নবরূপে ফিরছে সেই লালদিঘী ময়দান

ঐতিহাসিক এ মাঠে নবসজ্জার অংশ হিসেবে ‘ছয় দফা মঞ্চ’ নির্মাণসহ মাঠের আধুনিকায়ন করা হয়েছে, যা রোববার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মিঠুন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Dec 2022, 07:20 PM
Updated : 3 Dec 2022, 07:20 PM

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ লালদিঘী মাঠ সেজেছে নতুন রূপে; যে মাঠে জড়িয়ে রয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফার ঘোষণা, ঊনসত্তরের গণঅভুত্থানের সেই ইতিহাস।

রোববার দীর্ঘ প্রায় এক দশক পর চট্টগ্রাম নগরীতে দলীয় জনসভায় যোগ দিতে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ দিন যে ২৯টি প্রকল্প তিনি উদ্বোধন করবেন, সেটির মধ্যে আছে নতুন রূপে সজ্জিত লালদিঘী ময়দানও।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের আওতায় ‘ছয় দফা মঞ্চ’ নির্মাণসহ মাঠের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। আছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার টেরাকোটা।

চারপাশে সীমানা দেয়াল ঘেরা মাঠে থাকছে কিডস কর্নার, বসার বেঞ্চ আর ওয়াকওয়ে। সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে পুরো মাঠ।

মঞ্চ নির্মাণসহ সংস্কার কাজের মোট ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।

দীর্ঘদিন থেকে ঐতিহাসিক এই লালদীঘির মাঠটি অবৈধভাবে দখল ও সংস্কারের অভাবে জৌলুস হারিয়ে একাংশে গড়ে উঠেছিল অবৈধ মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড এবং বছরের অন্যান্য সময়ে বসতো নানান ধরনের মেলা।

৩২ নম্বর আন্দরকিল্লার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নগর আওয়ামী লীগের নেতা জহর লাল হাজারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলেন, “চট্টগ্রামের যেকোনো রাজনৈতিক সংগ্রামের ঠিকানা এই লালদীঘি ময়দান। দেশের সব ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষীও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার ভাষণ দিয়েছিলেন এ ময়দানে।

“তাই মাঠটি সংস্কার ও সংরক্ষণ ছিল চট্টগ্রামবাসীর কাঙ্ক্ষিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ছয় দফা মঞ্চসহ পুরো ইতিহাস সংরক্ষণে যে প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সেজন্য আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকব।”

মাঠে থাকা ১৮টি টেরাকোটায় ঠাঁই পেয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী প্রচারণা, ৭ মার্চের ভাষণ, ৬ দফা আদায়ের দাবি আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণঅভুত্থান, ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর প্রচারণা, ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ, ভাষা আন্দোলন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত ও মাস্টারদা সূর্যসেনের ম্যুরাল।

মাঠের আরেক সীমানা দেয়ালে আছে সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের দেয়াল চিত্র। শিশু কর্নারে আছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দেয়াল চিত্র।

৬ দফা মঞ্চে ছয় দফার তিনটি করে দফা দু’পাশে সংক্ষিপ্ত আকারে মুদ্রিত। মাঝের অংশে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে জাতির পিতার সভা এবং ছয় দফার দাবিতে মিছিল সমাবেশের ছবি আঁকা আছে।

১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা ঘোষণার সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তখন আমরা সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। কয়েকদিন ধরে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রচার করলাম জনসভার কথা।

“মাইকিংয়ে আমরা বলতাম- এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার শোষিত ও মুক্তিকামি মানুষের নেতা বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমানের জনসভায় যোগ দিন। সেদিনের সভায় আমাদের স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ছয় দফা ঘোষণা করা হয়েছিল।”

ইউনুছ বলেন, “আমাদের সব আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার মাঠটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল। ছয় দফা মঞ্চ নির্মাণ ও মাঠ সংরক্ষণ করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‍কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের স্বাধীকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে এর মাধ্যমে।”

শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, ভাষা আন্দোলনেও জড়িয়ে আছে লালদিঘী মাঠ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষার দাবিতে মিছিলে গুলির প্রতিবাদে বিকেলে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

এই মাঠে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ও ২৫ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারির সভায় প্রথম আবৃত্তি করা হয় মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা- ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’।

লালদীঘি মাঠের অদূরে পেট্রোল পাম্প (ছবিতে দৃশ্যমান) এলাকাটিতে (সেসময়ের ভিক্টোরিয়া পার্ক) ২২ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীরা প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করে। সে রাতে পুলিশ তা ভেঙে দিলে পরদিন আবার শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়; ২ দিন পর যা পুলিশ ভেঙে দিয়েছিল।

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐতিহাসিক লালদীঘির মাঠের গুরুত্ব অনুধাবন করে কোতোয়ালী আসনের সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মাঠটিকে সংস্কারের উদ্যোগ নেন।

জানতে চাইলে নওফেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রকল্পটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের পর শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য মাঠটি খুলে দেওয়া হবে।

“তবে শৃঙ্খলা আনতে অন্য কার্যক্রমের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে; যাতে অবৈধ কোনো স্ট্যান্ড গড়ে না ওঠে, যখন-তখন যেকোনো কিছু করে মাঠের ক্ষতি করা যেন না হয়।”

আরও যেসব প্রকল্প উদ্বোধন হবে

চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১৮৯৭ কোটি ব্যয়ে ২৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং প্রায় ১৪৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রী বেশকিছু প্রকল্পের উদ্বোধন এবং কয়েকটি প্রকল্পের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন ৬৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি প্রকল্প, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীন ৬৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীন ৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪টি প্রকল্প, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীন প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্প, শিল্প ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি করে দুটি এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন দুইটি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের নতুন ভবন নির্মাণ, নগরীর পাঁচলাইশ এলাকায় জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন মিরসরাই ও সন্দ্বীপ অংশে জেটি নির্মাণ এবং বাঁশখালীতে মডেল মসজিদ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।