি বলেন, “সাগরের এগুলো অনেক সম্ভাবনাময়। আন্তর্জাতিক কোম্পানিকে অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করা যাবে কি না, কিন্তু এটা আমাদের শুরু করা উচিৎ।
“আগে যখন নিজস্ব গ্যাসই আমাদের শক্তি জোগাতো, সেখানে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। বহুদিন ধরে আমরা রিজার্ভের স্টাডি করিনি। যতটা এক্সপ্লোরেশন করার ছিল, ততটা না করায় প্রুভেন রিজার্ভ কমে আসছে। এদিকে চাহিদা বেড়ে গেছে। সমস্ত সমুদ্র এলাকা অক্ষত রয়ে গেছে। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে অনুসন্ধান করলে আমরা আরও অনেক গ্যাস পাব।”
বাপেক্সকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকেও (আওসি) প্রণোদনা দিয়ে নিয়ে আসা যায় কি না, তা ভাবার পরামর্শ দেন তিনি।
সালেক সুফী সহজলভ্য ও সস্তা জ্বালানির গ্রহণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফুয়েল এফিসিয়েন্সি বাড়ানো, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রতিযোগী ও অভিজ্ঞ পেশাদারদের দিয়ে পেট্রোবাংলা ও অন্যান্য কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন, সরাসরি না হলেও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশি মুদ্রায় রাশিয়া ও ইরানের তেল-গ্যাস নেওয়ার সুযোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্সকে শক্তিশালী করার বিরোধিতা করে ম তামিম বলেন, “গত ২০ বছর দেখেছি, বাপেক্স ব্যর্থ হয়েছে। হঠাৎ করে বাপেক্সকে কিছু করা বা বিশ্বমানের করা একটা অসম্ভব কাজ। বরং তাদের ম্যানেজমেন্ট স্কিল বাড়ানো দরকার, যাতে বিদেশি কোম্পানিদের সাথে তারা কাজ করতে পারে।”
খুঁজলেই তেল গ্যাস পাওয়া যাবে- এমন আশাকে ‘কেতাবি কথা’ বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী।
তিনি বলেন, “ড্রিলিং করলেই তেল-গ্যাস আবিস্কৃত হওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে- এগুলা কেতাবি কথা। ইউএসজিএস বলল, সাথে সাথে বাংলাদেশ গ্যাসে ভাসছে এই কথাটা আসল, সাথে সাথে রপ্তানি করার কথা আসল। এইগুলো মিলিয়ে যদি বিশ্লেষণ করেন, তাহলে দেখবেন, ফুয়েলের জিও-পলিটিক্স-এর সাখে জড়িত আছে।”
তিনি বলেন, “পেট্রোলের দাম আমেরিকাতেও ৫ ডলার গ্যালন। ফসিলস ফুয়েলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। কুয়েতে ১০০ টাকার কাছাকাছি, ওঠানামা করে। সেখানে আমরা তো… বিদেশ থেকে এনে আমাদের চালাতে হয়। সেখানে এ কষ্ট আমরা তো ডেকে আনিনি। পৃথিবীর জনগণের ভাগ্য নিয়ে যারা খেলতেছে, তারাই এটা এনেছে। সেই পশ্চিমা দেশ, তারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেইসাথে আমাদের মতো উন্নয়নশী দেশ, তাদেরকেও বিরাট বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, “আমরা যদি সারাদেশে সোলার ইরিগেশন করতে পারি, তাহলে প্রায় ৫ লাট টন ডিজেল আমদানি কমাতে পারবো। জাতীয় পর্যায়ে একটা সোলার ইরিগেশন গ্রোগ্রাম নিতে পারি।”
দেশে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ ডিজেলচালিত সেচ পাম্প রয়েছে। সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে এসব পাম্প চালানোর চিন্তাভাবনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই।
তৌফিক ইলাহী বলেন, “বিদ্যুৎ দিয়ে রান্না করাটাও প্রতিযোগিতামূলক (সাশ্রয়ী)। দিনে রান্না করা গেলে দিনে লোড বাড়বে এবং সিস্টেমের ইফিসিয়েন্সি বেড়ে যাবে। পরিস্কার জ্বালানির দিকে যেতে গেলে উত্তর হল নিউক্লিয়ার।”
সাবেক সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, “জ্বালানি নিরাপত্তা বিশ্বব্যাপী হুমকির মূখে, কেন? ২০২০ থেকে যে চলমান কোভিড, তা শেষ দিকে এসেছে। সাধারণত সবসময়ই দেখা গেছে, ঐতিহাসিকভাবেই অর্থনীতির শ্লথের পরে যখন গতি ফিরে আসতে থাকে, তখন ব্যাপক বিদ্যুতের চাহিদা হয়, যেটি এখন শুরু হয়েছে।”
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের জন্য তেলের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের উপর ব্যাপক নির্ভরশীলতাও সঙ্কটের কারণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।