এমন পরিস্থিতিতে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে তাতে দেশে উৎপাদন সক্ষমতার অপচয়য়ের বৃত্তে আটকা পড়ে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিসিস (আইইইএফএ) সোমবার বাংলাদেশের বিদ্যুৎ নিয়ে পর্ালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়,করোনাভাইরাস মহামারী বাংলাদেশসহ বিশ্ব বাজারেই বিদ্যুতের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। এতে আয় কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওপর একদিকে যেমন আর্থিক চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখতে বিপুল মাশুল দিতে হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর প্রভাবের ফলে বিদ্যুতের দীর্ঘমেয়াদী চাহিদা যতটা থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে কমবে বলে গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য আইইইএফএর জ্বালানি অর্থায়ন বিশ্লেষক সিমন নিকোলাস মনে করেন।
তিনি বলেন, “বিদ্যুতের চাহিদায় প্রবৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের পূর্বাভাস ও কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ বাড়ানোর বর্তমান পরিকল্পনার ভিত্তিতে আমরা হিসাব করে দেখেছি যে, ২০৩০ সাল নাগাদ যত বিদ্যুৎ দরকার হবে তার চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি উৎপাদন সক্ষমতা থাকবে বাংলাদেশের।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারীর আগে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ৫৭ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার হয়নি, অলস পড়ে ছিল।
এই অপচয়ের জের টানতে এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে সকারকে ৯ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।
অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য মাশুল এর মধ্যে চাহিদা মন্দায় রাজস্ব হারানো বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিউবো) বাড়তি ভর্তুকি দিতে বাধ্য করতে সরকারকে।
আইইইএফএর হিসাবে , ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে দেওয়া সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা থেকে ৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১২ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎখাতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৯ হাজার ৬৩০ মেগাওয়াট। তবে নভেল করোনাভাইরাসে সর্বত্র অবরুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ভরা মওসুমেও বিদ্যুতের চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হচ্ছে না।
বিউবোর ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, রোববার সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে প্রকৃত সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১০ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি।
কোভিড-১৯-এর প্রভাব বলতে গবেষণায় বোঝানো হয়েছে, বিদ্যুতের চাহিদা দীর্ঘমেয়াদে ধারণার চেয়েও অনেক কমে যাবে। কারণ মহামারীর প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে বিদ্যুতের চাহিদা দুটোই কমবে।
পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, মহামারীর প্রভাবে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
নিকোলাসের মতে, তুলনামূলক সস্তা নিজস্ব গ্যাস থেকে সরে এসে কয়লা ও এলএনজি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গেলে উৎপাদন সক্ষমতার দীর্ঘমেয়াদী অপচয়ের বৃত্তে আটকা পড়বে বাংলাদেশ।
এর ফলে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। ভর্তুকিতে লাগাম টানতে বাড়াতে হবে বিদ্যুতের দাম। তাতে একদিকে যেমন সরকারের বাজেট বরাদ্দে চাপ তৈরি করবে, অন্যদিকে ভোক্তাদের উপর বাড়তি ব্যয়ের বোঝা চাপবে।
২০০৯-১০ থেকে গত ১১ বছরে খুচরা পর্যায়ে ১০ দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯৮ শতাংশ। সর্বশেষ এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়।
আশু লোকসান নিয়ন্ত্রণে গ্যাস ও কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার সুপারিশ করে গবেষণা প্রতিবেদনে মিশর ও ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে।
মিশরে সম্প্রতি ৬ দশমিক ৬ গিগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার মাশুল গুণতে হয়েছে ইন্দোনেশিয়াকে। ২০১৮ সালে দেশটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ কোম্পানি পিএলএনকে প্রায় ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (৫ বিলিয়ন ডলার) ভর্তুকি দিয়েছে।
সম্প্রতি চালু হওয়া পটুয়াখালীর পায়রায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশেও ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। ১৪ মে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলেও অর্ধেকের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা অলস পড়ে থাকছে। এর জন্যও প্রতিমাসে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বাড়তি ১৬০ কোটি টাকা (১৯ মিলিয়ন ডলার) গচ্চা দিতে হচ্ছে। এতে বিউবোর আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে।
বিদ্যুৎ খাতকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল করতে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বাংলাদেশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদন।
এই গবেষণা প্রতিবেদনের বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতের গবেষক পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোলার দিয়ে কখন বেইজলোড ডিমান্ড (প্রকৃত চাহিদা) পূরণ করা যায় না। অন্যান্য উৎসগুলো থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে।”
এখন ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সৌরশক্তি থেকে আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের চরাঞ্চল, রেললাইনের দুই ধার, ভবনের ছাদ ও অন্যান্য পতিত জমি কাজে লাগালে সর্বোচ্চ চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সৌরশক্তি থেকে আনা সম্ভব বলে তিনি জানান।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে প্রকৃত চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। কোভিড-১৯ মহামারী না থাকলে এখন দেশের পরিস্থিতি তাই থাকতো।
“কারণ এবছর বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। আর উৎপাদন সক্ষমতা রাখা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট।”