সোনাদিয়ায় সমুদ্রবন্দর আর হচ্ছে না

দীর্ঘ আট বছর ঝুলে থাকার পর কক্সবাজার জেলার সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ থেকে সরে আসার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানাল সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2020, 06:07 PM
Updated : 1 Sept 2020, 04:50 AM

সোনাদিয়ার খুব কাছাকাছি মাতারবাড়িতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। পাশাপাশি দুটো বন্দর হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, তাই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন।

২০১২ সালের ২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন’ এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে আট বছর আগের সেই সিদ্ধান্ত বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর করার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সোনাদিয়ায় আর কোনো সমুদ্রবন্দর হবে না। সোনাদিয়ার খুব কাছাকাছি মাতারবাড়িতে একটা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চলছে।”

সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়ে আনোয়ারুল বলেন, “যেহেতু মাতারবাড়িতে হয়ে গেছে, সেজন্য সোনাদিয়ায় যদি আবার সমুদ্রবন্দর হয়, তবে আমাদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অনেক ভারসম্য ক্ষুণ্ন হবে। এটা যখন স্টাডিতে ধরা পড়ল তখন সরকার সিদ্ধান্ত নিল সোনাদিয়াতে প্রকৃতির ক্ষতি করে সমুদ্রবন্দর করার দরকার নেই। মাতারবাড়িতেই মাচ মোর স্যুইটেবল।”

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দেয়। জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক কনসালটেন্টস ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও করা হয়।

সে সময় ২৫ বছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই গভীর সমুদ্রবন্দরের পর্যায়ক্রমিক উন্নয়নের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর হলে ২০২০ সাল নাগাদ সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে ৭৪ গুণ বেশি কনটেইনার ওঠানামা করা যাবে।

এর মধ্যে চীন সরকার সোনাদিয়া বন্দরে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখায়। ২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট (তখন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট) শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে এলে ওই আলোচনার পালে আরও হাওয়া লাগে।

এরপর দুই দেশের মধ্যে প্রকল্পটি নিয়ে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হলেও বাস্তব কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০১৪ সালের জুনে প্রধানন্ত্রী শেখ হসিনার চীন সফরের সময় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও পরে তা আর হয়নি।

অর্থায়নের পরিমাণ নিয়ে দর কষাকষিতে বিষয়টি আর এগোয়নি বলে সে সময় রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল।

এরইমধ্যে পটুয়াখালীর পায়রাতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের তৎপরতা শুরু হয়। ভারতও সে সময় বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজে আগ্রহ দেখায়।

কিন্তু পায়রার গভীরতা গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য উপযোগী কিনা- সেই প্রশ্ন উঠলে সরকারের ওই অগ্রাধিকার প্রকল্পও থমকে যায়।

২০১৪ সলের অগাস্টে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রস্তাবিত এলাকার মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে ৩৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছিল সরকার।

জাপানের অর্থায়নে ওই প্রকল্প নির্মাণ করতে গিয়ে তাদের সমীক্ষায় বেরিয়ে আসে, মাতারবাড়ি এলাকা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উপযোগী।

এরপর চলতি বছরের ১০ মার্চ মাতারবাড়িতে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায়।

প্রকল্পের ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি কোটি ১৬ লাখ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে ঋণ সহযোগিতা হিসেবে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দিচ্ছে জাপান।

বাকিটার মধ্যে সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা যোগান দেবে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ যৌথভাবে ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। এর ডিজাইন ও লে-আউটসহ সব নকশা জাপানি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে করা হচ্ছে।

এই প্রকল্পের অধীনে সংযোগ সড়কসহ গভীর সমুদ্র বন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দীর্ঘ দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর ফলে বিশাল জাহাজ থেকে সরাসরি পণ্য ওঠানামা সহজ হবে।