গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৭টি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বছরের অধিকাংশ সময় অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা বিপিডিবিকে; যা আগের বছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি।
Published : 04 Mar 2022, 12:41 AM
সরকারি তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট বা বিডব্লিউজিইডি’ এই তথ্য জানায়।
দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে জানিয়ে এতে বলা হয়, “বসে বসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা আদায় করা এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্ত, সরকার কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আসছে, যার ফলে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা বহন করতে হচ্ছে।”
বিডব্লিউজিইডি বলছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বিপিডিবি ৩৭টি কোম্পানিকে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেছে। বর্তমান মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করার পরও এই ব্যয়ের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিপিডিবি‘র বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের ৫৪.৫ শতাংশ বেশি।
৬৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন-ক্ষমতাসম্পন্ন শীর্ষ ১২টি কোম্পানি ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রদত্ত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
এ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে সামিট গ্রুপ। তাদের পরে পর্যায়ক্রমে রয়েছে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ট্র্যাক, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি।
অতি-সক্ষমতা এবং ক্যাপাসিটি চার্জের উপর বিডব্লিউজিডি-এর রিপোর্টে জোর দিয়ে বলা হয়, যদি বাংলাদেশ নতুন জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কোটি কোটি টাকা খরচ করা অব্যাহত রাখে, তবে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বাড়তেই থাকবে এবং তা বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
প্রতিবেদনটি তৈরির সঙ্গে যুক্ত বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, “গবেষণার অধিকাংশ তথ্যই বিপিডিবির পাবলিক ডাটা থেকে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ক্যাপাসিটি চার্জের হিসাব নেওয়া হয়েছে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে।”
তিনি জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মাত্র ১৫৩ দিন চলমান ছিল এবং ২১২ দিন অলস বসে ছিল।
মেহেদী বলেন, বিশ্বব্যাপী বিশেষ প্রয়োজনে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস রাখা হচ্ছে আদর্শ নিয়ম। জাপানে ১০ শতাংশ অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এটা বেশি হলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এসবের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়েই লোকসানটা হচ্ছে।
গবেষক দলের সদস্য ইসমাইল আলী বলেন, ” বাংলাদেশে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও সেগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদর্শ কোনো মানদণ্ডও নেই। ২০১২ সালে একটি বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। একটিমাত্র কোম্পানি (সামিট গ্রুপ) দরপত্রে অংশ নেওয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি ধরা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন সেটিকেই আদর্শ ধরে নিয়ে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। যদিও গত এক দশকে বৈশ্বিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ব্যয় প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।”
তিনি বলেন, “সম্প্রতি পাঁচটি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি দ্বিতীয় দফা নবায়ন করা হয়েছে। এ ধরনের প্রবণতা বিদ্যুৎ খাতে বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাই মেয়াদ উত্তীর্ণ রেন্টাল কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন বন্ধ করা উচিত। তবে একান্ত প্রয়োজনে নবায়ন করা হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান বন্ধ করতে হবে।”
অব্যবহৃত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া, ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পে’ নীতি গ্রহণ করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করাই নতুন অর্থবছরের জন্য ‘উপযুক্ত সিদ্ধান্ত’, বলেন তিনি।
বাংলাদেশে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৪৩ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনা বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) যার কোনো সরকারি নিবন্ধন কিংবা কার্যালয় নেই। তবে বিভিন্ন জনসম্পৃক্ত বিষয়ে সরকারি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি।