বাজেটে ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ ভাবনায় বদল চান বিনায়ক সেন

বৈশ্বিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে থাকলেও আগামী বাজেটে সীমিত সামর্থ্য ব্যবহারের কৌশল কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।

শেখ আবু তালেবনিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2022, 07:18 PM
Updated : 8 June 2022, 03:17 AM

রাষ্ট্রায়ত্ত এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক মূল্যস্ফীতির প্রভাবকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে সাধারণকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাজেটে অগ্রাধিকার নির্ধারণের তাগিদ দিয়েছেন। এজন্য বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘ভাবনায় পরিবর্তন’ দেখতে চেয়েছেন তিনি।

কোভিড মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার সময়কালে আন্তর্জাতিক পণ্য বাজারে নতুন করে অস্থিরতা বয়ে আনে রাশিয়া ও ইউক্রেইন যুদ্ধ। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদে।

নতুন বাজেট নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন।

মূল্যস্ফীতির বিষয়টি এখন ‘গরিব ও ধনী শ্রেণিতে বিভক্ত না করে’ সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “কাদেরকে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে বেশি সহায়তা দেওয়া যায়, সেই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে।’’

সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের জন্য একটি সামাজিক কাঠামো নির্ধারণ করে সবাইকে এর আওতায় আনা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, “কোন শ্রেণিকে কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায় ভাবতে হবে। কারও খাদ্য প্রয়োজন আর কারও নীতি সহায়তা।“

নতুন বাজেটে সব ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করে বিনায়ক সেন বলেন, “আগে যে ৫০০ টাকা ছিল এখন কিন্তু ৫০০ টাকা প্রকৃত আয়ে নেই। এটি বাড়াতে হবে।

‘‘প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির খাদ্যের ৫০ শতাংশই চাল। ব্যয়ের বড় অংশই খাদ্যে যায়। মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে মানুষ খাদ্যে কাঁটছাঁট করে। ফলে পুষ্টি গ্রহণ কমে যাবে এ শ্রেণির। তাই তাদের সামাজিক বলয়ের আওতায় আনতে হবে।’’

তৈরি পোশাকসহ শিল্পের ৫৬ লাখ শ্রমিকদের চাল, ডাল, তেলের মত নিত্যপণ্য ভর্তুকি মূল্যে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “তাহলে তারা মূল্যস্ফীতির চাপ সমালাতে পারবে। শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হবে না। শিল্পে উৎপাদন খরচ কিছুটা হলেও সমন্বয় করতে পারবে। শিল্প খাতে স্বস্তি থাকবে।“

আগামী বাজেটে তিনি এসব বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ দেখতে চান।

আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ডলার সংকটসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে জানিয়ে বিনায়ক সেন বলেন, বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মোটা দাগে বললে সাড়ে ১২ শতাংশ হয়েছে। এজন্য আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমিয়ে আনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত মন্তব্য করে তিনি বলেন, টাকার মান কমিয়ে আনায় প্রবাসীরা উৎসাহিত হবেন বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠাতে। আর চাহিদা ও সরবরাহের উপর ডলারের মান নির্ধারণ হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ‘‘২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ‘ম্যানেজড এক্সচেঞ্জ’’ বিনিময় অনুসরণ করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ কিন্তু বাজারের উপর ছেড়ে দিয়েছে। সরকার প্রয়োজনে যে হস্তক্ষেপ করে না, তা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে আবার হস্তক্ষেপ করতে পারে।

‘‘টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার ধরে রাখলে হুন্ডি উৎসাহিত হবে। হুন্ডি হলেও দেশের জন্য কিছুটা ভালো, বিনিয়োগ হবে, কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু সমস্যা যেটা হবে, তা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক তো বৈদেশিক মুদ্রা পেল না। এতে ডলার সংকট রয়ে যাবে। তখন বিনিময় হার আরও বাড়বে। পণ্য আমদানির খরচও বাড়বে।“

