ইসলামী ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করে দেশের বাইরে চলে যান মান্নান। সাড়ে সাত বছর যুক্তরাষ্ট্রে থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে দেশে ফিরেছেন তিনি।
Published : 31 Aug 2024, 12:19 AM
ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে এস আলম গ্রুপ রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ‘জোর’ করে পদত্যাগপত্র নিয়েছিল বলে দাবি করেছেন ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মান্নান।
সাত বছর আগে ‘মেহমান বানিয়ে’ পদত্যাগপত্রে সই করানো হয় বলেও তুলে ধরেছেন তিনি।
শুক্রবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এ কথা বলেন মান্নান।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক থেকে পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে যে কাগজে সই নেয়া হয়, তা ইসলামী ব্যাংকের নামে একটি প্যাড। সেই ধরনের প্যাড ১৯৮৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক ব্যবহার করেনি।’’
এক সময়ে ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ব্যাংকটি দখলে নিতে ২০১৩ সাল থেকে নানা গোষ্ঠী তৎপরতা চালায়। ২০১৬ সালে তা দৃশ্যমান হতে শুরু করলে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে।
তখন ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন মুস্তাফা আনোয়ার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন আবদুল মান্নান।
মুস্তাফা আনোয়ার ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
ভাইস-চেয়ারম্যানসহ সবাইকে একযোগে রাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঢাকার একটি হোটেলে তুলে নিয়ে গিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করেন। দেশের ব্যাংকিং খাতে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ওই ঘটনা নিয়ে ২০১৭ সালে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।
সেখানে লেখা হয়, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন করেন। এরপর তাদেরকে বাসভবন থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইকোনমিস্টের সেই লেখায় বলা হয়, কয়েক ঘণ্টা পর একটি হোটেলে সভায় বসে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। পদত্যাগ করা পরিচালকদের স্থলাভিষিক্ত কারা হবেন, তা নির্ধারণ করা হয়। তারপর ধীরে ধীরে নামে বেনামে ৩০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে নেয় এস আলম।
সেদিন রাতে হোটেলে কী হয়েছিল তা তুলে ধরে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘আমাকে মেহমানদারি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ইকোনোমিস্ট প্রথম লিখেছে। যারা আমাকে মেহমানদারি করেছে, আমার মেজবান যারা (যার মেহমান) তারা প্রথম আলো ঘেরাও করেছিল। রাতের বেলায় পত্রিকার প্রেসে গিয়েছিল, তারা সম্পাদককে হাসপাতালে পেয়ে বলেছিল হেডলাইন পরিবর্তন করে দিতে, হেডলাইন পরিবর্তন না করলে পরের দিন পত্রিকা বাজারে মুখ দেখবে না।’’
ইসলামী ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করে দেশের বাইরে চলে যান আব্দুল মান্নান। সাড়ে সাত বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হিসেবে থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে দেশে ফিরেছেন।
মান্নান বলেন, ‘‘ওই দিন (৫ জানুয়ারি, ২০১৭) অনেক রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের স্যারেরা অফিস করেছেন। তারা ওই দিনই ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করতে কাজ করেছেন। এগুলো কীভাবে হতে পারে একটি দেশের ব্যাংক খাতে, যে ব্যাংক খাত একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ?”
