ওভার ইনভয়েসিং ৯০ শতাংশ কমানোর দাবি গভর্নরের

পকেটে করে যে ডলার পাচার হয়, সেটা মোট পাচারের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ। মূলত পাচার হয় ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে। ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে টাকাগুলো পাচার হয়ে যায়।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2024, 11:17 AM
Updated : 11 March 2024, 11:17 AM

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলছেন, দেশ থেকে বেশিরভাগ টাকা পাচার হয় ‘ব্যবসায়িক চ্যানেলে’; তবে ‘ওভার ইনভয়েসিংয়ের’ মাধ্যমে টাকা পাচার ৯০ শতাংশ রোধ করতে পেরেছেন তারা। 

সোমবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তাদের 'স্মার্ট ইনভেস্টিগেশন মডেল ফর সিআইডি অফিসারস' শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিআইডি র অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। 

গভর্নর বলেন, “পকেটে করে যে ডলার পাচার হয়, সেটা মোট পাচারের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ। মূলত পাচার হয় ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে। ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে টাকাগুলো পাচার হয়ে যায়। ধরেন একটা পণ্যের দাম ১০০ ডলার, সেটার জন্য কেউ দেড়শো ডলারের এলসি করল। বাকি ৫০ ডলার পাচার হয়ে গেল।  

“আবার যারা রপ্তানিকারক, তারাও কিন্তু রপ্তানির টাকা দেশে না নিয়ে এসে সেখানে রেখে দেন। এটাও মানি লন্ডারিং।”

পণ্য আমদানিতে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ মানে হল অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক চ্যানেলেই বিদেশে পাচার হচ্ছে। পণ্যের মূল্যের নামে পাঠানো অতিরিক্ত অর্থ পরে বিদেশে আমদানিকারকের পক্ষে কেউ গ্রহণ করছে। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে আসছে।

‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ ব্যবহার করা হয় পণ্য রপ্তানিতে। পণ্য রপ্তানির সময়ে যে পরিমাণ অর্থ কম দেখানো হয়, তা বিদেশে রপ্তানিকারকের পক্ষে বুঝে নেওয়া হয়। এভাবেও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হয়ে আসছে।

আমদানি-রপ্তানিতে এমন ‘মিস ইনভয়েসিং’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বড় অংকের অর্থ পাচারের তথ্য উঠে আসছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণাতেও।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক তথ্যে দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মিস ইনভয়েসিং বা অস্বচ্ছ লেনদেনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৮০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টি বেশ আগে থেকে বলে আসছে। ডলারের সাম্প্রতিক সংকটের মধ্যে দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টিও নতুন করে আলোচনায় আসছে।

২০২২ সালের শেষ দিকে মানি এক্সচেঞ্জগুলো ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে যে সংকট তৈরি করেছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে রউফ তালুকদার বলেন, “অবশ্য মানি এক্সচেঞ্জরা যে ডলার খুচরা ট্রেড করে, এটা খুব ইমপরট্যান্ট না। সারা বছর তারা ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার কেনাবেচা করে। আর আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেমে টোটাল ট্রানজেকশন হয় ২৭০ বিলিয়ন ডলার। 

“ব্যাংকিং সিস্টেমের কাছে মানি এক্সচেঞ্জ এর ব্যবসা কিছুই না। কিন্তু এটার একটা নুইসেন্স ভ্যালু আছে। যখন তারা ডলারের দাম বাড়িয়ে দেয়, তখন আমাদের প্রবাসীরা বেশি দাম পাওয়ার কথা চিন্তা করে ডলার ধরে রাখে। সেজন্য মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে থামানোর দরকার ছিল। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক, সিআইডি, এনএসআই একসঙ্গে কাজ করে এটাকে কিন্তু আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি।” 