এসব কারণে তিনি ডলারের দরকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা বলেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক জায়গাতেই রয়েছে। বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়াটা ভালো। আমার মনে হয় ৯৬-৯৮ টাকার দিকে গিয়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল হবে আপাতত।“

ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং বর্তমান বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার চিত্র বিশ্লেষণ করে বিনায়ক সেন মনে করছেন আগামী ছয় মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এজন্য এসময়কালে সরকারের সতর্ক ও কৌশলী পদক্ষেপের দিকনির্দেশনা আগামী বাজেটে থাকা দরকার।

তিনি বলেন, শঙ্কার কোনো কারণ নেই। এজন্য প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আগামী অর্থবছরের প্রথম দিকেও হয়ত পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে। তখনও প্রবৃদ্ধি হয়ত খুব বেশি হবে না। কিন্তু সময়টি সতর্ক হয়ে পার করতে পারলে পরের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) সুফল বয়ে আনবে।

আগামী বাজেটে ভর্তুকির অর্থ সংগ্রহ ও রাজস্ব বাড়াতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে করের আওতা বাড়ানোর কথা বলেছেন বিআইডিএসের এই মহাপরিচালকও।

তিনি বলেন, ‘‘এই অর্থবছরে আমি বেশি কিছু আশা করবো না। কারণ সবাই মোটামুটি চাপের মধ্যে রয়েছে। আমি জিডিপি প্রবৃদ্ধিই বলছি সাড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ। এরমধ্যে থেকেই কর ও জিডিপি অনুপাত যতটা সম্ভব বাড়াতে হবে।“

আগামী অর্থবছরের মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক না করে ‘মডারেট’ প্রবৃদ্ধিমুখী করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এটি আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগ কর্মসংস্থানের জন্য ভালো হবে।

আগামী বাজেটে অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন প্রস্তাব থাকা প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমি ২০০৫ সালের একটি জরিপে অংশ নিয়েছিলাম ভারতে। সেখানে বের করা হয়, ভারতের সব অঞ্চলই সমৃদ্ধ নয়। কোন কোন অঞ্চল পিছিয়ে পড়ছে...তা দেখার।

“আমাদেরও সব এলাকা সমভাবে উন্নত নয়। তাই এলাকাভিত্তিক বা বিভাগভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।’’

তিনি বলেন, আমাদের বিভাগগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, জমির বিন্যাস, ফসল উৎপাদন, যাতায়াত ব্যবস্থা ও মাটির গুনাগুন ও জনবসতি পৃথক। এমনকি সংস্কৃতি ও জীবন অভ্যাসেও বৈচিত্র রয়েছে।

‘‘সমতলে যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় হাওরে কিন্তু নয়। ঠিক একইভাবে সিলেট, চট্টগ্রাম অঞ্চলের চেয়ে উত্তরের নদীভাঙা বা উপকূলীয় এলাকায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এক নয়। তাদের শিক্ষা গ্রহণের দক্ষতা এক নয়।’’

এলাকাভেদে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, বিদেশগামীতা ভিন্ন ধরনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুরুষ শুন্য হয়ে পড়ছে কোনো এলাকা। সামাজিক অপরাধ ও সীমান্তের অপরাধের ধরনই আলাদা। তা ঢাকা থেকে বোঝা সম্ভব নয়। এটি স্থানীয় প্রশাসনই জানতে পারবে। এটি মাথায় রেখেই উন্নয়ন নীতিমালা করার সময় হয়েছে।

‘‘এজন্য অঞ্চল বুঝে উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় সরকার তথা পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদকে কাজে লাগাতে হবে।’’

বাজেটের মাধ্যমে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের রূপরেখা থাকা দরকার।

বর্তমানে শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নের ধারাকে কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “দ্রুত গতির রেল এক শহরকে আরেক শহরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারে। আমি যদি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, বরিশাল, টাঙ্গাইল থেকে যাতায়াত করতে পারি তাহলে কেন ঢাকায় থাকব?”

দেশের যোগাযোগে গণপরিবহন হিসেবে রেলওয়েকে বেছে নিতে এ খাতের সম্প্রসারিণে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

আরও পড়ুন