পরের কয়েক বছরে এস আলম গ্রুপের টেলিফোনে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এমনটা ঘটানোর কেউ সাহস না পায়।”
ব্যাংক কোম্পানি আইন নতুন করে তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংকে সরিষার মধ্যে ভূত, বাংলাদেশ ব্যাংককে মেরামত করা দরকার। তাদের স্বাধীন করতে হবে।’’
দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারলেই তিনি পরিচালক হতে পারবেন এই ধারা যোগ করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে বাংলাদেশে ‘জমিদারি ব্যবস্থা’ চালু হয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অরাজনৈতিক সরকার থাকায় ব্যাংক খাত সংস্কারের সুবর্ণ সুযোগ উল্লেখ করে মান্নান বলেন, ‘‘জনগণের সম্পদ এখন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মতিঝিলে। সব সম্পদ এখানেই পুঞ্জীভূত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ‘’
দেশের বাইরে গিয়েও নিরাপত্তার অভাবে ব্যাংকটি দখলের বিষয়ে মুখ খুলতে পারেননি দাবি করে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘আবার বাংলাদেশে এসে নিশ্বাস নিতে পারব, বলে মনে করিনি। আমি এখন মনে করি, কথা বলার স্বাধীনতা পেয়েছি। এটা আমার বোনাস লাইফ, তাই কথা বলব।’’
‘এস আলমের টাকা পাচারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা’
এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৫০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে বলে অভিযোগ করে ওয়েবিনারে ব্যাংকার ও লেখক মামুন রশীদ বলেন, ‘‘এখন ব্যাংক খাতে এস আলম মডেল দাঁড়িয়েছে। তারা ব্যাংকটি দখল করে নিয়েছে গান পয়েন্টে সব পরিচালকদের পদত্যাগে বাধ্য করে।
“পরে এক রাতের মধ্যেই সুপারসনিক গতিতে নতুন এমডি নিয়োগ অনুমোদন দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব কিছুই হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে থেকে উপরের নির্দেশে।’’
এস আলম গ্রুপ ব্যাংকগুলো থেকে যে টাকা নিয়েছে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর ও পরে উপদেষ্টা হওয়া এস কে সুর চৌধুরীর সহায়তায় পাচার হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
“তার (এস কে সুর) ব্যাপারে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেলও কথা বলেছিলেন। তারপরেও কিছু হয়নি। তার দায়িত্ব ছিল এস আলম গ্রুপের ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া টাকা পাচার করে দেওয়া।’’
ওয়েবিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যায়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘‘খেলাপি ঋণের ব্যাপ্তিটা কত তা, আমরা জানি না। এতটুকু জানি যে, ঋণগুলো কতগুলো গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।’’
ব্যাংক খাতে বড় রকমের আস্থাহীনতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ব্যাংক কোম্পানি অন্য দশটা কোম্পানির মত না। এর মালিক হচ্ছেন আমানতকারীরা। তাদের টাকায় ব্যাংক পরিচালিত হয়। শেয়ারহোল্ডাররা ব্যাংক মালিক না, তারা অল্প কিছু টাকার যোগান দেয়। এখন প্রথম কাজ হচ্ছে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা ও তাদের স্বার্থ প্রতিরক্ষণ করা।’’
বেনামি ঋণ, মন্দ ঋণ, এক উদ্দেশ্যে নেওয়া ঋণ ভিন্ন খাতে ব্যবহারকে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ঋণের বিপরীতে নেওয়া জামানত পর্যাপ্ত না। প্রি এরেঞ্জ (আগে থেকে ঠিক করা কাকে দেয়া হবে) ঋণ বেশি হয়েছে ব্যাংকগুলোতে।
‘‘আমরা এমন প্রমাণও পেয়েছি যে, সোনালী ও জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা বলেছেন, ‘উপরের নিদের্শ ঋণ দিতে হবে’। ব্যাংকাররা সময়ও পাননি ঋণ গ্রহীতার আবেদন যাচাই করার। তারা আগেই ঠিক করে রেখেছেন কাকে ঋণ দেয়া হবে। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যানরা অন্য পরিচালকদের কথাও বলতে দেননি পর্ষদে।’’
কোটা সংস্কারে ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন দাবি এক পর্যায়ে গণ দাবিতে পরিণত হলে গত ৫ অগাস্ট ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে ভারতে উঠেছেন শেখ হাসিনা।
এরপর আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারক ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ব্যাংক পরিচালকদের একটি অংশ।
ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের অনেকেও গা ঢাকা দিয়েছেন। দেশে নেই এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস, বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যানও আসছেন না দেশে। আরও অনেক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আসছেন না ব্যাংকে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ব্যাংক খাত সংস্কারে ‘ব্যাংকিং কমিশন’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এস আলম ও তার পরিবারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ও পুঁজিবাজারে বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।
ওয়েবিনারে সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘জনকল্যাণের পরিবর্তে গোষ্ঠীর কল্যাণে রাজনীতি কাজ করছে। ইসলামী ব্যাংক দখলের পেছনে রাজনৈতিক কারণ ও রাজনীতিকদের নির্দেশ ছিল।
“বিদায়ী সরকার ক্রোনি গোষ্ঠী (স্বজনতোষী পুঁজিপতি) সৃষ্টি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছে।”
রাজনীতি ঠিক না করে ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক নেতৃত্ব না আনা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলেও মত দেন তিনি।