গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ: ব্যাংক র্কমকর্তার যাবজ্জীবন

গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মো. ইফতেখারুল কবিরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেয়া হয়েছে। অন্য দুই আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2023, 04:06 PM
Updated : 1 June 2023, 04:06 PM

জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের মামলায় সাবেক এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। 

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মুন্‌সী আবদুল মজিদ এ রায় দেন।  

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক প্রায়োরিটি ব্যাংকিং ম্যানেজার মো. ইফতেখারুল কবির। তিনি নগরীর ডবলমুরিং থানার দারোগাহাট রোডের আলমগীর কবীরের ছেলে। 

অন্য দুই আসামি জুলেখা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ত্বাধিকারী আবদুল মাবুদকে ১২ বছর এবং লাবীবা ট্রেডিং এর মালিক জাকির হোসেন বাপ্পীকে ৬ বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত। 

দুদকের আইনজীবী কাজী সানোয়ার আহমেদ লাভলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মো. ইফতেখারুল কবিরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেয়া হয়েছে। অন্য দুই আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত। 

“অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আরেক আসামি ফারজানা হোসেনকে খালাস দেন আদালত। দণ্ডিত তিন আসামি রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। পরে তাদের কারাগারো পাঠানো হয়েছে।” 

আসামিদের মধ্যে মো. ইফতেখারুল কবিরকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া দণ্ডবিধির আরো চারটি ধারায় এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় পৃথক পৃথকভাবে দোষী সাব্যস্ত করে আরো মোট ২৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ২৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। 

আসামি আবদুল মাবুদকে দণ্ডবিধির ৫টি ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে পৃথকভাবে মোট ১২ বছরের সাজা এবং ৮৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। 

আরেক আসামি জাকির হোসেন বাপ্পীকে দণ্ডবিধির ৫টি ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে পৃথকভাবে মোট ৬ বছর ছয় মাসের সাজা এবং ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। 

এ মামলার আরেক আসামি জাকির হোসেন বাপ্পীর স্ত্রী ও লাবিবা বুটিকসের মালিক ফারজানা হোসেন ফেন্সীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে বলে জানান দুদকের আইনজীবী কাজী সানোয়ার আহমেদ লাভলু।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল ইস্টার্ন ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখার ম্যানেজারের কাছে গ্রাহক কনা দে নিজের এফডিআর অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ঋণ সুবিধা নিতে আগ্রহের কথা জানান। 

তখন যাচাই করে দেখা যায় গ্রাহক কনা দে’র কাছে থাকা এফডিআর রশিদটি ব্যাংক থেকে ইস্যু করা হয়নি। কনা দে জানান, ব্যাংকের ওই শাখার প্রায়োরিটি ব্যাংকিং ম্যানেজার মো. ইফতেখারুল কবির এফডিআর এর টাকা নিয়ে তাকে ওই রশিদটি দিয়েছিল। 

এর প্রেক্ষিতে ব্যাংকের গঠিত অভ্যন্তরীণ তদন্ত দল অনুসন্ধানে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিলের মধ্যে বিভিন্ন সময় মো. ইফতেখারুল কবিরের ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালজালিয়াতির’ মাধ্যমে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে নিজের সৃষ্ট ভুয়া ও বেনামি অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর এবং গ্রাহকের সাক্ষর জাল করে টাকা উত্তোলণের প্রমাণ পায়। 

এরমধ্যে প্রবাসী গ্রাহক সুফি মোহাম্মদ হোসেন গণি নামের একজন গ্রাহক ২০১৮ সালে করা ৫০ লাখ টাকা করে দুটি এফডিআরের জন্য মোট এক কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালে আরেকটি এফডিআরের জন্য টাকা দিলে তাকে এফডিআরের জাল রশিদ দেন মো. ইফতেখারুল কবির।

এসব এফডিআরের মূল কাগজ নিজের কাছে রেখে দেন তিনি। 

এরপর সুফি মোহাম্মদ হোসেন গণির অনুপস্থিতিতে ব্যাংকে থাকা তার সব কাগজপত্র নকল করে ও স্বাক্ষর জাল করে ‘গণি এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে এফডিআরের সাথে সংযুক্ত করে সেখান থেকে ৯২ লাখ টাকা ঋণ সৃষ্টি করেন। 

এরপর গণি এন্টারপ্রাইজের নামে চেকের মাধ্যমে ১০ দফায় নগদে মোট ৭৩ লাখ টাকা এবং লাবিবা বুটিকসের নামে ১০ লাখ টাকা তুলে নেন ইফতেখারুল কবির। ২০১৯ সালের বিভিন্ন সময় এসব টাকা তোলা হয়। 

এছাড়া গ্রাহক সুফি মোহাম্মদ হোসেন গণির স্বাক্ষর জাল করে নতুন চেক বই নিয়ে তার অ্যাকাউন্ট থেকে ২০১৮ সালের ২৯ অগাস্ট ৫০ লাখ টাকা জুলেখা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবদুল মাবুদের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। 

পরে ওই বছরের ৪ নভেম্বর ২৩ লাখ টাকা আবদুল মাবুদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এবং ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর আরেক আসামি জাকির হোসেনের অ্যাকাউন্টে ১৮ লাখ টাকা পাঠিয়ে স্বাক্ষর জাল করে সেই টাকা তুলে নেওয়া হয়। এভাবে পরে আরও ৯ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন ইফতেখারুল কবির। 

তদন্তের মুখে ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জাল-জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন মো. ইফতেখারুল কবির। এরপর ব্যাংক গ্রাহক সুফি মোহাম্মদ হোসেন গণিকে তার আত্মসাৎ করা ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করে। 

ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রাহকের ১ কোটি ৯২ লাখ ৬১ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চান্দগাঁও থানায় জিডি করা হয় ২০১৯ সালের ২২ অগাস্ট। 

এই অপরাধ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শিডিউলভুক্ত হওয়ায় থানা থেকে বিষয়টি দুদককে জানানো হয়।  

তারপর ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর দুদক প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ক্রমে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রামের সেসময়ের উপ-পরিচালক লুৎফুল কবির চন্দন বাদি হয়ে মামলাটি করেন। 

দুদক উপ-পরিচালক লুৎফুল কবির চন্দন মামলাটি তদন্ত করে ২০২১ সালের ১২ অগাস্ট চার আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।