গভর্নর বলেন, “এখন মানি এক্সচেঞ্জগুলো কত টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে এটা নিয়ে আর কোন আলোচনা নেই। পত্রপত্রিকাগুলো নিউজও করছে না। যখন নিউজ হয় না, তখন বুঝতে হবে সেটা ভালো অবস্থায় আছে।” 

গত কয়েক মাস ধরে বাজারে ডলারের সরবরাহ এবং রেমিটেন্স বাড়ার তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান বলেন, “আমাদের এক্সপোর্ট বাড়ছে, ইমপোর্ট কন্ট্রোল করেছি। এই যে ওভারে ইনভয়েসিং হত...। আমরা ব্যাংকগুলোকে বলে দিয়েছি, এল সি খোলার আগে দেখে নিতে যে জিনিসটা আনা হচ্ছে তার দাম ঠিক আছে কিনা। 

“আগে কোনোদিন ব্যাংকের শাখা পর্যায়ে তারা এই দামের বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাত না, ক্রসচেকও করত না। গত দুই বছরে আমরা এই কালচারে চেইঞ্জ আনতে পেরেছি যে এলসি করার আগে এ বিষয়গুলো দেখতে হবে।”  

তবে ওভার ইনভয়েসিং শতভাগ বন্ধ করা সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “৯০ শতাংশ বন্ধ করতে পারলেই আমরা খুশি। এখন আমরা বলতে পারি, ওভার ইনভয়েসিং ৯০ শতাংশ বন্ধ হয়েছে। এখন ব্যাংক অত সহজে এলসি করে না। এলসি করার আগে প্রাইসটা চেক করে, আমরা কতগুলো মেকানিজম করে দিয়েছি।”

আট বছর আগে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির প্রসঙ্গও গভর্নরের বক্তৃতায় আসে। প্রযুক্তিভিত্তিক অপরাধ দমনে সিআইডিকে আরো দক্ষ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। 

আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, "২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ১০১ মিলিয়ন ডলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা নিয়ে গেল, এই পরিমাণ টাকা নগদ চুরি করতে গেলে তাদের আটটি বড় ট্রাক প্রয়োজন হত। অথচ দেখেন তারা হাতের আঙ্গুলে বোতাম টিপে কয়েক ঘণ্টায় টাকাগুলো নিয়ে গেল।" 

অর্থ পাচার প্রতিরোধে হুন্ডি বন্ধের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা অনেক সময় বেশি টাকা পাঠানোর জন্য কাউকে হয়ত ৫০০ ডলার দিলেন। তিনি ওই ৫০০ ডলার রেখে দেশে তার আত্মীয়কে এখান থেকে টাকা দিয়ে দিলেন। এরকম সন্দেহজনক হুন্ডির ১০০ থেকে ২০০ অ্যাকাউন্ট আমরা প্রতিদিন বন্ধ করে দিচ্ছি।” 

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, “আগে শুধু মাদক ব্যবহারকারী ও পাচারকারীদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন মাদকের গডফাদারদের গ্রেপ্তার করার ধারা চালু করেছে সিআইডি। তাদের সম্পত্তি ক্রোক করা হচ্ছে।”  

বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “২০২৭ সাল নাগাদ ৭০ শতাংশ ক্যাশলেস লেনদেনের দিকে যাচ্ছে দেশ। সেই ক্ষেত্রে এই ধরনের অপরাধ দমনে সিআইডির কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।” 

পুরনো খবর...

এস আলম গ্রুপের অর্থপাচার নিয়ে তদন্ত চলছে: বিএফআইইউ প্রধান

ব্যাংকের টাকা লোপাট: কে কত নিয়েছে জানাল সিপিডি

‘আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে’ অর্থ পাচার দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক

বৈধ অর্থে কেন পাচারের দায় থাকবে প্রবাসীদের?

বিদেশে অর্থ পাচার, বাড়ি: অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য দাবি

আশ্চর্যজনক ওভার ইনভয়েসিং, ১০০ এলসি বন্ধ করেছি: গভর্নর