বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে চলতি বছরের মধ্যেই জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) পৌঁছে যাবে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।
Published : 20 Jun 2013, 06:09 AM
আন্তর্জাতিক এ ঋণদাতা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে ছিল। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালে তা কমিয়ে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
তবে গত এক দশকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্ব ব্যাংক মনে করছে, নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে বাংলাদেশ।
‘বাংলাদেশ পোভার্টি অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ধারাবাহিকভাবে কমে এসেছে। ২০০০ সালে যেখানে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৫ সালে তা কমে সাড়ে ৫ কোটি এবং ২০১০ সালে তা আরো কমে ৪ কোটি ৭০ লাখে নেমে এসেছে।
“সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এ দুটো লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে।”
হালের তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০১৫ সাল নাগাদ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ২ শতাংশ পয়েন্ট কমে আসবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের হার তখন দাঁড়াবে ২৬ শতাংশের কাছাকাছি।
“কোনো খারাপ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে যদি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হারেও প্রবৃদ্ধি হয়, তারপরও ২০১৫ সালে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ শতাংশ পয়েন্ট কমে আসবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। “
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ অতিদরিদ্র বা হতদরিদ্র।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালে বাংলাদেশের ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে ছিল। তখন হতদরিদ্রের হার ছিল ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
এই হিসাবে ২০০০ থেকে এক দশকে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ পয়েন্ট হারে দারিদ্র্য কমেছে।
এর মধ্যে ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কমেছে গড়ে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কমেছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, প্রধানত দুটি কারণে বাংলাদেশ এই সফলতা অর্জন করেছে। এর একটি হলো- মজুরি বৃদ্ধি। সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই শ্রমের মজুরি বেড়েছে গত এক দশকে।
আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে এসে ‘নির্ভরশীল লোকের’ সংখ্যা কমে যাওয়াও এই সাফল্যের একটি কারণ।
“আগে যে পরিবার মাত্র একজন লোকের ওপর নির্ভরশীল ছিল; সেই পরিবারে এখন উপার্জনক্ষম লোকের সংখ্যা একাধিক হয়েছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দশ বছরে (২০০০-২০১০) প্রতি বছর ১৮ লাখ অতিদরিদ্র (গতদরিদ্র) মানুষ তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে ওই সীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর দারিদ্র্য সীমা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ১৬ লাখ মানুষ।
এই এক দশকে মূল ধারার বাইরে বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে আয় (কৃষিকাজ, রিকশা-ভ্যান চালনা ইত্যাদি পেশায়) প্রতি বছর দশ শতাংশ হারে বেড়েছে বলে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ২০০০ সালে দেশের মোট দরিদ্র মানুষের মধ্যে দশ শতাংশ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। দশ বছর পর ২০১০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়।
২০০০ সালে দেশের কোনো দরিদ্র মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহারের সামর্থ্য রাখতো না। ২০১০ সালের হিসাবে দেশের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ দরিদ্র মানুষ মোবাইল ফোনের সুবিধা পাচ্ছে।
২০০০ সালে ১ দশমিক ৮ শতাংশ দরিদ্র মানুষ টেলিভিশন দেখার সুযোগ পেত। দশ বছর পর তা বেড়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ হয়।
নির্ধারিত সময়ের আগেই লক্ষ্য অর্জন প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির কারণেই এটা সম্ভব হতে চলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা গড়ে ৬ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি। এই প্রবৃদ্ধিই দারিদ্র দূর করতে অবদান রাখছে।”
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সোশ্যাল প্রোটেকশন টিমের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ইফাত শরিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্রের হার কমছে। এমনকি বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকটের মধ্যেও এই ধারা অব্যাহত ছিল।
“২০০৭-০৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় সবাই আশঙ্কা করেছিলেন, বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠির সংখ্যা বেড়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। আগের ধারাবাহিকতায় দারিদ্যের হার কমেছে।”
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় ধরনের সাফল্য দেখিয়েছে বলেই মনে করেন ইফাত।
আর এক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বড় অবদান রেখেছে বলে মনে করেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের উন্নয়ন গবেষণা গ্রুপের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ডেন এম জোলিফি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যদিও বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ এই কর্মসূচির সুবিধা এখনও পায় না; তারপরও এর অবদান গুরুত্বপূর্ণ।”
সব গরিব মানুষ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির সুবিধা পেলে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে আরও বেশি সফলতা অর্জন করতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ডেন জোলিফি বলেন, “আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে বিবিএস তথ্য-উপাত্ত দিয়ে থাকে। তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের কোনো প্রশ্ন নেই।
ইফাত শরিফ ও ডেন জোলিফি বিশ্ব ব্যাংকের এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন।