কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার সময়কালে ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজার চড়তে থাকায় দেশেও বাড়ছে আমদানি পণ্যের দাম। টানা চার মাস ধরে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। সেটির অভিঘাতে বাড়ছে দেশি পণ্যের দামও।
জাহিদ হোসেন মনে করেন এতে কোনঠাসা হয়ে যেতে পারে দেশের প্রান্তিক মানুষ; তাদের খাদ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে, যা মোকাবিলায় নতুন বাজেটে ভতুর্কিসহ সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানো ও তা বিচক্ষণভাবে ব্যবহারের পদক্ষেপ থাকা দরকার।
এজন্য বাজেট ঘাটতির ‘গতানুগতিক ধারা’ থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমান পরিস্থিতিতে যাতে বাজেট ভূমিকা রাখতে পারে সেরকম পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ তার; যাতে অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখা যায়।
আসন্ন বাজেটের আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে চাহিদা আর যোগানের ভারসাম্যহীনতা।
আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ শেষ মুহূতের হিসাব নিকাশ করে পৌনে সাত লাখ কোটি টাকার বাজেট সাজাচ্ছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, “এখন বহির্বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি বেড়েছে। ওই ঘাটতি পূরণের জন্য আমরা যে বৈদেশিক মুদ্রা পেতাম সেটা যথেষ্ট নয়। যার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে চাহিদা যে পরিমাণে বেড়েছে যোগান সেই তুলনায় কম বেড়েছে। তাই ডলারের অতিরিক্ত চাহিদা রয়ে গেছে। যার কারণে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ এসেছে।”
তিনি বলেন, মূলত দুটো কারণে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একটি হচ্ছে- আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য, জ্বালানি ও নির্মাণ সামগ্রীসহ প্রায় সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্য বেড়েছে।
“দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- আমাদের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বেড়েছে। এই চাহিদার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং যেসব পণ্যের মূল্য সরকার নির্ধারণ করে না, সেগুলোর মূল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।”
তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে আমদানি পণ্যের যে চাহিদা রয়েছে সেখানে বাজেটকে ভূমিকা রাখতে হবে। একইসঙ্গে ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্যও ভূমিকা রাখতে হবে।“
সরকার ইতোমধ্যে যেসব উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা নেই কিন্তু আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল এমন প্রকল্পে ধীরে চলো নীতি গ্রহণের যে ঘোষণা দিয়েছে- তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
“তবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে।”
নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জালানি তেলের বাজার প্রক্রিয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ। এ দুটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির জন্য ছোঁয়াচে। এর প্রভাব প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পড়ে।”
পরিসংখ্যান বুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী গত এপ্রিলে দেশে দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।
‘বিশ্বে খাদ্য সংকট আসছে’ এ ধরনের সতর্কতা ইতোমধ্যে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি), আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে ড. জাহিদ বলেন, “খাদ্য সংকট যখন আসে তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর নির্ভর করা যায় না।”
“কাজেই খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আপনিতো কোনও ঝুঁকি নিতে পারবেন না। সে হিসাবে সারের দাম বাড়াতে পারবেন না। ডিজেলের দাম বাড়াবেন কী না সে ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।”
চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বরাদ্দে সরকার ভুর্তুকি ও প্রণোদনায় ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা রেখেছে। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তবে এ ভর্তুকি বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহারের ওপর সফলতা নির্ভর করবে বলে মনে করিয়ে দেন তিনি।
মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে প্রান্তিক মানুষের খাদ্য অনিশ্চয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আগামী বাজেটে প্রান্তিক মানুষের জন্য কম দামে খাদ্যপণ্য সরবরাহ, বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভাতার পরিমাণ এবং প্রয়োজনে সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
“খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাই কৃষিতে আরও যেসব পণ্য ব্যবহার হয়, ডিজেল ও বিদ্যুৎসহ উৎপাদন সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম আপনি কতটুকু বাড়াবেন সেখানে বিচক্ষণতা দেখাতে হবে।“
“এটাই আগামী বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ” বলে চিহ্নিত করেন তিনি।
চলতি অর্থবছরে বাজেটে খাদ্য খাতে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, বিদ্যুতে ১২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
ড. জাহিদ বলেন, আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার ইউরোপের বাজারে মন্দা যে আসবে- এটা নিয়ে এখন আর বিতর্কের সুযোগ নেই। তবে এই মন্দা কবে আসবে, কতটা গভীর হবে, কতদিন টিকবে এটা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনতিতে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে সেখানেও মন্দা আসার আশঙ্কা অনেক বেড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় মন্দা আসলে আমাদের রপ্তানি কমে যাবে। তখন আমাদের শিল্প ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাই ওই মন্দা মোকাবিলায় দ্রুত প্রস্তুতি নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল কৌশলের কারণে রিজার্ভ এক বছর আগের অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও ‘খারাপ অবস্থানে’ নেমেছে মন্তব্য করে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, গত অর্থবছরের অগাস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রায় ৫৮০ কোটি ডলারের মত বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এরফলে রিজার্ভ এখন ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, আমাদের যখন ডলার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন আমরা বিক্রি করে দিচ্ছি।
“আমাদের জরুরি প্রয়োজনে যদি বড় ধরনের আমদানি করতে হয় তখন রিজার্ভ বড় থাকলে সেখান থেকে পরিশোধের সুযোগ থাকে। কিন্তু আপনার রিজার্ভ যদি আপনি বড় করতে না পারেন তাহলে বিপদে পড়ে যাবেন।“
“যেটা শ্রীলংকায় হয়েছে” যোগ করেন তিনি।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “ডলারকে নিয়ন্ত্রণ করার দরকার নেই। কারণ এটা বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।“
তিনি বলেন, “সরকার ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে উন্নতি হয়েছে দাবি করছে। সরকার বলছে দেশে অনেকগুলো সেবা (ওয়ানস্টপ) এক ছাদের নিচে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখনও বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ এখনও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেনি।
কোভিড-১৯ এর কারণে গত দুই বছর বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচক প্রকাশ না করলেও এর আগের বছর ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম।
“তাই আগামী বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মত উদ্যোগ নিতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে দেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল ৩৮৮ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৩৩৭ কোটি ডলার।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে ব্যবসা সহজীকরণ করতে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে অধিকতর মান সম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরির পরামর্শ রাখেন তিনি।