সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল ১৪ বছরের মধ্যে প্রথমবার বাংলাদেশের সার্বভৌম ঋণমান সূচক কমিয়েছে।
Published : 31 Jul 2024, 11:25 PM
মূল্যস্ফীতিসহ নানা সংকটে অর্থনীতির সূচকগুলো চাপে থাকার মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকালে সংঘাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে সাময়িক অচলাবস্থা ধাক্কা হয়ে এসেছে অর্থনীতিতে। এরমধ্যেই এসঅ্যান্ডপির সার্বভৌম ঋণমান সূচকের অবনমন কী নতুন চাপ তৈরি করবে?
অর্থনীতিবিদ বলছেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণমান কমানোর কারণে সামগ্রিকভাবে একটি নেতিবাচক বার্তা যাবে দেশ-বিদেশে। একটি দেশের বা কোনো কোম্পানির সার্বিক অবস্থা জানতে এসব কোম্পানির প্রতিবেদনের তথ্য ও পর্যবেক্ষণ গুরুত্বসহকারে বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে বিনিযোগকারী, উদ্যোক্তা বা ঋণদাতারা। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা থাকে এসব ঋণমান সূচকের।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল ১৪ বছরের মধ্যে প্রথমবার যখন বাংলাদেশের সার্বভৌম ঋণমান সূচক কমাল, যখন রিজার্ভ কমছে, ডলারের সংকট কাটছে না এবং আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতাও রয়েছে। বিদেশি ঋণ আসা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও কমছে।
আন্তর্জাতিক ঋণমান প্রতিষ্ঠানটি মঙ্গলবার বাংলাদেশের ঋণমান সূচক ‘বিবি মাইনাস’ থেকে এক ধাপ কমিয়ে ‘বি প্লাস’ করেছে। ২০১০ সালের পর প্রথম ঋণমান কমাল তারা। এতদিন ধরে ’বিবি মাইনাস’ রেটিং দিয়ে আসছিল তারা।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের প্রতিবেদনে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থায়নের চাহিদার চাইতে জোগান কম। বৈদেশিক লেনদেন স্থিতিশীল নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার জোগানের যা চাহিদা তা রেমিটেন্স ও রপ্তানির মাধ্যমে যা আয় হয় তার চাইতে অনেক বেশি। এতে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এটি চাপ তৈরি করেছে অর্থনীতিতে।
অপরদিকে রাজস্ব আয়ের অনুপাতের হিসাবে সুদের ব্যয়ও বেশি বলে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এসঅ্যান্ডপিসহ আন্তর্জাতিক অন্য ঋণমান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সূচক কমার প্রভাব কী হতে পারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, ঋণমান কমার অর্থ হল বাইরের দেশ থেকে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতা কমে যাওয়া। বিদেশি ঋণদাতা কোম্পানিগুলো অর্থনীতির অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে ঋণ দিতে দ্বিধায় থাকবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বেসরকারিখাতে স্বল্প মেয়াদি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এ ঋণমান আরও বাধা তৈরি করবে। ব্যাংকগুলো সাধারণত বিদেশ থেকে স্বল্প মেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে। সেই কয়েকটি কারণে স্বল্প মেয়াদি ঋণ আসা কমে যেতে পারে।”
সাবেক এই ব্যাংকার বলেন, বিদেশি কোনো কোম্পানি বা সংস্থা যখন এদেশে ঋণ দিতে আসে তখন তারা ঋণমান যাচাই বাছাই করে। কারণ সেই ঋণ বাংলাদেশ সুদে-আসলে ফেরত দিতে পারবে কি না সেই অনিশ্চয়তার বিষয়ে জানতে চায়।
তৌফিক আহমদ চৌধুরীর ভাষ্য, ঋণ পাওয়া তো কঠিন, ঋণমান কমার সঙ্গে বিদেশি ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে। তাতে যাদের ঋণ নেওয়ার কথা তারা ঋণ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে। কারণ এতে সুদ আসল আরও বেড়ে যাবে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে বেসরকারি খাতের কোম্পানি ও উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণদাতা কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প মেয়াদি ঋণ নিয়েছেন ৮ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে আগের নেওয়া ঋণ সুদসহ পরিশোধ করেছেন ৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ডলার আসার চাইতে বাইরে চলে যাচ্ছে বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণমান কমার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগেও দেখা যায়।
বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঋণমান কমায় কমবে বিদেশি বিনিয়োগ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সেগুলো কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।”
দেশে ২০২৩ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ১৪ শতাংশ কমেছে। পাশাপাশি কমেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বন্ড ও শেয়ারে (পোর্টফোলিও ইনভেস্ট) বিদেশিদের বিনিয়োগ। ২০২৩ সালে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমেছে প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ।
ঋণমান কমার পরোক্ষ প্রভাব কর্মসংস্থানে পড়বে বলে মনে করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক (পিআরআই) আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, এতে বিদেশি বিনিয়োগ কমলে দেশের কর্মসংস্থান তৈরি হবে কম।
তিনি বলেন, “বর্তমানে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। সাধারণ মানুষ যা আয় করে তা দিয়েই চলতে হিমশিম খাচ্ছে। তার মধ্যে যদি বেকারত্ব বাড়ে এটা অত্যন্ত খারাপ হবে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য।”
এ বিষয়ে সরকারের জরুরিভত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘাত ও ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সাম্প্রতিক ঘটনায় দেশের রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগহীন হয়ে পড়েছিলেন।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এসঅ্যান্ডপির ঋণমান কমানো ও চলমান সামগ্রিক পরিস্থিতি রপ্তানিতে ব্যাঘাত ঘটাবে, যা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সমস্যা তৈরি করবে।
বাংলাদেশের ঋণমান কমাল এসঅ্যান্ডপি
বাংলাদেশের ঋণমান আবার কমাল ফিচ
মুডি'স রেটিংয়ে ঋণমান কমল বাংলাদেশের